ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শতাব্দীর সবচেয়ে বড় তামাশা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮

শতাব্দীর সবচেয়ে বড় তামাশা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ জামায়াতসহ যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে একই প্রতীকে নির্বাচনের মধ্যেই ইশতেহারে ‘ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান রাখব’ ঐক্যফ্রন্টের এমন ঘোষণায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিএনপির-জামায়াত জোটের মিত্র ড. কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘোষণাকে ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় তামাশা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা এ অবস্থানকে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে অভিহিত করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বিশিষ্টজনের অনেকে ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণাকে ‘মোনাফেকি বক্তব্য’ বলেও অভিহিত করেছেন। এবারের নির্বাচনে দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াত-বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করছে। অন্তত ২১টি আসনে ২০ দল ও ঐক্যফ্রন্টের একক প্রার্থী হচ্ছে জামায়াত নেতারা। যেখানে ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ স ম আবদুর রব এমনকি কাদের সিদ্দিকীসহ ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের প্রার্থী হচ্ছেন জামায়াত নেতারা। যেখানে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপিসহ ২০ দল সমর্থন দিয়েছে জামায়াতকে। কক্সবাজারের একটি আসনে আইনী জটিলতায় ধানের শীষ প্রতীক না পেলেও জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আজাদ জোটের একক প্রার্থী হয়ে লড়ছেন আপেল প্রতীক নিয়ে। এখানেই শেষ নয়, নির্বাচনে জামায়াত নেতাদের মধ্যে আছে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের ডজনখানেক সন্তান। বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীদের মধ্যে আছেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ৮ প্রার্থী; যাদের কারো কারো বিচারও চলছে। কারও কারও বিষয়ে তদন্ত চলছে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এমন প্রেক্ষাপটের মধ্যেই বিএনপির শীর্ষ নেতাদের একজন নজরুল ইসলাম বলেছেন, জামায়াতের মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধা আছে। জামায়াতের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে দুদিন আগেও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তোপের মুখে পড়েছেন ঐক্যের বড় নেতা ড. কামাল হোসেন। যে ঘটনায় চলছে প্রতিবাদ। ঠিক এমন অবস্থায় সোমবার নির্বাচনী ইশহেতারে ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলন করে ৩৫ দফার প্রতিশ্রুতিসহ ঐক্যফ্রন্টের এই ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। যেখানে যুক্ত আছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু। ইশতেহারের ৩৫ দফার মধ্যে ৩২ দফায় ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা’ অংশে বলা হয়, ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চলমান থাকবে, মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনা নিয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলা হবে, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’দের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হবে। এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের রায়ে পর আপীল শুনানি শেষে জামায়াতের পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির একজনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। প্রতিটি রায়ের পর হরতাল ডেকে ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছে জামায়াতকর্মীরা। তাদের সঙ্গ ছাড়ার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বিএনপি নেতারা উল্টো যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করেছেন। ক্ষমতায় গেলে এ ধরনের বিচার বন্ধ করার হুমকিও দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। একাত্তরে বাংলাদেশের বিরোধিতায় যুদ্ধাপরাধে নেতৃত্ব দেয়া জামায়াতের নেতারা বিএনপির সরকারে মন্ত্রিত্বও পেয়েছিলেন, যাকে শহীদের প্রতি ‘চপেটাঘাত’ হিসেবে বর্ণনা করা হয় যুদ্ধাপরাধের এক মামলার রায়ে। ড. কামাল হোসেন ঐক্য গঠনের প্রথম ঘোষণায় সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে কোন ‘বৃহত্তর ঐক্যে’ তিনি যাবেন না। আজীবন জামায়াত, যুদ্ধাপরীদের বিরুদ্ধে ছিলাম। থাকব। জামায়াত থাকলে আমরা নেই। কিন্তু নির্বাচনের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় দেখা