ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রফতানি হচ্ছে বিশ্বের ১১৮ দেশে ;###;এক দশকে রফতানি বেড়েছে ১৭৫ শতাংশ

সুদিন ফিরছে সোনালি আঁশের, ২৩৫ রকম বহুমুখী পণ্য ॥ সম্ভাবনার বাংলাদেশ ৩

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮

সুদিন ফিরছে সোনালি আঁশের, ২৩৫ রকম বহুমুখী পণ্য ॥ সম্ভাবনার বাংলাদেশ ৩

রহিম শেখ ॥ বর্তমানে ২৩৫ রকম বহুমুখী পাটপণ্য তৈরি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পণ্য তৈরির জন্য চলছে গবেষণা। সরকার উদ্যোগ নিয়েছে পাটের তৈরি পরিবেশবান্ধব ‘পলিথিন’ উৎপাদনের। ইতোমধ্যে পাটকাঠি থেকে জ্বালানি হিসেবে চারকোল ও এর গুঁড়া থেকে ফটোকপি মেশিনের কালি তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া ভিসকস, কম্পোজিট জুট টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস পণ্য এবং পাট পাতার পানীয় উৎপাদন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এসব পণ্য রফতানি হচ্ছে বিশ্বের ১১৮টি দেশে। আমদানি করছে এইচএনএম, ওয়ালমার্ট, জারার মতো বড় বড় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এভাবেই গত এক দশকে পাট পণ্য রফতানি বেড়েছে ১৭৫ শতাংশ। বিশ্বে উৎপাদিত কাঁচা পাটের ৫৫ শতাংশ উৎপাদন করছে ভারত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবদান ৪০ শতাংশ। তবে পাট খাতের বৈশ্বিক রফতানি আয়ের ৭২ শতাংশই এখন বাংলাদেশের দখলে। বিশ্ববাজারে শুধু পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে ৫০০ বিলিয়ন পিস। এর ১০ শতাংশও দখল করতে পারলে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এমন সাফল্যে যোগ হয়েছে খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে পাটের ‘জিনোম সিকোয়েন্সি’ উন্মোচনের পর বাংলাদেশের পাট ‘আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব’ স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও রফতানি বৃদ্ধিসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে পাট খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নেও এ খাতের রয়েছে অসামান্য অবদান। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে অর্থকরী ফসল হিসেবে পাটই ছিল অন্যতম অবলম্বন। দেশের রফতানি আয়ের সিংহভাগই আসত এ পাট থেকে। দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান বলতে তখন পাটকেন্দ্রিক সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগকেই বোঝানো হতো। পাটের এ দাপট বজায় ছিল আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কালক্রমে হারিয়ে যায় পাটের অর্থনৈতিক সক্ষমতা। এরপর গত কয়েক দশক বিভিন্ন সময়ে সরকার পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে। তবে ধীরে হলেও গত এক দশকে বাংলাদেশের ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাত পাটের সুদিন ক্রমান্বয়ে ফিরতে শুরু করেছে। নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও অগ্রসর হচ্ছে পাট শিল্প। দেশে বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী পাটপণ্যের ব্যবহারও বাড়ছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও তৎপরতায় অভ্যন্তরীণ পর্যায়েও বাড়ছে পাটের ব্যবহার। পাটের সুদিন ফিরে আসার এ সম্ভাবনা দেখা দেয়ার পেছনে কাজ করেছে বেশকিছু উদ্যোগ। বিভিন্ন পণ্য মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাটের দাম নিয়ে কয়েক দশক ধরে কৃষকরা যে হতাশায় ভুগছিলেন, তাতেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বছর দুই ধরে ভাল দাম পাচ্ছেন তারা। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও পাটের বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারীভাবে এ শিল্পের দক্ষ কারিগর তৈরি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করার জন্য ক্রাশ কর্মসূচী চালু হয়েছে। ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও মধ্যপ্রাচ্যের নানামুখী সংকট এবং ভারতের কাঁচা পাট আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তের পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে দেশের পাট শিল্প। সামনের দিনগুলোয় এ সম্ভাবনা আরও অনেক বেশি। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ হচ্ছে। ফলে সেখানেও সুযোগ তৈরি হচ্ছে পাটপণ্যের। সোনালি আঁশ পাটের ব্যবহার বাড়াতে সরকার পাটের তৈরি পরিবেশবান্ধব ‘পলিথিন’ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে পণ্যটির উৎপাদনও শুরু হয়েছে। প্রকল্পটির উদ্ভাবক ড. মোবারক আহম্মেদ খান বলেন, প্রতিবছর ৫০০ বিলিয়ন পিস পলিথিন সারাবিশ্বে ব্যবহৃত হয়। আমাদের এখানে উৎপাদিত পাট দিয়ে শুধু পলিথিন তৈরি করলে মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ করতে পারব। বহুল ব্যবহৃত পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ব্যাপক চাহিদা থাকায় পাটের পলিথিনের প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে বলেও জানিয়েছেন বিজ্ঞানী মোবারক। সম্ভাবনা দেখাচ্ছে পাটের তৈরি ভিসকসও। এইচএনএম, ওয়ালমার্টের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বাংলাদেশের পাট থেকে তৈরি কাপড় ও তৈজসসামগ্রী আমদানি শুরু করেছে। ডেনিম উৎপাদনেও দেশী পাট ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া আগে থেকেই সুতামিশ্রিত কাপড় তৈরিসহ অন্যান্য কাপড় উৎপাদনে পাটকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এর বাইরেও পাটের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে নিবিড় গবেষণা চলছে। বর্তমানে ১১৮টি দেশে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি হচ্ছে। দেশে এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি মিলে প্রায় সাড়ে ৭০০ প্রতিষ্ঠান এখন পাটজাত পণ্য তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। পাটের গতানুগতিক ব্যবহারের ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে পাটজাত পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে কাজ করছে ৫০টির মতো প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১০টি