ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

শেখ হাসিনা ॥ এ ডটার্স টেল ॥ একটি পরিবার এবং জাতির শোক ও শক্তির প্রামাণ্য দলিল

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮

শেখ হাসিনা ॥ এ ডটার্স টেল ॥ একটি পরিবার এবং জাতির শোক ও শক্তির প্রামাণ্য দলিল

ইদানীং মানুষজন খুব একটা সিনেমা হলে যায় না। যখন হলে গিয়ে সিনেমা দেখার প্রচলন ছিল বা বলা যায় সিনেমা হলের রমরমা ব্যবসা তখনও হাতেগোনা কয়েকটি সিনেমা দেখেছি। হলে গিয়ে সিনেমা দেখাকে তখন সাধারণ মানুষ বলতেন ‘বই দেখা’। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কারণে, বিশেষত সাম্প্রদায়িকতার উত্থানের ফলে হলে সিনেমা দেখ কমতে থাকে। যাত্রাপালাও দিনে দিনে হ্রাস পায়। অশ্লীলতার কথা বলে সরকারীভাবে এক সময় যাত্রা বন্ধ করা হয়। শীতের রাতে গ্রামাঞ্চলের বিচারগানও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত প্রায়। কবিগান একেবারে উঠেই গেছে। এ সবের পেছনে শহরায়ন ও ডিজিটালাইজেশন যেমন কাজ করেছে, তেমনি রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন অনীহাও ভূমিকা রেখেছে। তারপরও বিগত বছরগুলোতে কয়েকটি সিনেমা কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ ও ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ও তেমনি সিনেমা হলে মানুষকে আকৃষ্ট করে। ‘শেখ হাসিনা- এ ডটার্স টেল’ কোন সিনেমা নয়, এটি একটি প্রামাণ্যচিত্র। টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমান বাল্যকাল থেকে কলকাতায় গমন ও পরবর্তীতে ঢাকায় আগমন এবং তার পরিবার বিশেষ করে ছেলেমেয়ে নিয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ঢাকায় গমন, বার বার বঙ্গবন্ধুর কারাভোগ ও জেল জীবন এবং ছয় দফা প্রভৃতি ঘটনাগুলো সাবলীলভাবে চলে আসে ঘটনার বিবরণে। শেখ মুজিব কিভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন এসব বিষয়গুলো খুব সংক্ষেপে এগিয়ে যায়। অতঃপর সামনে আসে একাত্তর। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের পূর্বে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও বিভিন্ন জেলা শহরে এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। এসব ঘটনা এখানে উল্লেখিত হয়েছে পরম্পরায়। মুক্তিযুদ্ধকালে শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুঃখ কষ্টের বর্ণনা, শেখ কামাল ও শেখ জামালের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান এবং ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য খুব দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার ঘটনা বেগম মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যরা বেতারের মাধ্যমে জানতে পারেন। লক্ষ্য করি অবতরণের সময় তাঁরা একটি রেডিও নিয়ে বসে আছেন। ছবিতে বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারির বিখ্যাত ভাষণের অংশ বিশেষ সংযোজিত হয়েছে। এরপরই চলে এসেছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সাক্ষাতকার। বঙ্গবন্ধু সাবলীলভাবে তাঁকে গ্রেফতারের ঘটনা ও বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকার আলবদরের গণহত্যার বর্ণনা দিয়েছেন। চলচ্চিত্রে এরপর ঘটনাপ্রবাহ ক্রমেই জটিল হতে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশে কিভাবে ধীরে ধীরে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয় তার খ-াংশ ঘটনার বিবরণে উঠে এসেছে। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দূরত্ব এবং তাজউদ্দীনের দূরে সরে যাওয়ার প্রসঙ্গটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু বাসায় এসে বললেন যে, তাজউদ্দীন তো চলে গেল। তখন শেখ হাসিনা তাঁর বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে উত্তর দেন যে, তাজউদ্দীন চাচা চলে গেলেও মোশতাক চাচা তো আছে। তখন বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন ‘মোশতাককে তুই কতটুকু চিনিস।’ এই ছবির মূল বিষয়বস্তু এই ঘটনা থেকে। শেখ হাসিনার মুখে এই ঘটনা বলার পর তিনি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন যে, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) সবাইকেই ভাল করে চিনতেন।’ কিন্তু তাজউদ্দীন সরে যাওয়ার পরিস্থিতি কিভাবে দিনে দিনে তৈরি করা হয়েছিল সম্ভবত সে বিষয়টি তখন বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেননি। কারণ, তাজউদ্দীনের ছিটকে পড়ার পরই সবকিছু ক্রমান্বয়ে মোশতাকের কব্জায় চলে যায় এবং ’৭৪ এর অক্টোবর থেকেই শুরু হয় চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এই দুই বোনের মাধ্যমে সকল ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে একবার বলেছেন যে, ‘আমাদের বাসায় (৩২ নম্বর) সবাই আসত। ডালিম, নূর ও হুদার অবাধ যাতায়াত ছিল। জিয়াউর রহমানও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে আসতেন। খুনীদের কাছে বাসার সকল কিছু নখদর্পণে ছিল।’ শেখ জামাল যেহেতু সেনাবাহিনীতে ছিলেন তাই সামরিক কর্মকর্তাদের এখানে অবাধ যাতায়াত ছিল। সর্বস্তরের মানুষের জন্য বাড়িটি উন্মুক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সরকারী পর্যায় থেকে বঙ্গভবনে অবস্থানের কথা বললে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সেখানে যেতে অনীহা প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনাসহ অন্য সদস্যরাও যেতে রাজি হননি। এই ঘটনাপ্রবাহ একজন রাজনীতিবিদ ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক ও শেকড় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। এরপর চলচ্চিত্রটির গল্প জটিল হতে থাকে। এ গল্প বাংলাদেশের ক্রান্তিকালের ইতিহাসের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে ভেতর থেকে যে যড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, প্রখর বুদ্ধিমত্তায় তাজউদ্দীন আহমদ তা মোকাবেলা ও নস্যাত করেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে থাকেনি। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসার পর তারা পরিকল্পনা করে যে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) কাছ থেকে তাজউদ্দীনকে সরিয়ে দিতে হবে। ১৯৭৪-এ এসে তারা সফলতা লাভ করে। খুনীরা অবাধে ৩২ নম্বরে যাতায়াত শুরু করে। বাড়ির কোন রুমে কে থাকে, কোথায় কি আসবাবপত্র আছে সবই খুনীদের নখদর্পণে ছিল। এরমধ্যে কুমিল্লা ইওজউ-এর খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দীন ঠাকুর ও মাহবুব আলম চৌধুরী প্রমুখের সভা হয়। বঙ্গবন্ধু এসব খবর জানতেন কি-না তা শেখ হাসিনা বা শেখ রেহানা এ গল্পে উল্লেখ করেননি। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জঅড ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ঈওঅ-এর নজরেও এই ষড়যন্ত্রের বিষয়গুলো এসেছিল। জঅড-এর রমানাথ কান্ত বঙ্গবন্ধুকে বিষয়গুলো অবহিতও করেছিলেন। কিন্তু বাঙালীদের ওপর তাঁর চিরকালীন বিশ্বাসকে তিনি মৃতে্যুর মধ্য দিয়েও বিসর্জন দেননি। ঘটনা পরম্পরা এগিয়ে চলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের দিকে। এরই মধ্যে শেখ হাসিনা ড. ওয়াজেদ মিয়ার কাছে জার্মানিতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। সঙ্গে ছোট বোন রেহানাও যাবেন। তাঁরাও বুঝতে পারেননি বাংলাদেশ এ ধরনের একটি অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হয়ত বা বাঁচিয়ে রাখবে বলে নিয়তিই তাঁদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে। একদিকে ড. ওয়াজেদ মিয়ার গবেষণা অন্যদিকে দুই বোনের মোটামুটি ভাল সময় কাটছিল। এরমধ্যে ১৪ আগস্ট তারিখে তাঁরা বেলজিয়ামে একটি ঈধহফষব হরমযঃ ঢ়ধৎঃু (মোমবাতির রাত)-তে যোগ দেন এবং রাতে এসে দুই বোন গল্প করেন গভীর রাত পর্যন্ত। এরই মধ্যে এক সময়ে তাঁরা যে বাসায় রাতযাপন করেছিলেন (বেলজিয়ামের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসা কি-না হলরুমে বুঝতে পারেনি) সেই বাসার ফোনটি বেজে ওঠে। শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছেন যে, ওই ফোনটির শব্দ এত কর্কশ ছিল যে, তিনি জীবনে ওই ধরনের কর্কশ ফোনের শব্দ কখনও শোনেননি। ওই ফোনেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের খবরটি দেয়া হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা-রেহানা দুই বোন কাউকে ঘটনাটা বলা হয়নি। তবে তাঁরা লক্ষ্য করেন যে, ফোনটি আসার পর ওই বাড়ির পরিবেশটি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ড. ওয়াজেদ জার্মানিতে রওনা দেয়ার উদ্যোগ নেন। যদি ভুল না শুনে থাকি এ পর্যায়ে শেখ হাসিনা বলছেন যে, জার্মান সীমান্ত পর্যন্ত আসার জন্য বা এয়ারপোর্ট যাবার জন্য বেলজিয়ামের বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত তখন তাঁদের গাড়ি দিয়ে সহায়তা করেননি। এ ঘটনাটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর নিয়োগ দেয়া রাষ্ট্রদূত তাঁর সন্তানদের তখন চিনতে পারছেন না। