ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিজয় দিবস’ শীর্ষক একক বক্তৃতায় স্বদেশ রায়

ধারাবাহিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি ১৬ ডিসেম্বর

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮

ধারাবাহিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি ১৬ ডিসেম্বর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ১৯৭১’র ১৬ ডিসেম্বর যে বিজয় দিবসে বাঙালী জাতি পৌঁছায় তা কোন আকস্মিক ঘটনা নয় বা কেবল একটি নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ফলও নয়। বাস্তবে একটি দীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালী জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর। এই দীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রামের শুরু ধরা যেতে পারে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ চলে যাওয়া বা ভারত ভাগের পর ঢাকার ১৫০ মোগলটুলিতে মুসলিম লীগের তরুণ কর্মীদের যে সর্বক্ষণিক আস্তানা গড়ে উঠেছিল সেখান থেকে। মঙ্গলবার জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী’ আয়োজিত ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিজয় দিবস’ শীর্ষক একক বক্তৃতায় বিশিষ্ট গবেষক ও প্রাবন্ধিক এবং দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর সহসভাপতি অধ্যাপক সুলতান নিগার চৌধুরী। এসময় উপস্থিত ছিলেন সাবেক বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, শিল্পী হাসেম খান প্রমুখ। স্বদেশ রায় তার বক্তৃতায় বাঙালী জাতির গোড়া থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাস তুলে আনেন। ১৫০ মোগলটুলিতে মুসলিম লীগের তরুণ কর্মীদের যে সর্বক্ষনিক আস্তানা গড়ে উঠেছিল তা ছিল অনেকটা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণিক কর্মীদের ক্যাম্পের আদলে। সেখানে যারা জড়ো হয়েছিলেন তাদের অধিকাংশ ছিলেন তরুণ। ২১ ফেব্রুয়ারির এই আত্মত্যাগ ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলন ও ১৯৪৯ এ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সৃষ্টি হবার ভেতর দিয়ে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের জন্যে যে আলাদা পথ চলার একটি ধারার উন্মেষ ঘটেছিল তাকে শুধু দৃশ্যমানই করে না, এর একটি কনসেপচুয়াল রূপও দেয়। যে রূপটি হলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের ভাষার দাবিতে প্রাণ দেবার একটি দিন নয়, এটা পূর্ব বাংলায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্মলগ্নও। পূর্ব বাংলায় ভাষাভিত্তিক এই জাতীয়তাবাদের জন্মের পরেই স্বাভাবিক মৃত্যু প্রক্রিয়া শুরু হয় ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের। কারণ, ভাষাভিত্তিক জাতীয়বাদের ভেতর উগ্রতা থাকলেও এর উগ্রতা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ থেকে অনেক কম। আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করেন আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ জারির ভেতর দিয়ে দুটো বিষয় প্রমাণিতÑএক, পাকিস্তানে কোনভাবেই মুসলিম লীগ বা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আর ক্ষমতা পরিচালনা করার শক্তি নেই। দুই, মার্শল ল’ এসেছিল কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ (ততদিনে আওয়ামী মুসলিম লীগ তাদের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়েছে) সরকারকে হটিয়ে। অর্থাৎ ততদিনে এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে ভবিষ্যতে পাকিস্তান সৃষ্টিকারী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে। তখনও পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের বড় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মৌলানা ভাসানী। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক থাকলেও তিনি তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের এই সিদ্ধান্ত তাকে অন্য সকল নেতা থেকে ভিন্নতা যেমন এনে দেয় তেমনি তার ভেতর তখন স্বাভাবিকভাবে পূর্ব বাংলার একক নেতা হবার সূর্যটি উঁকি দেয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী’র মৃত্যুর পরে আওয়ামী লীগের কিছু প্রবীণ নেতার অমত সত্ত্বেও শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটান। এই সময়ে তিনি দলের সভাপতি করেন মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশকে। যদিও সভাপতি ছিলেন মওলনা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ কিন্ত দলের সেক্রেটারি হিসেবে শেখ মুজিবই আওয়ামী লীগের মূল নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। সত্যিকার অর্থে বাঙালীর বিজয়ের এটা একটি মাইলস্টোন। কারণ, ১৫০ মোগলটুলিতে যে স্বপ্নের সূচনা হয়েছিল, যার ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের মুসলিম লীগ অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়, তারই আকাক্সক্ষার ধারায় ’৫২-তে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার জন্ম হয়। এই ধারাবাহিকতার সম্পূর্ণ ধারক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাই ১৯৬২ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবন করার ভেতর দিয়ে যে আওয়ামী লীগের জন্ম হলো সেখানে আর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কোন লেশমাত্র থাকল না। যদিও এটাকে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন বলা হয়ে থাকে, তবে বাস্তবে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এক নতুন আওয়ামী লীগের জন্ম দিলেন ১৯৬২ সালে। এর মাত্র চার বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ সৃষ্টির লিখিত এবং সুপরিকল্পিত প্রোগ্রাম জাতির সামনে উপস্থিত করলেন, যা ছিল ছয় দফা। এই ছয় দফা মূলত একটি জাতি -গোষ্ঠীর নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক পন্থা। একক বক্তব্যে স্বদেশ রায় বলেন, শেখ মুুজিবুর রহমান কোন সশস্ত্র বা বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন না। তিনি যে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ধাপে ধাপে তার জাতির মূল জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন তা ছিল সম্পূর্ণরূপে নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেবার পরে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফাকে কেন্দ্র করে যে লক্ষ্য হাতে নেন তা হলো একটি নির্বাচনের ভেতর দিয়ে ছয় দফার প্রতি জনগণের ম্যান্ডেট নেয়া। এবং ওই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে প্রমাণ করা তিনি পূর্ব বাংলার শুধু নয়, পাকিস্তানের একক নেতা। অন্যদিকে সামরিক শাসক আইয়ুব খানও শেখ মুজিবুর রহমানের এই লক্ষ্য বুঝতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি। কিন্ত শেখ মুজিবুর রহমান তখন রাজনীতি এমনভাবে নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন যে হাজার চেষ্টা করেও সামরিক শাসকরা আর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ জাগাতে পারেনি। তাই আইয়ুবের হাতে ছিল তখন কেবলমাত্র শক্তি প্রয়োগ বা রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগ। আইয়ুব রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে সামরিক আদালতের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প তখন খুঁজে পায় না। যে কারণে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেয়। শেখ মুজিবুর রহমানও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। কারণ ততদিনে সামরিক বাহিনীর বিপরীতে শেখ মুজিবুর রহমান একটি সুসংগঠিত ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ গড়ে তুলেছেন। তাই খুব সহজে তিনি হয় বিজয় না হয় ফাঁসির দড়ি, এই রাজনীতিকে আলিঙ্গন করেন। এখানে লক্ষ্যণীয় যে একজন জাতীয়তাবাদী নেতাকে সর্বোচ্চ যতটা সাহসী হতে হয় শেখ মুজিবুর রহমান ঠিক ততটাই সাহসী ছিলেন। তাঁর রাজনীতির শুরু থেকে তাঁর নিহত হবার ঘটনা অবধি যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবেÑকোন ক্ষেত্রেই তিনি এক তিল আপোস করেননি, কখনই কোন মুচলেকা দেননি; চাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে হোক আর সামরিক শাসকের অস্ত্রের মুখে হোক। তাছাড়া রাজনৈতিক হিসেবেও শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন। জেলের তালা ভাঙ্গব, শেখ মুজিবকে আনব। এই স্লোগান এবং নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমানের পকেটে