মাঝারি। বাকিগুলো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদামাফিক উন্নত মানের বহুমুখী পাটপণ্য সামগ্রী উৎপাদনে সহায়তা দেয়ার জন্য ২০১০ সাল থেকে ‘জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার’ (জেডিপিসি) কাজ করে যাচ্ছে। পাট সার্বিকভাবে পরিবেশবান্ধব হওয়ার কারণে ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং এ্যাক্ট ২০১০-এর শতভাগ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম জনকণ্ঠকে বলেন, এ খাতের উন্নয়নে একমুখী পদক্ষেপ না নিয়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পাটের বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। প্রচলিত ও দীর্ঘদিনের বাজারের পাশাপাশি নতুন বাজারে পণ্য রফতানি করা হচ্ছে। বেসরকারী খাতকে পাটপণ্য উৎপাদন ও রফতানিতে সব ধরনের সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনকে (বিজেএমসি) স্বচ্ছ ও দক্ষভাবে পরিচালিত করা হচ্ছে। আগের তুলনায় লোকসানও কমে এসেছে। আবার পাটের উৎপাদন বাড়াতে কৃষককে প্রণোদনা ও আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যার সুফল আমরা এখন পাচ্ছি। জানা গেছে, পাটের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশেরও নিচে। আর বাকিটা রফতানি করা হয়। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০। আইনটি বাস্তবায়নের কারণে স্থানীয় বাজারে পাটের বস্তার চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এতে করে বিজেএমসির আওতাধীন মিলগুলোতেও প্রাণ ফিরে এসেছে। আগে প্রতিবছর গড়ে সাড়ে তিন কোটি পিস পাটের বস্তার চাহিদা তৈরি হলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার কোটি পিসে। সামনের দিনগুলোয় তা ছয় কোটি পিসে উন্নীত হতে পারে। এছাড়া আইন বাস্তবায়ন, নতুন নীতি সহায়তা, পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিতকরণ, উৎপাদন ও বিপণনে কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা, বাজার বহুমুখীকরণের উদ্যোগের কারণে মন্দা সহজে ফিরে আসবে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ২৭টি সরকারী এবং প্রায় ১৫০টি বেসরকারী মালিকানাধীন পাটকল রয়েছে। সরকারী মালিকানার কারখানাগুলোর মধ্যে ২১টি সরকারী ব্যবস্থাপনায় এবং দুটি ইজারাদারদের মাধ্যমে চালু রয়েছে। বাকি কারখানাগুলো উৎপাদন ঝুঁকিতে থাকলেও নতুন আইন বাস্তবায়নের কারণে স্বরূপে ফিরে আসতে শুরু করেছে। ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনির মতো পণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহনে পাটের বস্তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যাগ প্রয়োজন হচ্ছে ৬৯ কোটি পিস। অন্যদিকে সামনের দিনগুলোয় শুধু ৫০ কেজি ওজনের বস্তার মাসিক গড় চাহিদা তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে ৫ কোটি ২৫ লাখ। এ পরিমাণ ব্যাগ উৎপাদনে প্রায় ২০-২২ লাখ বেল কাঁচা পাটের প্রয়োজন হবে। পরিসংখ্যান মতো, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮২ লাখ ৪৬ হাজার বেল পাট উৎপাদন হয়েছে। পাট খাতের সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আধুনিক কলাকৌশলের মাধ্যমে উন্নত মানের পাট উৎপাদন, একরপ্রতি ফলন বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করে উন্নত মানের পাট উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলার জন্য কার্যকর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। পাটের একটি বড় অংশ এখন ব্যবহার হচ্ছে জুট স্পিনার্স কারখানাগুলোয়। জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে ৭৭টি সুতা উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে। আগের ৫৪টি পাটসুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত দুই বছরে আরও ২৩টি নতুন পাটসুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। এ ৭৭টি প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সুতা উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ টনে। উৎপাদিত পাটসুতার প্রায় ৭০ শতাংশই বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। বর্তমানে বৈশ্বিক চাহিদার সিংহভাগ পাটসুতা সরবরাহ করছে বাংলাদেশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি থেকে ৪১ কোটি ৭৪ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। পরের দুই বছরে তা যথাক্রমে ৮৭ কোটি ৩২ লাখ এবং ১২১ কোটি ৮২ লাখ ডলারে উন্নীত হয়। এরপর ২০১১-১২ অর্থবছরে ১০৫ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১১৪ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি হয়। পরের দুই অর্থবছরে রফতানি ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে আসে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৯৩ কোটি ৮০ লাখ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯৮ কোটি ৪০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়। তবে পরের অর্থবছরগুলোয় ঘুরে দাঁড়িয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০৭ কোটি ৯০ লাখ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১১৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলারে উন্নীত হয় রফতানি আয়। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের ৫ মাসে পাটপণ্য থেকে রফতানি আয় এসেছে ৩৫ কোটি টাকা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুট ডাইভারসিফায়েড প্রডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিজেডিপিএমইএ) সভাপতি মোঃ রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের কারণে পাটের সম্ভাবনা অফুরন্ত। আগামী ১০ বছরে পাট শিল্প থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করা মোটেও কোন স্বপ্ন নয়। এজন্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কারখানা স্থাপন করতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য প্রবেশের জন্য গবেষণা বাড়ানো ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদামাফিক পণ্য তৈরির জন্য দেশে দক্ষ জনবল তৈরি করা প্রয়োজন।
×