ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

ইসালে সওয়াব মাহফিল ॥ অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রকাশিত: ০৩:২৬, ১১ জানুয়ারি ২০১৯

ইসালে সওয়াব মাহফিল ॥  অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

ইসালে সওয়াব মাহফিল আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে যুগ পরম্পরাগতভাবে। এই ইসালে সওয়াব মাহফিলের অর্থ সওয়াব পৌঁছানোর সম্মেলন। সাধারণত বছরে একবার এই মাহফিল বিশেষ করে বিভিন্ন পীর সাহেবের খানকা শরীফে অনুষ্ঠিত হয়, আবার কোথাও কোথাও উরস নামেও এই মিলন উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। তবে লক্ষ্য করা গেছে উরসের নামে যেসব বার্ষিক মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় তার অধিকাংশই শিরক, কুফর বিদা’আত প্রভৃতি অনুষঙ্গ দ্বারা আচ্ছাদিত, যেখানে সওয়াব লাভের আশা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এর মানে এই নয় যে, সমস্ত উরসই ওই দোষে দুষ্ট। ৬ রজব আজমীর শরীফে সুলতানুল হিন্দ গরিবে নওয়াজ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতল্লাহি আলায়হির মাযার শরীফে যে উরস হয় সেখানে মানুষ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর মাযার শরীফ জিয়ারত করে বহু ফায়দা হাসিল করে। কিন্তু সেই উরসকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর শরিয়ত ও মারিফাত সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষ যে সমস্ত কার্যকলাপ করে তা শরিয়তসম্মত নয়। আমাদের দেশেও গজিয়ে ওঠা এমন কিছু খাজা বাবা, বিশ্বওলী সুফী সম্রাট, দয়াল বাবা লকবধারীদের কেন্দ্র করে মহা পবিত্র উরস শরীফের নামে যে সমস্ত কা--কারখানা চালু আছে সেগুলোতে শরিক হয়ে মহা মূল্যবান ইমান-আকিদা বরবাদ করা ছাড়া কোন লাভ হয় না, আবার এমন কিছু উরস অনুষ্ঠিত হয় যেখানে শরিক হলে রুহানি তরক্কী তো হয়-ই সেই সঙ্গে ইমান-আকিদা মজবুত বুনিয়াদ লাভ করে। যেমন প্রতি বছর ১৬ চৈত্রে অনুষ্ঠিত যশোরের খড়কী শরীফের উরস মুবারক। এই উরস শতাধিক বছর ধরে নির্দিষ্ট তারিখে হয়ে আসছে। এটার প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা ভাষায় রচিত সর্বপ্রাচীন নির্ভরযোগ্য মৌলিক ও প্রামাণ্য তাসাওউফ গ্রন্থ এরশাদে খালেকিয়া বা খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্ব গ্রন্থের লেখক হযরত মাওলানা শাহ সুফী মোহাম্মদ আবদুল করিম রহমাতুল্লাহি আলায়হি। এই গ্রন্থ সম্পর্কে প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান ও প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের যৌথ গ্রন্থনায় গ্রন্থিত ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের ইসলামী সাহিত্য পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আবদুল করিম ছিলেন নকশবন্দিয়া তরিকার একজন কামিল সুফী সাধক, নিজের জীবনে সুফী তত্ত্বের আমল করেছিলেন বলে দুরূহ সুফী তত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। প্রথম থেকে চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি তাসাওয়াফের জটিল দার্শনিক তত্ত্বের মনোজ্ঞ ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং পঞ্চম থেকে নবম অধ্যায়ে সুফী সাধনার নকশবন্দিয়া, কাদেরিয়া এবং চিশতিয়া তরিকার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। দশম বা শেষ অধ্যায়ে তিনি বেদ, পুরাণাদিতে প্রচলিত দার্শনিক বিষয়বস্তুর তত্ত্ব উদ্ঘাটন করে ইসলামী সুফী মতবাদের সঙ্গে তার একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। মোহাম্মদ আবদুল করিমের খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্বের মতো বাংলায় তাসাওয়াফ সম্পর্কিত বই আর দ্বিতীয়টি দেখা যায় না। