ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপির ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধী বিচার নিয়ে কোন কথা নেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮

বিএনপির ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধী বিচার নিয়ে কোন কথা নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত রাখার কথা থাকলেও এ বিষয়ে বিএনপির ইশতেহারে কিছু উল্লেখ নেই। তবে ক্ষমতায় গেলে সংবিধানে গণভোট পুনপ্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পীকার নিয়োগ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে নির্বাচন কালীন সরকার, ন্যায়পাল নিয়োগ, চাকরি ক্ষেত্রে বয়সসীমা না রাখা, মন্ত্রী, এমপি ও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ, বিচার ব্যবস্থা সংস্কারে জুডিসিয়াল কমিশন গঠন, সিটি গবর্নমেন্ট চালু করা এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সুপ্রীমকোর্টের হাতে ন্যস্ত করার অঙ্গীকারসহ নির্বাচনী ইশতেহারে ১৯ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় গুলশানের লেকশোর হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির ইশতেহার ঘোষণা করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে ইশতেহার ঘোষণার সময় তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার পক্ষে আমি নির্বাচনী ইশতেহার দেশবাসীর সামনে ঘোষণা করছি। তিনি বলেন, প্রতিহিংসামুক্ত ও সহমর্মী বাংলাদেশ গড়ে তোলাই বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য । অন্য উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে-পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিধান করা। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচনের দিনের গণতন্ত্রকে নিত্যদিনের অনুশীলনে পরিণত করা, মন্ত্রিসভাসহ প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা, সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, জাতীয় সংসদকে সকল জাতীয় কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে ভবিষ্যতমুখী এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন এক সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাতে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা। এই কমিশনের সদস্য থাকবেন সংসদে সরকারী দলের নেতা, বিরোধী দলের নেতা এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় ব্যক্তিত্ব। একদলীয় শাসনের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে তা নিশ্চিত করা। জাতীয় নেতৃবৃন্দের আপত্তিকর সমালোচনা রোধে সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি উৎসাহিত করা। ব্যক্তির বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং দলীয় আনুগত্যকে বিবেচনায় না নিয়ে কেবলমাত্র সততা, দক্ষতা, মেধা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম ও বিচার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র, পুলিশ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা। র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। র‌্যাবের বর্তমান কাঠামো পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠন করা । এই ব্যাটালিয়ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে। রাষ্ট্রের সকল সামরিক ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা স্ব স্ব চার্টার অনুযায়ী পরিচালিত হবে। দেশরক্ষা, পুলিশ ও আনসার ব্যতীত শর্তসাপেক্ষে সরকারী চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোন সময়সীমা থাকবে না। বিডিআর হত্যাকা-ের এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত সকল অনুসন্ধান রিপোর্ট প্রকাশ এবং অধিকতর তদন্তের উদ্যোগ নেয়া। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। মামলার জট দূর করার জন্য যোগ্য বিচারক নিয়োগ দেয়া এবং এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বর্তমান বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি জুডিসিয়াল কমিশন গঠন করা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়ে বিএনপির ইশতেহারে বলা হয় সরকারে সঙ্গে কোন বিষয়ে মতভিন্নতা থাকলেও কারও কণ্ঠরোধ করা হবে না। অনলাইন মনিটরিং তুলে দিয়ে জনগণকে অবাধে কথা বলার ও মত প্রকাশের সুযোগ দেয়া হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্টসহ সকল প্রকার কালা-কানুন বাতিল করা হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ বাতিল করা হবে। দেশের উন্নয়ন কর্মকা-ের দায়িত্ব থাকবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের হাতে। জেলা পরিষদ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে। পৌর এলাকাগুলোতে সব সেবা সংস্থা মেয়রের অধীনে রেখে সিটি গবর্নমেন্ট চালু করা হবে। জনকল্যাণে প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা এবং স্থানীয় সরকারের স্তর নির্ধারণের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করা হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিএনপির প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) হার ১১ শতাংশে উন্নীত করা, রফতানি প্রবৃদ্ধির হার ৩ গুণ বাড়ানো ও রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করা। শেয়ার মার্কেট, ব্যাংক এবং সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলের অর্থ লুটের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতে যাতে কেউ এমন দুর্নীতি-অনাচার করতে না পারে সেই লক্ষ্যে সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডে যোগ্য, সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া। ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। ইশতেহারে বলা হয় বর্তমানে চলমান কোন উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করা হবে না। তবে মেগা প্রকল্পে ব্যয়ের আড়ালে সংগঠিত দুর্নীতি নিরীক্ষা করে দেখা হবে এবং এজন্য দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। বর্তমান সরকারের শেষ দুই বছরে তড়িঘড়ি করে নেয়া প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করার জন্য কমিটি গঠন করা হবে। দেশে কর্মরত সকল বিদেশীদের ওয়ার্ক পারমিটের আওতায় এনে মুদ্রা পাচার রোধ করা হবে এবং তাদের করের আওতায় আনা হবে। একটি টাস্কফোর্স রেন্টাল পাওয়ার প্রজেক্টের উচ্চ ব্যয়ের কারণ তদন্ত করে দেখবে। সকল মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা এবং মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের নামে দুর্নীতির অবসান ঘটানো হবে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ভাতা বৃদ্ধি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিরক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করে সেসব স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। জাতীয় উন্নয়নে যুব, নারী ও শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে উল্লেখ করে ইশতেহারে বলা হয় ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত তরুণদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ইয়ুথ পার্লামেন্ট গঠন করা হবে। দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য বিএনপি সকল কর্মকা-ে নারী সমাজকে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করবে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে নারীদের উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে। নারী নির্যাতন, যৌতুক প্রথা, এসিড নিক্ষেপ, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, নারী ও শিশু পাচাররোধে কঠোর কার্যকর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শিশু-শ্রম রোধে কার্যকর বাস্তবানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। নারীদের ন্যায়সঙ্গত সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রদান করা হবে। এই লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিদ্যমান আইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে। ইশতেহারে আরও রয়েছে- শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেয়া, বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য জাতীয় টিভিতে একটি পৃথক শিক্ষা চ্যানেল চালু করা, মাদ্রাসা শিক্ষাকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করা, তাদের কারিকুলামে পেশাভিত্তিক ও বৃত্তিমূলক বিভিন্ন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে উপজেলা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে মসজিদের খতিব, ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য সম্মানীভাতা চালু করা, প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধ করার জন্য সকল প্রকার আইনী, প্রতিকারমূলক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে সকল ধরনের ভ্যাট বাতিল, ভ্যাট বিরোধী, কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে আনীত সকল মামলা প্রত্যাহার এবং এসব আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। সরকারী এবং বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরিব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হবে। পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা ব্যবস্থা বিলোপ করা হবে। প্রথম ৩ বছরে দুর্নীতি মুক্ত ব্যবস্থায় মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ২ লাখ মানুষকে সরকারী চাকরি দেয়া হবে। তরুণ দম্পতি ও উদ্যোক্তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ২০ বছর মেয়াদী ঋণ চালু করা হবে। আগামী পাঁচ বছরে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত, যেটাই আগে হবে, শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হবে।
×