ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লাল-সবুজের মিছিল, ভালবাসার বিজয় দিবস

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮

 লাল-সবুজের মিছিল, ভালবাসার বিজয় দিবস

মনোয়ার হোসেন ॥ পথে পথে ঘুরেছে লাল সবুজের মিছিল। মনের রঙে ভিজেছে শরীর। জাতিসত্তার জন্মের অহঙ্কারে জেগেছে আত্মা। বাঙালীর বিজয় দিনে পোশাকে প্রকাশ পেয়েছে আনন্দের বারতা। শিশুর হাতের মুঠোয় ভর করে শহরের সড়ক প্রদক্ষিণ করেছে সবুজে আবৃত লাল বৃত্তের পতাকা। এভাবেই প্রাণের আবেগে লাল সবুজের ভালবাসায় ধরা দিয়েছে বিজয় দিবস। শীতের সকাল থেকেই লাল সবুজের পাঞ্জাবি কিংবা সবুজ জমিনে লাল পাড়ের শাড়ি পরে শহরময় চক্কর মেরেছ অগনিত নরনারী। রমণীর কপালের টিপে ঠাঁই করে নিয়েছিল জাতীয় পরিচয়ের প্রতীকী সেই রং। শহীদের রক্তঋণে পাওয়া পতাকার গৌরবে উজ্জ্বল ছিল বাবা-মার সঙ্গী হওয়া শিশুর মুখ। সেই কচি মুখগুলোর চাওয়া ছিল উন্নতির সোপানে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ যেন এগিয়ে চলে সঠিক পথে। সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আরেকবার অর্জন করতে হবে কাক্সিক্ষত বিজয়। তা হলেই আসলে প্রকৃত স্বাধীনতা। বিবর্ণ হবে না প্রাণপ্রিয় জাতীয় পতাকার রংটি। সাতচল্লিশতম বিজয় দিবসে এমন রঙিন রূপে ঝলমল করেছে রাজধানী ঢাকা। নগরের অলিগলি থেকে রাজপথে চোখে পড়েছে উৎসবের বর্ণিলতা। রবিবার সকাল থেকেই রাস্তায় ভিড় জমিয়েছে বিজয় দিবস উদ্যাপনে বেরুনো পতাকার রংমাখা নাগরিকরা। উদ্যাপনের সুন্দরতম দৃশ্যপটে নয়ন জুড়িয়েছে শহর চষে বেড়ানো পথিকের পোশাক। নারী থেকে পুরুষ কিংবা শিশুর পোশাকে বিস্তৃত হয়েছে চেতনার রং লাল সবুজ। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থেকে বাড়ির ছাদ অথবা রাস্তার মোড়ে মোড়ে উঁকি মেরেছে ওই দুটি রং। আর প্রতীকী ওই রং দুটি যেন স্বদেশের পক্ষ হয়ে বলেছে, বাংলাদেশ এখনও পৌঁছেনি তার কাক্সিক্ষত লক্ষে। এখনও বাকি আছে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। সেই লড়াইয়ে প্রেরণার উৎস হবে ওই লাল সবুজ। মানবিক সমাজের কথা বলবে ওই পতাকার রং। আদায় করে নিতে হবে সোনার বাংলার স্বপ্নমাখা শোষণহীন সমাজ। তা হলেই ধরা দেবে প্রকৃত স্বাধীনতা। নগরের পথে-প্রান্তরে-বাতাসে দোল খাওয়া পতাকা বয়ে বেড়িয়েছে ফেরিওয়ালারা। কিছু পয়সার বিনিময়ে লাল সবুজের মাঝে হলুদের মানচিত্র আঁকা পতাকাগুলো উঠে এসেছিল পরিবারের শিশুসন্তানের হাতে। সোনামণিদের কোমল স্পর্শে ভালবাসার সেই পতাকারা পাড়ি দিয়েছে মিরপুর থেকে সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ী থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ি, ধানমন্ডি থেকে বনানী, রমনা থেকে বসুন্ধরা, শহীদ মিনার থেকে স্মৃতিসৌধে। বিজয় দিবসে এমন করেই শোভা ছড়িয়েছে পূর্বপুরুষের সংগ্রামে অর্জিত পতাকার রং। ছোটদের গালেও জুড়ে গিয়েছিল শখের আঁকিয়েদের লেপে দেয়া বাঙালীত্বের বিজয়স্মৃতির সেই বর্ণবৈভব। দিনভর বিজয় দিবস উদ্যাপনের মঞ্চে মঞ্চে নাচ-গান করা শিল্পীরাও শরীরে জড়িয়েছিল সেই একই রং। লাল সবুজের প্রতি মানুষের সেই মোহময়তা নজরে এসেছে সকাল থেকে রাত অবধি। কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপনে জানা গেছে লাল সবুজের প্রতি তাদের আকুলতার কথা। উঠে এসেছে দেশপ্রেমের বার্তাবহ টুকরো টুকরো কিছু কথা। ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন বেলা বারোটা। ছুটির আমেজে ভরপুর শহরে বইছে আনন্দের হাতছানি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ শহীদ মিনারের চারপাশ ঘিরে চোখে পড়ে বিজয় দিবস উদ্যাপনে পথে নামা জনসমাগম। পৌষের ঝিকমিকে রোদে অনেকের শরীরেই দেখা মেলে জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক সেই ভালবাসার রং। ভাষাশহীদদের স্মৃতির স্মারকে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নজর পড়ে লাল সবুজ পোশাকে জড়ানো এক নারী। কথা হয় ফারহানা শারমিন নামের মুক্তিযোদ্ধার ওই সন্তানের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, এমন দিনে পোশাকে লাল সবুজ না থাকলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। এমনিতে সারা বছরই পোশাক কিংবা সাজ্জসজ্জার কোথাও বেছে নেই ওই দুটি রঙের একটি। দেশের বাইরে থাকলেও বিজয় দিবসে শরীরে জড়াই ভালবাসার এই দুটি রং। আমার কাছে মনে হয়, লাল সবুজের পোশাক ছাড়া বাঙালী আর বাংলাদেশ হয় না। এখনকার প্রজন্মের অনেকের মাঝে দেশপ্রেমের অভাব দেখে প্রায়ই হতাশ হই। তখন মনে হয়, এই লাল সবুজ রংই একদিন তাদের ভেতর জাগিয়ে তুলবে দেশের প্রতি মমত্ববোধ। একপর্যায়ে আফসোসের সুর থেকে পতাকার রঙের মাঝে আশার আলো দেখা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলেন, আজ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়েছে বাংলাদেশ। সমৃদ্ধির সোপান বেয়ে এগিয়ে চলেছে দেশ। তবুও উন্নতির পথে এখনও অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী মানুষ অগ্রগতির নানা ক্ষেত্রে দাঁড়ায় বাধা হয়ে। সেই প্রতিবন্ধকতা এখনও জয় করতে পারিনি আমরা। তাই একাত্তরে স্বাধীন একটি দেশ পেলেও আসেনি আমাদের কাক্সিক্ষত বিজয়। তাই আজও খুঁজে বেড়াতে হয় স্বাধীনতার অর্থ। বিশ্বাস করি, এই লাল সবুজের পতাকাই পৌঁছে দেবে সেই কাক্সিক্ষত বিজয়ের পথে। যেখানে রচিত হবে সম্প্রীতির বাংলাদেশ। থাকবে না ধর্মান্ধতা। মানবিক আর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের উদাহরণে পরিণত হবে এই দেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তরুণ প্রজন্ম সেই কাক্সিক্ষত স্বদেশ বিনির্মাণে রাখবে অগ্রণী ভূমিকা। দোয়েল চত্বরের আশপাশে পতাকা হাতে বাবা হাসিবুর রহমানের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল মেয়ে হাসিবুন্নেসা ফাইজা। বিজয় দিবসে পতাকা নিয়ে ঘুরতে কেমন লাগে এমন প্রশ্নের জবাবে নবম শ্রেণীর এই শিক্ষার্থী বলেন, এই পতাকা বহনের মাধ্যমে স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের; যাদের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি এই বাংলাদেশ। আর এই লাল সবুজ তো শুধু আমাদের পতাকার রং নয়। এটা আমাদের অস্তিত্বের অহঙ্কার। লাল সবুজের মাঝে খুঁজে পাই পাকবাহিনীকে পরাজিত করা বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের গৌরব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কথা হয় কেরানীগঞ্জ থেকে পতাকা বিক্রি করতে আসা মোঃ রমজান আলীর সঙ্গে। শুধু পতাকাই নয়, তার সঙ্গে ছিল লাল সবুজের পতাকা থেকে চড়কি, বুকের ব্যাজ, মাথার ব্যান্ডসহ নানা কিছু। ঢাকা শহর ঘুরে ফেরা এই ফেরিওয়ালা বলেন, ডিসেম্বর মাস ধইরাই এই পতাকা বেচছি। দেশের পতাকা বেইচ্যা এই কয়দিন সংসারটা ভালই চলছে। তয় আজকা বিজয় দিবসে বেশি ভাল লাগতাছে। বেচাবিক্রির সঙ্গে দ্যাশের প্রতি মনের মইধ্যে একটা মায়া জন্মাইতাছে। উল্টাদিকে যারা এই দেশটা চায় নাই তাগো লাইগা করুণা হয়। একাত্তরে দেশের লগে বেইমানি কইরাও সঙ্গী-সাথী জুটাইয়া আজ ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দ্যাহে।
×