ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চা শ্রমিকদের মজুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ করার দাবি টিআইবির

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮

চা শ্রমিকদের মজুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ করার দাবি টিআইবির

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের ৬৪টি চা বাগানে কর্মরত সব চা শ্রমিকদের মজুরি অন্যান্য খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে নির্ধারণ করতে ও তাদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারসমূহ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একইসঙ্গে ব্রিটিশ আমলের দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও চা শিল্পে এর রেশ রয়ে গেছে বলে জানান। দেশের ১ লাখ ২২ হাজার স্থায়ী-অস্থায়ী চা শ্রমিকদের অমানবিক জীবন যাপনের জন্য তিনি সরকারের পাশাপাশি শিল্প মালিক, চা সংসদ ও চা শ্রমিক সংগঠনগুলো দায়ী করেছে সংস্থাটি। মঙ্গলবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে টিআইবির প্রধান কার্যালয়ে ‘চা বাগানের কর্ম পরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকার : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এসব কথা বলেন। এ সময় টিআইবির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, গবেষণা তত্ত্বাবধান ও সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোঃ ওয়াহিদ আলম উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা পরিকল্পনা ও প্রতিবেদন প্রকাশ করেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার দিপু রায়, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার গোলাম মোস্তফা ও রবিউল ইসলাম। ড. ইফতেখার বলেন, ব্রিটিশের তৈরি দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও চা শিল্পে এখনও এর রেশ কাটেনি। চা শ্রমিকদের সরাসরি দাস বলা যাচ্ছে না। কিন্তু তাদের যে মৌলিক অধিকার তা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। সাংবিধানিকভাবে সমাজের শোষিত, বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আদায়ে সরকারের যে দায়িত্ব রয়েছে তাও পালন করা হচ্ছে না। এ থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমলে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের নিয়ে এসে চা বাগানের কাজে লাগানো হয়েছিল। সেই থেকে ঐতিহ্যগতভাবে তারা বংশানুক্রমে ওই চা বাগানে রয়েছেন। এই শিল্পটাই তারা করেন। অনেক অব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও তারা সেখানে আছেন। কারণ এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ তাদের খুবই কম। তা সত্ত্বেও এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, যারা এই অঞ্চলে চা-শ্রমিক পরিবারের সদস্য, তাদের কেউ কেউ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন। এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখার বলেন, বাধ্য করে আটকে রেখে কাউকে চা বাগানে শ্রমিকের কাজ করানো হয় না। আসলে তাদের যাওয়ার কোন জায়গা নেই। চা শ্রমিকদের আমি প্রথাগত দাস বলব না, বলাও যাবে না। তার কারণ হচ্ছে দাসপ্রথার মধ্যে মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আমাদের এখানে চা শ্রমিকরা অনেক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও একেবারেই বঞ্চিত বলা যাবে না। তবে এখানে দাসপ্রথা যেহেতু অরিজিনেট হয়েছে তাই দাস প্রথার কথাটি আসছে। সেটার একটা রেশ এখনও রয়ে গেছে। তিনি বলেন, চা শিল্পে সরকারের সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও পৌঁছেনি, চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। চা শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের জন্য নিয়োজিত কলকারখানা পরিদর্শক প্রতিষ্ঠানের তদারকি নেই বললেই চলে। তারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। তবে যেসব কর্মকা- পরিচালিত হয় এতেও নানা প্রকার অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয় উক্ত প্রতিষ্ঠানটি। সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত চা শ্রমিকরা তাদের বিভিন্ন অভিযোগ আইনগতভাবে সমাধান করতে মামলা দায়ের করতে চাইলেও দেশের অপর প্রান্ত চট্টগ্রামে শ্রম আদালত থাকায় তেমন কেউ আইনীভাবে সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী হন না। গবেষণার অধীনে শুধুমাত্র প্রথাগত শ্রমিকদেরই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যারা চা বাগানে স্থায়ীভাবে কর্তৃপক্ষের দেয়া বাসস্থানে বসবাস করেন। যাদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় সব সুযোগ-সুবিধা ও মজুরি বাগান কর্তৃক দেয়া হয় এবং যারা মূলত সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি জেলায় বসবাস করেন। গবেষণাটি ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট সময়ে পরিচালিত হয়। গবেষণার ক্ষেত্রে আইনী সীমাবদ্ধতা, বৈষম্যমূলক আইন ও নীতিমালা, চাকরি স্থায়ীকরণ, মজুরি কাঠামো, চা পাতার ওজন করণ, কাজের পরিবেশ, ছুটি ও উৎসব ভাতা, রেশন, আবাসন ও মেরামত, আবাসনে আলোর ব্যবস্থা, খাবার পানি সরবরাহ, চিকিৎসা, শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা, ভবিষ্যত তহবিল, ক্ষতিপূরণ, প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের দায়িত্বে অবহেলা ও দুর্নীতিসহ সার্বিক পর্যবেক্ষণ গবেষণায় তুলে ধরা হয়। গবেষণায় ৬৪টি বাগানের মধ্যে ৪৬টি তে কোন প্রকার শৌচাগার না থাকা, ১১টি বাগানে চিকিৎসার জন্য কোন প্রকার ডিসপেনসারি না থাকা, চিকিৎসাকেন্দ্র থাকলেও ৩২টি কেন্দ্রে কোন প্রকার বেড না থাকা ও প্রয়োজনীয় প্রায় ওষুধ বাইরে থেকে কেনা, আবাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক হওয়া, মজুরি দিতে ওজনে কম দিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া, ৪০টি বাগানের কোন প্রকার বাগানের নিজস্ব স্কুল না থাকা, চা শ্রমিকের প্রায় ১৬ ভাগ সন্তান স্কুলে না যাওয়া, বাগানের স্কুলের ছাত্রদের উপবৃত্তি না পাওয়া, চাকরিরত অবস্থায় মৃত্যু ঘটলে বা কোন প্রকার অঙ্গহানি ঘটলে নিয়ম থাকলেও বেশিরভাগ বাগানে তা প্রদান না করার কথা উঠে আসে।
×