ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বিজয়ের অকথিত অজানা অধ্যায়

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বিজয়ের অকথিত অজানা অধ্যায়

কোন এক ডিসেম্বরে আমি ফোন করেছিলাম ব্রুস উইলসনকে। ব্রুস তখন লন্ডনের এক নার্সিং হোমে। রোগশয্যায় থাকলেও তাঁর রসবোধের কমতি ছিল না। নাম শুনে পদবী শুনে বললেন, তুমিতো হিন্দু বৈদ্য সম্প্রদায়ের। আমি চমকে উঠেছিলাম। এসব পরিচয় দেয়া এক ধরনের তুচ্ছতা তাও জানেন তিনি। আমার ফোন করার কারণ ছিল এই মানুষটি ষোলো ডিসেম্বরে রেসকোর্স ময়দানে হাজির ছিলেন। যুদ্ধের পুরো সময়টা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাটানো ভদ্রলোক আত্মসমর্পণের খবর কাভার করতে গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে। মেলবোর্ন এজ পত্রিকার সাংবাদিক ব্রুস উইলসন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিকও বটে। যিনি নয় মাস ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে আমাদের যোদ্ধাদের সঙ্গ দিয়েছিলেন। তাঁকে যোদ্ধা বলার বিকল্প কোথায়? তিনি আমাকে এমন কিছু ঘটনার কথা বলেছিলেন যা ছিল অশ্রুত। কাদের সিদ্দিকী তখনো বিতর্কিত কেউ নন। অথচ এই ভদ্রলোক আলাপে বারবার তার কথা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। একসময় আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন? হাসতে আসতে জানিয়েছিলেন ব্রুস অতি আবেগের যোদ্ধা বা অতি উৎসাহী কাউকে তিনি তেমন গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি কেন তিনি তা বলেছিলেন। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে তিনি এ কে খন্দকারের কথাও বলেছিলেন। তাঁর মতে এই মানুষটিই জানেন সত্যিকার ইতিহাস। যিনি সে সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলেন সেই মাঠে। জানি না আজ ব্রুস উইলসন বেঁচে আছেন কি না। মনে হয় না তিনি আর দুনিয়ায় আছেন। থাকলে তাঁকে একটা কথা বলতাম, সেই এ কে খন্দকারও আজ পথভ্রষ্ট। জানি না কোন কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লিজেন্ডরা এমন পথ হারিয়ে ফেলেন। অথচ একাত্তরের সেই দিনগুলোতে জাতি ঝলসে উঠেছিল খাপ খোলা তরবারির মতো। আমাদের ভেতর তেমন কোন বিভেদ বা অনৈক্য ছিল না। ধীরে ধীরে আমরা এমন এক অন্ধকার জগতে প্রবেশ করেছি, যেখানে বন্ধু শত্রু একাকার। যেখানে আমরা সবাই আজ কোন না কোনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বিজয় দিবসে আমি বালক ছিলাম। কিন্তু আমার বুদ্ধি বা বোঝার রাস্তা তখন খুলে গিয়েছে। একথা তাই নিশ্চিন্তে বলতে পারি, বাঙালী আজ ভাবতেও পারবে না কেমন ছিল সে সময়ের জনমত। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি বঙ্গবন্ধুকে কেউ বিতর্কিত করতে পারে। তাজউদ্দীন আহমেদের মতো নেতা চলে যাবেন প্রায় বিস্মৃতির আড়ালে। অথচ সেটাই সত্য। আরও নির্মম এই, খালেদা জিয়া একজন সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রী হয়েও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর করুণ দিনে নিজের জন্মদিনের কেক কাটতে পারেন। ভাবিনি একজন সৈনিকের ঘোষণা উঠে আসবে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে। এরপর আমাদের অতীতকে টেনে হিঁচড়ে নামানো হবে অন্ধকারের অতল গর্ভে। কিন্তু এটা মানতেই হবে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্ত। শেখ হাসিনার পরপর দু’দফা দেশ শাসনে মিডিয়া ও দেশজুড়ে অবারিত স্বাধীনতার ইতিহাস দেখার পর, জানার পরও অন্ধকার যায়নি। কেন? তবে কি এটাই মানতে হবে, আমাদের ভেতর কোথাও কোন বড় ধরনের ত্রুটি ছিল? ইা, আমরা আসলে এই বিজয়ের এমন পরিণতি চাইনি? এখন এই প্রশ্নের উত্তর জানার সময় এসেছে। কোন জাতি সারা জীবন তার ইতিহাস নিয়ে যুদ্ধ করতে পারে না। তার সুবর্ণ অতীত