ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বিশেষ প্রদর্শনী

ধ্বংসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সৃষ্টির আনন্দ, নবনির্মাণ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮

ধ্বংসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সৃষ্টির আনন্দ, নবনির্মাণ

মোরসালিন মিজান ॥ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিশাল খোলা প্রাঙ্গণ। প্রিয় প্রাঙ্গণে দাঁড়ালে এমনিতেই মন ভাল হয়ে যায়। আর এখন ডিসেম্বর। যুদ্ধজয়ের মাসে যোগ হয়েছে নতুন উপলক্ষ। সবুজ ঘাসের গালিচায় ছোট ছোট ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ভবনের সামনে ভাস্কর্য। উপরের প্লাজায় শিল্পীদের সদ্য আঁকা ছবি। দুই অংশ মিলিয়ে চমৎকার প্রদর্শনী। গত ১৪ ডিসেম্বর এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডা) যৌথভাবে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়টির চারুকলা অনুষদের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরাই ভাস্কর্য গড়েছেন। ছবি এঁকেছেন। বিচ্ছিন্ন ভাবনা। তবে মূল সূত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া বাংলাদেশ। অতীত ও বর্তমানকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে এর আলোকে তারুণ্যের চাওয়াগুলো সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রদর্শনীর শিরোনাম তাই ‘তারুণ্যের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা।’ জাদুঘরে প্রবেশের পথেই চোখে পড়ে ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের সবগুণ প্রতিটির ক্ষেত্রে অটুট রয়েছেÑ এমনটি হয়ত বলা যাবে না। তবে প্রাথমিক চর্চা ও সম্ভাবনাময় আগামীর সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। খোলা চত্বরটি চমৎকার ব্যবহার করেছেন আয়োজকরা। ভাল করে তাকালে ভাস্কর্য পার্ক দেখার অনুভূতি হয়। এখানে মোট ৭১টি কাজ। ১৯৭১ সাল স্মরণে ৭১ ভাস্কর্য। আর বিজয়ের ৪৭তম বার্ষিকী যেহেতু, অংশগ্রহণ করেছেন ৪৭ ভাস্কর। প্রতীকী হলেও সংখ্যাগুলো প্রদর্শনীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আগাম ধারণা দেয়। ভাস্কর্যে সরাসরি আসেনি মুক্তিযুদ্ধ। ফাউন্ড অবজেক্ট স্টাডির আওতায় বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন শিক্ষার্থীরা। ধ্বংসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সৃষ্টির আনন্দ অনুসন্ধান করেছেন। ভাঙ্গা পরিত্যক্ত সামগ্রী থেকে ফর্ম খুঁজে নিয়েছেন। এমন নবনির্মাণ যেন মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। একাত্তরের নয় মাসে এক রকম শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বর্বর বাহিনীর আক্রমণে সব লÐভÐ হয়ে গিয়েছিল। ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। পথঘাট। তবুও মাথা নোয়াবার নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একটু একটু করে গড়ে নিয়েছিলেন তিনি। ইউডার শিক্ষার্থীরা তেমনিভাবে নষ্ট-ক্ষয়প্রাপ্ত সামগ্রী সংগ্রহ করে তাকে বিশিষ্টার্থক করেছেন। কুড়িয়ে পাওয়া জীর্ণবস্তু পেয়েছে নতুন ভাষা। সুফল চাকমার কাজটির কথাই ধরা যাক। পুরনো দুই জোড়া জুতা সংগ্রহ করেছেন শিল্পী। তার পর বড় জোড়ার ওপর অগ্রভাগে ছোট জুতাজোড়া স্থাপন করেছেন। শিল্পকর্মের নাম দিয়েছেন ‘সম্পর্ক।’ সন্তানকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বাবাকে যেন খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। বাবার অবদানকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা সন্তানকেও চিনতে অসুবিধা হয় না। আরও গভীর বোধ থেকে বিবেচনা করলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জরুরী বার্তাটি পাওয়া যায়। প্রদর্শনীতে মুক্তিযুদ্ধের সাইড স্টোরি হয়ে এসেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। তবে মূলে যে মুক্তিযোদ্ধারা; তাদের বীরগাঁথা চোখে পড়ে না কোথাও। কিছুটা তাই অপূর্ণ মনে হয়। আক্ষেপ থেকে যায়। এর বাইরে, আগেই বলা হয়েছে, স্বতন্ত্র চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন শিল্পীরা। সাদিয়া আফরিন নষ্ট টেবিলফ্যানের গোলাকার খাঁচাটি নিজের মতো করে ব্যবহার করেছেন। মূল কাঠামোর সঙ্গে সামান্য অনুষঙ্গ যোগ করে দিয়েছেন প্যাঁচার আদল! তাবাসসুম লাকি আরও বেশি কল্পনাপ্রবণ। বাইক দেখার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ফ্লাইংবাইক গড়ে নিয়েছেন! মোটরসাইকেলের অকেজো হেডলাইট, জং ধরা চেন ইত্যাদি দিয়ে যে ফর্মটি দাঁড় করিয়েছেন, দেখে প্রজাপতি বলেই মনে হয়। উড়াল দিচ্ছি দেব করছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজের শিল্পীমনের পরিচয় তুলে ধরেন লাকি। বলেন, ঢাকার রাস্তায় হরেকরকম যানবাহন। কতশত আওয়াজ। চলা-বলা মিলিয়ে এগুলো যেন একেকটি চরিত্র। আমি চরিত্র হিসেবে দেখি। মোটরসাইকেলকে আমার কাছে ফ্লাইংবাইক বলেই মনে হয়। তাওহিদা ইসলামের শিল্পকর্মে ‘স্টোরি অব টাইম।’ বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীত পরিভ্রমণের চেষ্টা করেন তিনি। শিল্পীর অসংখ্যবার গান শুনিয়ে থেমে যাওয়া গ্রামোফোন আর রাস্তার পাশে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকা ডাকবাক্স কেমন যেন স্মৃতিতে নিয়ে যায়। ভেতরে একটা হাহাকারের জন্ম দেয়। স্মৃতির প্রতি পক্ষপাত আছে জেসিফার রহমানেরও। রড আয়রনে স্মৃতির বৃক্ষ গড়েছেন তিনি। সেখান থেকে শীতের পাতাঝরা দিনের মতো কিছু স্মৃতি খসে পড়ছে। কিছু চিরদিনের। বুকে গেঁথে আছে। একই শিক্ষার্থী নিজের পরিপক্ব ভাবনা থেকে নারীর সংগ্রামকে, টিকে থাকার লড়াইকে তুলে ধরেন। সোহানার কথা আলাদা করে বলতে হয়। এ শিল্পী আরও বেশি নিবেদিত। রিয়ালিস্টিক। হয়ত তাই নিজের বেণী করা চুল গোড়া থেকে কেটে নিতে পেরেছেন তিনি। এভাবে নারীর স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনাকে নিজের মতো করে নির্মাণ করেছেন। ফ্রি স্ট্যান্ডিং ভাস্কর্য আবেগে ভাসায় দর্শনার্থীদের। জাকির হোসাইন আনন্দ, আপন দাস, হিরণ পাশা, মাধবী হালদার, মনিরুজ্জামান পারভেজ, নন্দরাজ চাকমা, নাফিজ জামান, পারভেজ ব্যাপারী, বিষ্ণু ঋষি, ওসমান গনীসহ অন্য শিল্পীরাও ফেলে দেয়া ব্যবহার অযোগ্য সামগ্রী দিয়ে ভাস্কর্য গড়েছেন। একেক জনের একেক রকম দেখা। বিনির্মাণ। কৌতূহল নিয়ে দেখছেন শিল্পপ্রেমীরা। উদ্যান থেকে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠলে উন্মুক্ত প্লাজা। এক পাশে