লেখা চিরকুট, ‘মা শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে যাচ্ছি’ এই দুটি সেøাগানে সেদিন জেল থেকে বের হয়ে আসা নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যে বাংলাদেশের সমান দীর্ঘ তা প্রমাণ করে দেয়। তাই ছাত্র জনতার পক্ষ থেকে, দেশের মানুষের পক্ষ থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নেতা তোফায়েল আহমেদের দেয়া বঙ্গবন্ধু উপাধি মুহূর্তেই মানুষের প্রাণে গেঁথে যায় আর তার পর থেকে সব বয়সের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের প্রিয় নাম বঙ্গবন্ধু হিসেবে ডাকে। তিনি হয়ে গেলেন সবার বঙ্গবন্ধু। চূড়ান্ত বিজয়ের আগে কোন জাতীয়তাবাদী নেতার এ ধরনের অভিষেক যেমন ইতিহাসে বিরল তেমনি অভিষেক বলে দেয় চূড়ান্ত বিজয় এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। এত বড় বিজয়ের পরেও, এত দীর্ঘ মাপের নেতার উচ্চতায় পৌঁছে যাবার পরেও বঙ্গবন্ধু তার জাতিকে কোন তড়িঘড়ি বা অনিয়মতান্ত্রিক পথে ঠেলে দেননি। বরং তিনি ইয়াহিয়াকে মেনে নিয়েছেন, রাউন্ড টেবিল বৈঠকে যোগ দিয়েছেন, এমনকি সামরিক শাসকের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক মেনে নিয়ে তিনি সত্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের সব থেকে বড় দিক হলো বঙ্গবন্ধুর এই নিয়মতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হওয়া। ১৯৪৮ থেকে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অবধি দেখা যাবে কখনই বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিক পথ থেকে একচুলও সরেননি। আর বাঙালী জাতিকে চূড়ান্ত বিজয়ে নেবার পথে প্রতিটি স্তর তিনি পার করেছেন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে ও শতভাগ নিয়মতান্ত্রিক পথে। তাই বাঙালী জাতির বিজয়ের আন্দোলন পৃথিবীর মানুষের মুক্তির পথে অন্যতম নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে একটি উদাহরণ। এই নিয়মতান্ত্রিকতার পথেই হয় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। আর সেদিনই মূলত বাঙালীর পরবর্তী নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। নির্বাচনটি থাকে তখন কেবল মানুষের ভোট দেবার আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কারণ, ওই সময়ে দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে তাদের নেতা মেনে নিয়েছে। তারপরেও বঙ্গবন্ধু ধীরস্থির মাথায় পথ চলেছেন ’৭০-এর নির্বাচনের জন্য। কোনরূপ উস্কানি যাতে নির্বাচন পিছিয়ে যেতে বা বানচাল হতে সাহায্য না করে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সেজন্য খুব সাবধানে পথ চলেন তিনি। কারণ, তখন তাঁর জন্যে দরকার ছিল পাকিস্তানের একক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করার একটি আইনগত ভিত্তি। ’৭০-এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নিরঙ্কুশ মেজরটি পেয়ে বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করেন তিনিই পাকিস্তানের একক নেতা। এখানে অনেকেই ভুল করেন, তারা মনে করেন ইয়াহিয়া ভুল না করলে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবন মেনে নিতেন। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন ধরে তাঁর ভূখ-ে যে বাঙালী জাতীয়তাবাদী ধারা গড়ে তুলেছিলেন এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদের মূল নেতা হয়েছিলেন তা নিশ্চয়ই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্যে নয়। তাছাড়া দেশ স্বাধীনের পরে তিনি ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেন, সেই সব থেকে বড় সেনাপতি যিনি বিনা রক্তপাতে যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর প্রথম চেষ্টা ছিল বিনা রক্তপাতে যুদ্ধে জয়লাভ করা। অর্থাৎ পাকিস্তান পার্লামেন্ট ডেকে পার্লামেন্টের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশ পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া। এবং তিনি ১৯৭০-এর নির্বাচনের পরে তার সংসদ সদস্যদের যে শপথ পড়ান সেখানে পরোক্ষভাবে এমন কথা বলা হয়েছিল যে, কেউ তার কথার বাইরে যাবেন না। নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতা আনা বা বিজয় অর্জন করা ছিল তার প্রথম লক্ষ্য।
×