বা গৌরবকে কেবল মুষ্টিমেয় মানুষ কলংকিত করেছে, এটা এখন মানা মুশকিল। ইতোমধ্যে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশের লেজও খসে পড়েছে। গজিয়েছে নতুন লেজ। যে লেজে পাকি গন্ধ। যে সব আচরণে দেশবিরোধিতা প্রকট। তাই জানা দরকার এ কি পাকিস্তান ভাঙার মনোবেদনা? না, এর পেছনে আছে অন্য কোন ইন্ধন। অনেকে বলেন, ভারত যেহেতু হিন্দুপ্রধান দেশ, তার কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয় মেনে নেয়া বুকে শেলের মতো বিঁধে। কারও কারো মতে, দেশ স্বাধীনের পর ভারতের ভূমিকা দায়ী। অথচ এর একটিও যুক্তিতে টেকে না। কারণ দেশ স্বাধীনের পর ভারত যদি আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরায়, তা হয়েছে আমাদের দুর্বলতায়। রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্য আর অসমঝোতার জন্য আমরা কোন বিষয়ে একমত হতে পারি না। সেখানে ভারত একা না, মিয়ানমারও আমাদের ভুগিয়েছে। ভোগায়। কিন্তু তার বেলায় তো এমন উগ্রতা নেই আমাদের। মনস্তত্ব কি বলে জানি না,আমার ধারণা সাম্প্রদায়িকতা একটা বড় বিষয় হলেও এর পেছনে আছে ইন্ধন আর ষড়যন্ত্র। যা বিনা উস্কানিতেও দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বয়ে চলেছে ধমনীতে। এবারের নির্বাচনের আগে আমরা দেখছি উন্নয়ন অগ্রগতির পরও মানুষ কোন না কোন কারণে মুক্তিযুদ্ধকে সেভাবে আমলে নিতে পারছে না। নিলে জয়ের পথজয় বাংলার পথ কেউ আটকাতে পারত না। আজকাল গণতন্ত্র আর মুক্তচিন্তার নামে বাঙালী কোন জগতে বসবাস করে বা তার মনে কি আছে, জানা দুস্কর। একদিকে সংস্কার আরেকদিকে বাড়াবাড়ি। সঙ্গে জুটেছে বয়স হয়ে যাওয়া প্রবীণ নেতাদের ইচ্ছাঅনিচ্ছা। সব মিলিয়ে উইলসনের বাংলাদেশ আমাদের এই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে শায়িত বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ডের বাংলাদেশ আগের জায়গায় নেই। দেশে এখন আওয়ামী লীগ দেশ শাসনে থাকায় বিজয় দিবস ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। অথচ দেশের বাইরে তার ব্যবহার সীমিত। যে উৎসবটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার, যার উদযাপনে বাঙালীর ঘরে ঘরে আনন্দ আর বিজয় ধরা দেবার কথা, তা হয় নিতান্ত দায়সারা গোছের। এতেই প্রমাণিত আমরা বিজয় দিবস মানি বটে। বিজয় তেমন করে ধারণ করি না। করলে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস নিয়ে সকল বিতর্কের অবসান ঘটতো। বড় মায়ার দেশ আমাদের। সমাজে এখনও মানুষের মনে মায়া আর ভালবাসাই মূখ্য। দিন দিন নানা ঘটনায় টাল খাওয়ার পরও আমরা দেশপ্রেমী। আর কোন জাতিকে আমি দুচোখের জলে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে দেখি না। দেখি না ছোট একটি দেশের জন্য এত বড় বড় বুকের মানুষদের পাগলামি। আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু দেশপ্রেমের কারণে ভাল করে সংসারও করতে পারেননি। আমাদের নেতা তাজউদ্দীন কিংবা সৈয়দ নজরুলেরা সেই কবে প্রাণ দিয়ে গেছেন। যখন তাদের পরিবারে সময় দেয়ার কথা, তখন তাঁরা পরপারে। আমাদের তরুণেরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন। আমাদের যুবকরা স্বাধীনতার জন্য এক কাপড়ে দেশত্যাগ করেছিলেন। তারা জানতেন কি হতে পারে। কিভাবে তারা পাক বাহিনীর মতো শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বেন। তারপরও কেউ থেমে থাকেননি। বীরাঙ্গনারা ইজ্জত দিলেও সম্মান লুণ্ঠিত হতে দেননি। এই রক্তভেজা মাটি কারও দয়ার দান নয়। স্বাধীনতা আমরা ছিনিয়ে নিয়েছি। আমাদের মুক্তি নিছক কোন কাগুজে চুক্তিতে আসেনি। হায়েনার মুখ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা আনতে জানা জাতি সামান্য কারণে তুচ্ছ স্বার্থে দেশের বিজয়কে অবহেলা করবে, এটা মানি না।
×