ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভোট প্রার্থনায় সরগরম শহর বন্দর, প্রচারে মাইক

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮

ভোট প্রার্থনায় সরগরম শহর বন্দর, প্রচারে মাইক

সমুদ্র হক ॥ প্রথম দৃশ্য : হ্যালো হ্যালো হ্যালো.....মাইক টেস্ট-ওয়ান টু থ্রি ফোর ফাইভ সিক্স হ্যালো হ্যালো হ্যালো...। দ্বিতীয় দৃশ্য : (মাইক ভাড়ার দোকনি ও ভাড়া নেয়ার ব্যক্তির কথোপকথন) : ভাই দিনে কয় ঘণ্টার জন্য ভাড়া নেবেন। মাইক্রোফোনে কথা কি আপনি বলবেন! না রেকর্ড করে নেবেন। প্রতিবার প্রচারে কত মিনিটের জন্য কী কথা রেকর্ড করে নেবেন। কথা কি পুরুষ কণ্ঠে নেবেন না নারী-পুরুষ উভয় কণ্ঠে রেকর্ড করে নেবেন! কথার মধ্যে ব্যাক গ্রাউন্ডে হালকা সুমধুর সঙ্গীত নেবেন। কথা শেষ হওয়ার পর ব্যান্ডের কোন সাউন্ড নেবেন! প্রচার শুরুর আগে ও পরে কোন জিঙ্গেল (এক ধরনের কথা ও সুর) নেবেন। তারপর দেনা পাওনার হিসাব-নিকাশ। তৃতীয় দৃশ্য (যা শুরু হতে যাচ্ছে) : একটি মিউজিক। ভাইসব...ভাইসব.... আসন্ন নির্বাচনে আপনাদের প্রিয় নেতা, গরিবের বন্ধু, দেশদরদী (বিশেষণের পর বিশেষণ) অমুক ভাইকে ‘তমুক’ মার্কায় ভোট দিয়ে জনগণের সেবা করার সুযোগ দিন। এরপর (স্লোগান) আরে “তোমার ভাই আমার ভাই, .......মার্কা কি মার্কা....মার্কা।.....ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র... ভাইবোনদের বলে যাই... .. মা বোনদের বলে যাই...। আর মাত্র কয়েক দিন.... মার্কায় ভোট দিন।” এরপর কোন চটুল গানের প্যারোডিতে প্রার্থীর পরিচিতি ও ভোট প্রার্থনা। উল্লিখিত দৃশ্যগুলোর যথার্থ বাস্তবায়ন এখন চলছে দিনের বা রাতের অধিকাংশ সময়। নগরী, শহর ও উপজেলার শব্দ যন্ত্রের দোকানগুলোতে মাইকের বেচাকেনা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। প্রার্থীর কর্মী সমর্থকরাই এই কাজগুলো করছেন। প্রতিদিন কত মাইকে কত ঘণ্টা প্রচারে কি দর। কথা রেকর্ড করার খরচ কত! জিঙ্গেল ও মিউজিকসহ দ্বৈত কণ্ঠে রেকর্ডিংয়ের ব্যয় কত... সবই করেন কর্মী-সমর্থকেরা। প্রার্থীগণের নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রমের পুরাতন ও ডিজিটাল যুগের সংমিশ্রণে বহুমুখী আয়োজনের সার্থক বাস্তবায়ন হচ্ছে এখন। নির্বাচনের আগের এই সময়টায় দিন যাচ্ছে ¯্রােতের মতো। প্রার্থী, কর্মী, সমর্থক সবাই চরম ব্যস্ত। বগুড়ার চেলোপাড়ার মাইকের দোকানি রাজু আহমেদ বললেন, প্রার্থিতা প্রশ্নে যারা একেবারে নিশ্চিত ছিলেন তাদের কর্মীরাই আগাম অর্ডার দিয়ে গেছেন। তার মতে, এবারের নির্বাচনে শহরাঞ্চলে মাইকের প্রচার তেমন হচ্ছে না। তবে মাঠ পর্যায়ে অর্থাৎ গ্রামের দিকে মাইকের প্রচার চলছে হরদম। তারপরও কথা থেকেই যায় তা হলো : সেদিনের টিনের চোঙ্গাও মাইকের রূপান্তর ঘটেছে। বর্তমানে ডিজিটাল হ্যান্ড মাইক চলে প্রোর্টেবল