ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সম্ভাবনার বাংলাদেশ ২;###;’২১ সালের মধ্যে ৫ হাজার কোটি ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ

পাদুকায় বাংলাদেশের বিশ্বজয়, বিশ্বের বড় বড় শোরুমে

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮

পাদুকায় বাংলাদেশের বিশ্বজয়, বিশ্বের বড় বড় শোরুমে

রহিম শেখ ॥ একটি খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচএ্যান্ডএম, অন্যটি বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের জুতা বিক্রেতা ডাইচম্যান। বিশ্বে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ৬ হাজার ৪শ’ শো-রুম রয়েছে। এসব শো-রুমে ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশী জুতা। শুধু এইচএ্যান্ডএম কিংবা ডাইচম্যান নয়, নোভি, নাইকি, এ্যাডিডাস, হুগো বস, টিম্বারল্যান্ড, পুমা, ডেকাতেলান, নর্থ ফেস, বিডটজেডডট মোডা, হিউম্যানিক, রিগ্যাল ও পাটাগোনিয়া ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশী কোম্পানি এ্যাপেক্স, বেঙ্গল, বে আর্থ, ফরচুনা, জিল ওয়্যার ও ল্যান্ডমার্ক ফুটওয়্যারের কারখানায়। এভাবেই গত সাত বছরে জুতা রফতানি করে দেশের রফতানি আয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু আমদানি নয়, বাংলাদেশে কারখানা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এ্যাডিডাস, নাইকির মতো বড় বড় কোম্পানি। এদিকে প্রতিবছরই বাড়ছে চামড়াজাত পণ্য রফতানি। সরকার ’২১ সালের মধ্যে ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার চামড়া খাতের রফতানি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৪শ’ কোটি ডলার। ফলে আগামী দু’বছরে এ খাত থেকে আরও ৬শ’ কোটি ডলার আয় বাড়াতে হবে। উদ্যোক্তাদের মতে, পৃথিবীর প্রায় সব বড় বড় দেশে বাংলাদেশী চামড়াজাত পণ্য রফতানি হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পাদুকার বিশ্বজয় ঘটেছে। তবে এ খাতে বেশ কিছু সমস্যাও আছে। এসবের সমাধান করতে পারলে সরকারের রফতানি আয়ের কৌশল অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড় বাজার ইতালি। এর পরই যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, স্পেন ও ফ্রান্স। এর বাইরে সম্প্রতি জাপান, জামার্নি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডে সীমিত আকারে রফতানি হচ্ছে। এখন ভারত, নেপাল, চীন, অস্ট্রেলিয়ার পাইকারি ক্রেতারাও বাংলাদেশ থেকে চামড়াজাত পণ্য নিচ্ছেন। তবে উদ্যোক্তারা মনে করছেন, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের বাজারে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ জন্য উল্লিখিত বাজারের বাইরে নিজ উদ্যোগে নতুন বাজারের সম্ভাবনা হিসেবে উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, রাশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশে নতুন বাজার অনুসন্ধান করা হচ্ছে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে মানিব্যাগ, নারীদের পার্টস, পুরুষদের অফিসিয়াল ব্যাগ, ট্রাভেল ব্যাগ, কার্ড হোল্ডার, ওয়ালেট, বেল্ট, চাবির রিং, জুতা, জ্যাকেট, হাত ও পা মোজা, কলমদানিসহ অন্যন্যা চামড়াজাত পণ্য রফতানি হচ্ছে। এর সঙ্গে আরও নতুন পণ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চামড়াজাত পণ্যের মধ্যে ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছে জুতা। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ব্র্যান্ডের জুতার শোরুমে স্থান পাচ্ছে বাংলাদেশী তৈরি জুতা। শুধু চামড়ারই নয়, রয়েছে সিনথেটিক জুতাও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এইচএ্যান্ডএম ও নোভির মতো ব্র্যান্ডের জুতা প্রস্তুত করে বাংলাদেশের ফরচুনা ফুটওয়্যার। চট্টগ্রামে কোরিয়ান কোম্পানির ইয়াঙ্গুনে তৈরি হচ্ছে টিম্বারল্যান্ড, পুমা, ডেকাতেলান, নর্থ ফেস ও পাটাগোনিয়া ব্র্যান্ডের জুতা। বিডটজেডডট মোডা, হিউম্যানিক, রিগ্যালের ব্র্যান্ডের জন্য জুতা রফতানি করছে লেদারেক্স। এফবি ফুটওয়্যারে তৈরি হচ্ছে এনা, এ্যারোমা, টোকার্স, এইচএ্যান্ডএম, তামারিজসহ আরও কয়েকটি নামী ব্র্যান্ডের জুতা। এ ছাড়া রফতানিকারক জুতা কারখানার মধ্যে বে আর্থ, এবিসি, আকিজ, এ্যালায়েন্স, হ্যামকো, জেনিস, লালমাই, ম্যাফ, পতেঙ্গা, রিমেক্স, রয়্যাল, স্কারপি ই মোদা, সোনালি আঁশ ইন্ডাস্ট্রি, পিকার্ড ও বিএজি ফুটওয়্যার অন্যতম। জুতা প্রস্তুতকারক কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইতালি, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম ও ফিনল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশে জুতা রফতানি হচ্ছে। লেদারগুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ১১৫টি রফতানিমুখী কারখানায় সিনথেটিক ও চামড়ার জুতা তৈরি হচ্ছে। প্রতিবছর জুতা শিল্পে বিনিয়োগও বাড়ছে, গড়ে উঠছে নতুন কারখানা। বিদেশীরাও এই শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছেন। নিরাপত্তার বিষয়টি ঠিক থাকলে বিদেশী উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরবর্তী গন্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, জুতা কারখানার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, তৈরির যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে আসছে সরকার। এক লাখ ডলারের বেশি রফতানিতে সরকার ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। পাশাপাশি আছে ট্যাক্স হলিডে সুবিধা। জুতার ইনসোল, ব্যবহৃত ছোটখাটো অন্যান্য সরঞ্জাম আমদানিতেও শুল্ক কমানো হয়েছে। আগে চীন ও ভারত থেকে জুতার বক্স আমদানি করা হলেও সে নির্ভরতাও কিছুটা কমেছে। বর্তমানে নিক্সন, প্যারাগনসহ কয়েকটি দেশী প্রতিষ্ঠান জুতার বাক্স তৈরি করছে। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন মাহমুদ মাহিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের জুতা বিশ্ববাজারে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছে এটা ঠিক, তবে সামগ্রিক কিছু নেতিবাচক ধারণাও আছে। সব মিলিয়ে আমরা এখন ট্রানজিট পয়েন্টে আছি। সমস্যগুলো কাটিয়ে উঠলেই বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে নেতৃত্ব দেবে। জুতা রফতানি বাড়ছে, তবে আরও বাড়াতে অবকাঠামোগত ও কৌশলগত উন্নয়ন জরুরী। জানা মতে, পাঁচ বছর আগেও আন্তর্জাতিক চামড়ার বাজারের শতকরা ৫৫ ভাগ সরবরাহ হতো চীন থেকে। কিন্তু এ হিসেবে পরিবর্তন এসেছে। চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী দেশে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে উৎপাদন খরচ। ওসব দেশের পণ্যের দাম বাড়লেও বাংলাদেশে উৎপাদিত চামড়াজাত এবং প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দাম বাড়েনি। ওসব দেশে কারখানা আছে- এমন অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নতুন বিনিয়োগের সন্ধান করছে। তারা উৎপাদন খরচ কম হবে এমন দেশে গড়ে তুলতে চায় চামড়া শিল্পের নতুন কারখানা। বাংলাদেশে এখনও বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় শ্রমিকের মজুরি কম। তাই কম খরচে পণ্য উৎপাদনে এ্যাডিডাস, নাইকির মতো বড় বড় কোম্পানি বাংলাদেশে এসে ভিড় জমিয়েছে। এখানে কারখানা নির্মাণে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তারা। এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণেও চীনের ওপর চামড়া খাতের নির্ভরশীলতা কমাতে তৎপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা এবং তাদের সহযোগী দেশগুলো। ওসব দেশের পছন্দের তালিকার শীর্ষেই বাংলাদেশ। এভাবে গত দুই বছর থেকে চীনের বিকল্প বাজার হিসেবে বিশ্ববাণিজ্যে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক শিল্পের মতো বাংলাদেশও চামড়া খাতে নেতৃত্ব দেবে বিশ্ববাজারে। চামড়া খাতে বাংলাদেশে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান মঞ্জুর এলাহী বলেন, বাংলাদেশে পৃথিবীর যেকোন দেশের তুলনায় কম খরচে চামড়া খাতে উৎপাদন করা সম্ভব। চামড়া খাতের প্রধান কাঁচামাল কাঁচা চামড়ার প্রচুর সরবরাহ রয়েছে এখানে। গুণগত মানের দিক থেকেও তা সেরা। তাই চীনসহ অন্যান্য দেশের পণ্যের দাম বাড়ায় সবাই এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। সরকারের সহযোগিতা পেলে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ চামড়া খাতে আন্তর্জাতিক বাজারে শীর্ষ দেশ হিসেবে অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারবে। বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্য মতে, প্রতিবছর দেশে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া উৎপাদিত হয়। জুতা ও অন্যান্য পণ্য তৈরিতে উৎপাদিত সেই চামড়ার মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। জুতার বিশ্ববাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ব্যবহারকারীদের ৫৫/৬০ শতাংশই সিনথেটিকের জুতা পরেন। বিষয়টি মাথায় এনে বাংলাদেশী কারখানার মালিকরা সিনথেটিক জুতা তৈরির দিকে দৃষ্টি দেন। ওসব কারখানায় এখন নামী-দামী ব্র্যান্ডের সিনথেটিক জুতা তৈরি হচ্ছে। তাদের অর্ডারও ভাল। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়া রফতানি করেছে ১৮ কোটি মার্কিন ডলার, চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয় প্রায় ৩৪ কোটি ডলার এবং জুতা রফতানি হয়েছে প্রায় ৫৭ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া রফতানি হয়েছে ২৩ কোটি মার্কিন ডলার, চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয় প্রায় ৪৬ কোটি ডলার এবং জুতা রফতানি হয়েছে প্রায় ৫৩ কোটি ডলার। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়া রফতানি করেছে ১৮ কোটি ডলারের, চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয় প্রায় ৩৪ কোটি ডলার এবং জুতা রফতানি হয়েছে প্রায় ৫৭ কোটি ডলার। এদিকে সরকার ’২১ সালের মধ্যে ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার চামড়াখাতের রফতানি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ৪ হাজার ৪শ’ কোটি ডলার। ফলে আগামী দু’বছরে এ খাত থেকে আরও ৬শ’ কোটি ডলার আয় বাড়াতে হবে।
×