চলছে চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। ভাস্কর্যগুলো আগে থেকে গড়া হলেও, ছবি আঁকা হয়েছে জাদুঘর প্রাঙ্গণেই। রং-তুলি-ক্যানভাস সব নিয়ে এসেছিলেন শিল্পীরা। তারপর নিজের মতো করে আঁকা। তাৎক্ষণিকভাবে আঁকা ৮৬ ক্যানভাস। প্রায় সব ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। নবরাজ রায় নামের এক শিক্ষার্থীর ক্যানভাসে ২৫ মার্চের কালরাত। গণহত্যা। অগ্নিসংযোগ। চেনা-জানা ইতিহাসকে নিজস্ব শিল্পভাষায় স্বতন্ত্র উপস্থাপনা দিয়েছেন তিনি। ল্যান্ডস্ক্যাপের ফর্ম ভেঙ্গে তার যে নির্মিতি, বেশ নজর কাড়ে। জুলফিকার আলী মিলনের ক্যানভাসে একাত্তর ও বর্তমান সময়ের কোলাজ। একপাশে বিবর্ণ সময়কে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা। অন্যপাশে উজ্জ্বল রঙে গড়া বর্তমান। শশী নামের এক শিক্ষার্থী সুতোকাটা ঘুড়ির আশ্রয়ে বলেছেন স্বাধীনতার কথা। তার ক্যানভাসে নাঠাই শুধু। ঘুড়িকে মুক্ত করে বাঙালীর মুক্তির মহা আনন্দকে প্রকাশ করেছেন তিনি। জেসিফার রহমানের কথা আগে হয়েছে। আরও একবার এই জন্য বলা যে, শিল্পীর ক্যানভাসটি সত্যি মুগ্ধ করেছে। নবীন শিল্পীকে এখানে আরও জোরালোভাবে পাওয়া যায়। তার ক্যানভাসে ‘বøাডলাইট ভিক্টোরিয়া।’ লাল সবুজ হলুদ রঙে চমৎকার কম্পোজিশন। দেখে আগামীই যেন দেখা হয়ে যায়। এ পর্যায়ে এসে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসে শিল্পীরা তার শিল্প সৃষ্টির বিশেষ অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। আসিফ জুবায়ের, নুসরাত জাহান, নিলুফার ইয়াসমিনসহ অনেকেই জাদুঘরে এসে আপ্লুত। কয়েকজনকে পাওয়া গেল যারা জীবনে প্রথমবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে পা রেখেছেন। তারা বলছিলেন, এখানে আসার আগে কী আঁকব তা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আসার পর মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। মুক্তিযুদ্ধকে আরও কাছে থেকে দেখা হয়েছে। বুকের ভেতরে যে অনুরণন ক্যানভাসে তা-ই তুলে ধরেছি আমরা। ইউডা চারুকলার চেয়ারম্যান শিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশ। ফাউন্ড অবজেক্ট স্টাডিসহ কিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তিনি। বললেন, শিক্ষার্থীদের বেসিক স্টাডির ওপর জোর দিচ্ছি আমরা। বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছি। চারপাশের জগতের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে, কোন কোন ক্ষেত্রে ঘটনাবলীর সাক্ষী হয়ে তারা শিল্পকর্ম নির্মাণ করছে। একই কারণে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে আসা বলে জানান তিনি। চারুকলার অধ্যাপক বলেন, প্রদর্শনীর শিল্পকর্মের মান কী, সে নিয়ে কথা হতে পারে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসে ছবি এঁকেছে। নিজেদের চিন্তার জগতকে নিজের মতো করে তুলে ধরেছে। ভাস্কর্যেও স্বাধীন চিন্তার বহির্প্রকাশ। এভাবে তাদের সম্ভাবনার জায়গাগুলো পরিষ্কার হচ্ছে। আপন শিল্পসত্তা নিয়ে তারা এগিয়ে গেলে ভবিষ্যতে ভাল কিছু পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। প্রদর্শনী চলবে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
×