ব্যাটারিতে। হ্যান্ড মাইকের সঙ্গে পোর্টেবল সাউন্ডবক্স ও স্পীকার আছে। শব্দ বাড়নোর ব্যবস্থাও আছে। এ ধরনের হ্যান্ড মাইকের বেচাকেনা বেড়েছে। তবে এই হ্যান্ড মাইক বেশি ব্যবহার করছেন প্রার্থীগণ। গৃহস্থ ও কৃষকের উঠানে গিয়ে তারা স্বল্প সময়ের জন্য বক্তব্য রাখছেন। এই চোঙ্গা কমে যাওয়ায় ভোটের সময়ে যেসব নানা ধরনের সুরেলা কথা অতীতে শোনা যেত তাও কমে গেছে এখন। সোনাতলার রানীরপাড়া গ্রামের প্রবীণ আব্বাস আলী (৬৬) বললেন, আগে শীত মৌসুমে নির্বাচন হলে শীতের রাতে চোঙ্গা মাইকে কোন প্রার্থীর পক্ষে সুর করে গাইতেন “ভোট চাই ভোট চাই ভোট চাই ভাই ভোট দিলে যাহা চাবে তাহা পাবে ভাই...”। এখন আধুনিক হ্যান্ড মাইকে সুরেলা কথা বলা যায় না। স্পীকারে কেমন যেন খসখস আওয়াজ হয়। চোঙ্গায় কথা বলাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় চোঙ্গা ফুঁকানো। বর্তমানে মাইকের প্রচারে শব্দযন্ত্রের রকমফের ঘটেছে। আগে একটি মাইক এ্যাম্পিøফায়ার ও এ্যাসিড সেল ব্যাটারির সঙ্গে যুক্ত করে কোন ব্যক্তি মাইক্রোফোনে প্রচারের কথা বলতেন। প্রযুক্তির অগ্রসরতায় এখন অডিও রেকর্ডিং করে পেনড্রাইভ বা মেমোরিকার্ডে বা চিপসে নিয়ে তা এ্যাপ্লিফায়ারের ইউএসবি পোর্ট, এসডি কার্ড পয়েন্টে লাগিয়ে দিলে প্লাগ এ্যান্ড প্লে ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাজতে শুরু করে। ইচ্ছেমতো অন-অফ করা যায়। এবারের নির্বাচনী প্রচারে প্রযুক্তির এই ব্যবস্থাই বেশি হবে। প্রার্থীর পরিচিতি ও ভোট চাওয়ার কৌশলের অডিও রেকর্ডিংয়ে নানা বৈচিত্র্য আসবে। যেমন শব্দের মিল রেখে সুরের ব্যঞ্জনায় (জিঙ্গেল) ভোটারদের মনে দাগ কাটে এমন কথা বলা হবে। এ জন্য যাদের কণ্ঠ সুন্দর তারা প্রচারের অডিও রেকর্ডে অগ্রাধিকার পাবে। বগুড়ার মাইক সার্ভিসের মালিক উত্তম বললেন, দ্বৈত কণ্ঠে (নারী ও পুরুষ) ভোটের প্রচার শৈল্পিক হয়। এর সঙ্গে যদি সুরেলা সুর বাজনো হয় তাহলে শ্রোতাদের আকর্ষণ করে। বগুড়া সম্মিলিত জোটের দফতর সম্পাদক এইচ আলিম ও সাংস্কৃতিক কর্মী আবৃত্তিকার রায়হানা তাবাসসুম উত্তমা বললেন, নাট্যাঙ্গনের অনেক শিল্পী এবারের নির্বাচনে সম্মানির বিনিময়ে কণ্ঠ দিয়েছেন, এখনও কেউ কেউ দিচ্ছেন। এদিকে এবারের নির্বাচনী প্রচারে ভারচুয়াল (পরাবাস্তব) লাইফে ধুন্দুমার প্রচার চলছে। বিশেষ করে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুক ও ইউটিউব। প্রার্থীগণের সমর্থক ও কর্মীরাও ব্যতিক্রমী ও সৃষ্টিশীল প্রচারে দিনরাত মাঠে কাজ করছেন। পথনাটক ও নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে অবিরাম চলছে প্রচারের আয়োজন। অনেকেই ভিডিও রেকর্ডিং করে মাল্টিমিডিয়ায় প্রদর্শনেরও ব্যবস্থা করেছেন। তবে এ ধরনের কার্যক্রম শহরাঞ্চলেই বেশি দেখা যাচ্ছে। সভাগুলোতে মাইকের পাশাপশি স্টেরিও সাউন্ড সিস্টেমও থাকছে দেদার।
×