গেল, নিবন্ধন হারানোয় জামায়াতের অন্তত ২২ প্রার্থীকে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে। তবে প্রতীক ধানের শীষ পায়নি একজন। নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলমান রাখাকে ‘জাতির সঙ্গে তামাশা’ হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু কি ভাবছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা? ইসলামি চিন্তাবিদ যারা যুদ্ধাপরাীদের বিচারে সক্রিয় তারাই কি বলছেন? একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ড. কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘোষণাকে ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় তামাশা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করবেন আবার বলবেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান রাখবেন; এটা কেবল তামাশা নয়, প্রতারণাও। ড. কামাল হোসেনদের মূল নেত্রী হচ্ছেন খালেদা জিয়া। তিনি ৩ বছর আগেও বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেবেন। তার কাছে যুদ্ধাপরাধী হচ্ছেন যারা বিচার চান। তিনি হচ্ছেন ড. কামালদের নেত্রী। তাই আমি মনে করি, ড. কামালরা আসলে আমাদের মতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যারা চান তাদের বিচারের কথা বলতে পারেন। তিনি আরও বলেন, ড. কামাল আসলে জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী বলছিলেন, এ ধরনের অবস্থান হচ্ছে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। এটা জনগণের সঙ্গেই প্রতারণা। যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন বলে যার এ ধরনের বক্তব্য জনগণের কাছে পরিষ্কার করেছে তারা আসলে কি চান? সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী হতাশা প্রকাশ করে বলছিলেন, তারা ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান রাখবেনÑএ বক্তব্য তো স্ববিরোধী হয়ে গেল। তাদের প্র্যাকটিসের সঙ্গে তাদের রোডম্যাপের কোন মিল নেই। আমরা দেখতে পারছি না। তাহলে তারা কিভাবে এ বিচারটা করবেন, তাও বলতে পারতেন। এভাবে অবস্থান নিলে তো জনগণের আস্থা পাওয়ার কারণ নেই। প্রগতিশীল নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠন সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এটা হচ্ছে বছরের শ্রেষ্ঠ তামাশা। দ-িত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কামাল হোসেনের জামাতা ডেভিড বার্গম্যানের তৎপরতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, কাদের নিয়ে তিনি (কামাল) বিচার করবেন? স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা হানাদার বাহিনীর দোসর ছিল তাদের সন্তানদের নিয়ে? আর তার মেয়ের স্বামী ডেভিড বার্গম্যানের কথা কী বলব, যখন ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছিল তখন তিনি বিদেশীদের সঙ্গে লবিং করছিলেন তাদের বাঁচানোর জন্য। এসব খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। জামায়াতসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আছেন ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগার গ্র্যান্ড ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ। তিনি বলছিলেন, তাদের এ বক্তব্য হচ্ছে সোনার পাথর বাটি। যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে একাকার হয়ে নির্বাচন করবেন আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন, এটা তো মিথ্যা। এটা আসলে ‘সোনার পাথর বাটি’। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণাকে ‘মোনাফেকি বক্তব্য’ বলেও অভিহিত করেছেন আরেক ইসলামী চিন্তাবিদ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান। তিনি বলেন, এটা হচ্ছে ড. কামালদের প্রতারণা। একাত্তরের জামায়াত যেমন ইসলামের কথা বলে গণহত্যা চালিয়েছে। প্রতারণা করেছে। এখন মিথ্যা কথা বলে বিএনপি ও ড. কামালরা এই অপরাধই করছেন। এটা মোনাফেকি অবস্থান ছাড়া কিছু নয়। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনের ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের’ সভাপতি মোঃ হুমায়ুন কবির বলেছেন, জামায়াতনির্ভর ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। ড. কামাল হোসেন, আ স ম আব্দুর রব ও কাদের সিদ্দিকীর মতো ব্যক্তিরা স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও নিবন্ধন হারানো দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচনে অংশ নিয়ে শুধু যে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকাও আজ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। তরুণ প্রজন্ম আজ জানতে চায় ড. কামাল হোসেন, আ স ম আব্দুর রব ও কাদের সিদ্দিকীর মতো ব্যক্তিরা ক্ষমতার লোভে আর কতটা নীচে নামবেন?
×