ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চলে গেলেন সাইদুল আনাম টুটুল

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮

চলে গেলেন সাইদুল আনাম টুটুল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গত শনিবার থেকেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুল। মঙ্গলবার শেষ হলো তার সেই জীবনযুদ্ধ। এদিন দুপুর ৩টার পর রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। ছোট ও বড় পর্দার এই বরেণ্য নির্মাতা, চলচ্চিত্র সম্পাদক, চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা রেখে গেছেন স্ত্রী মোবাশ্বেরা খানম এবং দুই মেয়ে ঐশী আনাম ও অমৃতা আনামসহ অসংখ্য শুভাকাক্সক্ষী। তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। সাইদুল আনাম টুটুলের মৃত্যুর খবরে শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। মৃত্যুর খবর পেয়ে অনেকেই ছুটে গিয়েছেন তার শান্তিনগরের বাসভবনে। সাংগঠনিকভাবে শোক জানিয়েছে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ। মঙ্গলবার বিকেলে হাসপাতাল থেকে সাইদুল আনাম টুটুলের মরদেহ নিয়ে আসা হয় তার শান্তিনগরের বাসভবনে। সেখানে পরিবারের সদস্যদের চোখের কোল গড়িয়ে ঝরে পড়ে বেদনার অশ্রু। গুণী এই নির্মাতাকে শেষ নজর দেখতে বাড়িতে ছুটে আসেন প্রখ্যাত অভিনেতা আলী যাকের, তারিক আনাম খান, অভিনেত্রী নিমা রহমান, অভিনেতা ও নির্মাতা সালাউদ্দীন লাভলুসহ শিল্প-সংস্কৃতি ভুবনের অনেকে। বাদ এশা বাসার পার্শ্ববর্তী মসজিদে এই নির্মাতার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর শবদেহ রাখা হয় বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে। পরিবারের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার টুটুলের দাফনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলেও কোথায় সমাহিত করা হবে- সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সাইদুল আনাম টুটুলকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে কোন সরকারী সিদ্ধান্ত আসেনি। সাইদুল আনাম টুটুল মুক্তিযুদ্ধে ৬ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করলেও মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র গ্রহণ করেননি। পারিবারিক সূত্র জানায়, টুটুলের দুই মেয়েই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। বাবার অসুস্থতার খবরে সোমবার বড় মেয়ে ঐশী আনাম দেশে ফিরলেও এখনও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন ছোট মেয়ে অমৃতা আনাম। আজ বুধবার বিকেলে ছোট মেয়ে দেশে ফিরবেন। এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সাইদুল আনাম টুটুলকে নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করা হবে বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ। বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চলা ওই শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব শেষে বাদ যোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। গত শনিবার রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হন সাইদুল আনাম টুটুল। এরপর তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি করেন। এরপর থেকেই তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারী অনুদানে ‘কালবেলা’ ছবিটি পরিচালনা করছিলেন সাইদুল আনাম টুটুল। এই ছবির প্রায় ৯০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত ‘নারীর ৭১ ও যুদ্ধপরবর্তী কথ্যকাহিনী’ বই থেকে এই ছবির গল্প নেয়া হয়েছে। ছবিটির প্রযোজনায় ছিল সাইদুল আনাম টুটুলের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘আকার’। এর আগে সরকারী অনুদানে নির্মিত সাইদুল আনাম টুটুলের প্রথম ছবি ‘আধিয়ার’ মুক্তি পায় ২০০৩ সালে। ১৯৭৯ সালে ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্রে কাজ করে শ্রেষ্ঠ চিত্র সম্পাদক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান টুটুল। ‘ঘুড্ডি’, ‘দহন’, ‘দীপু নাম্বার টু’ ও ‘দুখাই’য়ের মতো সমাদৃত চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল তার। এই ছবিগুলোর সম্পাদনা করেছেন তিনি। সাইদুল আনাম টুটুল ডিরেক্টরস গিল্ডের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ও আজীবন সদস্য। চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সম্পাদক ও চলচ্চিত্র সংসদকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা সাইদুল আনাম টুটুল ১৯৫০ সালের ১ এপ্রিল পুরোনো ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা সরকারী মুসলিম স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৭১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ঢাকা কলেজে অধ্যয়নকালে সাইদুল আনাম টুটুল চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং ৬ নম্বর সেক্টরের আওতায় খুলনা অঞ্চলে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও এই গুণীজন নেননি মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র। মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইদুল আনাম টুটুল ব্যবসায় বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তার প্রেক্ষিতে তিনি ১৯৭৪ সালে ভারতের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে পুনায় অবস্থিত চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্র সম্পাদনা বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। চলচ্চিত্র সম্পাদনার ওপর পড়াশোনা শেষে ১৯৭৮ সালে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। দেশে ফিরে সাইদুল আনাম টুটুল বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্রের সম্পাদনা করেন। ১৯৭৯ সালে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্রের সম্পাদক হিসেবে তিনি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সম্পাদক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। চলচ্চিত্র সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন গুণী চলচ্চিত্র শিক্ষক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট, বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদের আয়োজনে ফিল্ম এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স ও চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি চলচ্চিত্র ভাষা ও চলচ্চিত্র সম্পাদনা বিষয়ে পাঠদান করতেন। সাইদুল আনাম টুটুল বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের একজন কিংবদন্তি নির্মাতা। তার উল্লেখযোগ্য টেলিভিশন নাটকগুলো হলোÑ নাল পিরান, বখাটে, সেকু সেকান্দর, ৫২ গলির এক গলি, আপন পর, গোবর চোর, হেলিকপ্টার, নিশিকাব্য, অপরাজিতা ইত্যাদি। দেশের বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ ধারায়ও প্রভূত পরিবর্তন আনেন এই নির্মাতা। একজন সফল বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রায় চার শতাধিক বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেছেন।
×