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু পাল্টে গেল। তবে জার্মান রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী তাঁর গাড়ি পাঠিয়ে এই পরিবারকে তাঁর বাসায় নিয়ে যান। এ পর্যায়ে শেখ রেহানা বলেছেন যে, ‘তিনি মনে করছেন, আপা হয়ত ঘটনা জানেন না এবং আপা মনে করছেন আমি ঘটনা জানি না। আসলে আমরা দুজনই ইতোমধ্যে সবকিছু অনুমান করে ফেলেছি এবং হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী তাঁদের সবকিছু খুলে বলেন।’ দুই বোনের সামনে তখন গহীন সাগর। পিতৃ-মাতৃহীন দুই এতিমের জীবন যুদ্ধের শুরু। খুলনায় শঙ্খ সিনেমা হলে বসে মনে হয়েছে এই ঘটনাটি আবার পেছন থেকে দেখা দরকার। কারণ, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার দুই সন্তানের মসৃণ চলার পথকে খুনীরা কিভাবে কণ্টকাকীর্ণ করল। জার্মান রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী শেখ হাসিনা ও রেহানাকে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের আশ্রয় দেন। শেখ হাসিনা দিল্লীতে আশ্রয় লাভের অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাত পান। ইন্দিরা শেখ হাসিনাকে দেখে প্রথমেই বলেন, তুমি কি খাবে? তোমাকে চা বা কফি বানিয়ে দেই এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না দেন। এটি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মাতৃ-পিতৃহীনা শেখ হাসিনার প্রতি মমত্ববোধের প্রকাশ। শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা দিল্লীতে থাকাকালে তাঁদের নাম পাল্টে থাকতে হতো। তাঁরা মি. তালুকদার, মিসেস তালুকদার ও মিস তালুকদার নামে পরিচিত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে শেখ রেহানা বলেন, ‘এ এক দুর্বিষহ জীবন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও আমাদের ভিন দেশে থাকতে হয়েছে এবং নাম পাল্টাতে হয়েছে। এর চেয়ে দুর্বিষহ জীবন আর কিছু হতে পারে না।’ ছোট্ট ছোট্ট দুটো রুমের মধ্যে তাঁদের এই নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়েছে। এই সময়ে মারাত্মক দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের। এ পর্যায়ে শেখ রেহানার বক্তব্যে মনে হয় যে, এই ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাঁরা মানসিক শক্তি হারাননি। বাংলাদেশের মাটিতে খুনীদের একদিন বিচার হবে- তাঁরা এ বিষয়ে প্রত্যয়দীপ্ত হতে থাকেন। ১৫ আগস্ট রাতে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের প্রায় সবাই নিহত হন। তারপরও যারা ছিলেন তাঁদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। এ প্রসঙ্গে শেখ রেহানা উল্লেখ করেন যে, ‘তাঁরা লন্ডন থেকে খোকা কাকার (মমিনুল হক খোকা) চিঠির অপেক্ষায় থাকতেন। মমিনুল হক (খোকা)-এর এসব চিঠিপত্র তাঁদের মানসিক শক্তি যোগাত।’ ১৯৭৬-১৯৮১ খ্রি. পর্যন্ত প্রায় ৬ বছর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দিল্লীতে থাকতে হয়। এখানে অবস্থানকালেই শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং ১৭ মে ১৯৮১ খ্রি. তারিখে তিনি স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৭ মে লাখো লাখো মানুষ শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান। এদিন ঢাকায় ছিল অঝোরে বৃষ্টি। ওই দিনের বৃষ্টি দেখে মনে হয় যেন প্রকৃতিও বঙ্গবন্ধুর জন্য কাঁদছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে শোকে শরিক হচ্ছে। পাশাপাশি প্রকৃতি এ বার্তাও যেন প্রদান করে যে, বাংলাদেশে তাঁর চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ হবে না। এরই প্রতিফলন ঘটে শেখ হাসিনার বক্তব্যে। তিনি বলেন যে, ‘৩২নং বাড়িটি তাঁকে হস্তান্তর করা হয়নি। বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে তাঁকে মিলাদ পড়তে হয়।’ এতে জিয়াউর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গিও স্পষ্ট হয়। শেখ হাসিনা দেশে এসে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁকে দল গোছাতে হবে। আওয়ামী লীগের খ-বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে একত্রিত করতে হবে। আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান), আওয়ামী লীগ (গাজী) প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত ছিল দলটি। আবার ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের কিছু কিছু নেতাকে নিজ দলে ভেড়ান। আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বেশকিছু সিনিয়র নেতা আলাদা বাকশাল গঠন করেন। এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালেও শেখ হাসিনার উপর কম নির্যাতন হয়নি। চট্টগ্রামসহ কয়েকবার কয়েক জায়গায় তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। বেশকিছু কর্মী তাদের জীবন দিয়ে তাঁকে রক্ষা করেন। ১৯৮৭-এর ১০ নবেম্বর নূর হোসেন শেখ হাসিনার গাড়ির সামনে পুলিশের গুলিতে মারা যান। ঐগুলিটিও ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে। রাজনীতির ময়দানে এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সংগ্রামে তিনি রাতদিন ব্যস্ত থাকায় তাঁর সন্তানদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন শেখ রেহানা সিদ্ধান্ত নেন তাদের ভারতের নৈনিতালে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করাবেন। শেখ হাসিনা গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় জয় ও পুতুলকে নৈনিতালে ভর্তি করা হয়। এ পর্যায়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। মা-বাবা-ভাই-বোনকে হারিয়ে সন্তান দুটোকে নিয়ে থাকব তাও সম্ভব হলো না।’ এ পর্যায়ে রেহানা বলেন যে, ‘অনেকটা একক সিদ্ধান্তে এবং কিছুটা নিষ্ঠুর হয়েও তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, ওদেরকে মানুষ করা দরকার। লেখাপড়া শেখানো দরকার।’ এ ধরনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ও রেহানার পথচলা। অবশেষে এরশাদের পতন ও ’৯১ এ বিএনপির ক্ষমতারোহণ। এই সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি প্রকট হতে থাকে। অন্যদিকে কুখ্যাত গোলাম আযম তার নাগরিকত্ব ফিরে পায়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে প্রথমেই যে কাজটি করেন, তাহলো ইনডেমিনিটি আইন বাতিল করা। অতঃপর গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ও পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদন। দীর্ঘকালের সমস্যা জর্জরিত পার্বত্য শান্তি চুক্তি সমগ্র বিশ্বে প্রশংসিত হয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের আওতায় আনা শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন ‘অনেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে বলেন। আমি তাতে রাজি হয়নি। দেশের আর দশটা নাগরিক যেমন বিচার পায়, আমিও তেমনি চেয়েছি।’ এরপর কয়েক বছর মামলা চলে। অতঃপর বিচারক গোলাম রসুলের আদালতে রায় ঘোষিত হয়। এরমধ্যে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে হাইকোর্টে ডেথ রেফান্সের শুনানি করেনি। ২০০৮ সালে পুনরায় শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় বাস্তবায়ন করেন। এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি ঘটনা প্রত্যেকটি দৃশ্য ছিল হৃদয়গ্রাহী। দর্শক মুহূর্তের জন্যও পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারেনি। ছবির ফাঁকে ফাঁকে দর্শক কেঁদেছে। ঘটনার সঙ্গে মিউজিকের সুর ছিল অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। কখনও কখনও মিউজিক যেন বুকের মধ্যে মোচড় দিয়েছে বা দর্শকদের আবেগপ্রবণ করেছে। একটি পরিবার কিভাবে একটি জাতির ভাগ্যনির্ধারণে জড়িয়ে পড়ে অথবা একটি পরিবারের সঙ্গে একটি জাতি কিভাবে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসে- ‘শেখ হাসিনা-এ ডটার্স টেল’ তারই প্রতিফলন। শেখ হাসিনা গৃহে অন্তরীণ অবস্থায় বুকভাঙ্গা কান্নার মধ্যে তাঁর সন্তানদের পড়তে পাঠিয়েছিলেন, এজন্য আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। শেখ হাসিনা সেই ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন বলে আজ প্রতিবন্ধীরা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগের আওতায় এসেছে। এজন্য তরুণ প্রজন্মের এই প্রামাণ্য চিত্রটি দেখা উচিত এবং শোককে কিভাবে শক্তিতে পরিণত করতে হয় তা জানা উচিত। লেখক : উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
×