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১৫৩)। এই গ্রন্থে উপযুক্ত পীরের লক্ষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে : ‘পীরকে লোভশূন্য হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। লোভী ব্যক্তিকে ফকির জ্ঞান করিতে হবে না এবং ফকির কখনও ঢং করিয়া অর্থোপার্জনের জন্য বুজুর্গী করিয়া বেড়ায় না। তাঁহারা সততই গুপ্ত থাকিতে চেষ্টা পান, প্রকাশ হওয়াকে ভালবাসেন না। ...যার কোন রিপু বলবত আছে, তাহাকে সিদ্ধ ফকির বলিয়া জানিতে হইবে না। ... তাহাদের মিষ্টালাপন-কুহক জাল হতে সতর্ক থাকিবেন।’ আমাদের দেশে এক শ্রেণীর উরসে লোক জড়ো করার জন্য যেসব প্রচারণা কৌশল প্রয়োগ করা হয় তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় তাতে বেশ এক বড় ধরনের ‘কিন্তু’ রয়েছে। আর এই কিন্তুকে দূর করার জন্য ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ফুরফুরা শরীফের পীর মুজাদ্দিদে যামান মাওলানা শাহ্ সুফী আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ফাল্গুন মাসের ২১, ২২, ২৩ তারিখ নির্ধারণ করে ফুরফুরা শরীফে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল কায়েম করেন যা আজও ওই তিন দিন ধরে সেখানে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তিনি এই মাহফিল সম্পর্কে বলেছেন : ‘আমি জানি, আল্লাহ্ বলিয়াছেন : ইয়া আইয়ুহাল লাযীনা আমানু কুও আনফুসাকুম ওয়া আহলিকুম্ নারা- হে ইমানদারগণ, তোমরা নিজেদিগকে ও নিজের পরিজনকে অগ্নি হতে রক্ষা কর।’ এই আয়াতের মর্ম অবলম্বনে আমার বাড়িতে দেশী-বিদেশী সকলকে আম দাওয়াত দিয়া বহু আলেম-ওলামা, হাফেজ, ক্বারী কর্তৃক ওয়াজ-নসিহত করাইয়া ও নিজে করিয়া, শরিয়তের হুকুম আহকাম জানাইয়া দেই। ... ৬০-৭০ খতম কুরআন শরীফ, সূরা এখলাস ও ফাতেহা, কলেমা ইত্যাদি পড়ানো হয়। এই সমস্তের সওয়াব হযরত নবী (সা)-এর ও যাবতীয় ওলি-আওলিয়া গওছ, কুতুব এবং যাবতীয় মুসলমানদের রুহের ওপর সওয়াব রেছানি করা হয়। এ জন্য এই মাহফিলের এক নাম ইসালে সওয়াব। এই মাহফিল যাহাতে আল্লাহ্ কায়েম রাখেন, তাহার চেষ্টা আমার পুত্রগণ, খলিফাগণ ও মুরিদগণ করিবেন। খলিফাগণের মধ্যে যদি কাহারও বাড়িতে এ রূপ মাহফিল করিতে কাহারও শক্তি হয়, তবে তিনি তাহা করিবেন। সাবধান! কেহ যেন অর্থের লোভে বা অন্য কোন রূপ মান-মর্যাদার জন্য না করেন। বিশুদ্ধ হেদায়েতের নিয়তে করিলে বহু নেকি পাইবেন। আরও সাবধান থাকিবেন যে, যেন এই মাহফিলে কোন প্রকার বেদয়াত ও হারাম কার্য বা নামাজের জামায়াত তরক না হয়। বাজে তামাসা ইত্যাদি না হয়।’ (মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমিন, ফুরফুরা শরীফের হযরত পীর সাহেব কেবলার বিস্তারিত জীবনী, প্রথম সংস্করণ, কলকাতা ১৯৩৯, পৃ-২৪২-২৪৩)। ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যামান হযরত মাওলানা শাহ সুফী আবু বকর সিদ্দিকী (র) তাঁর প্রধান প্রধান খলিফাগণের বাড়িতে তারিখ নির্ধারণ করে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল কায়েম করে যান- যা আজও অব্যাহত রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : শর্ষীনার ইসালে সওয়াব- যা অনুষ্ঠিত হয় ১৪, ১৫, ১৬ অগ্রহায়ণ, যশোরের (বর্তমান মাগুরা জেলা) দ্বারিয়াপুর শরীফের ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল যা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় ৪ মাঘ। এ ছাড়াও কুমিল্লার ধামতিতে, যশোরের ইনায়েতপুরে, ফরিদপুরের ডোবরায়, পটুয়াখালীর আমতলীতে, সাতক্ষীরার হামিদপুরে, নোয়াখালীর শ্রীনদীতে এবং অন্যান্য প্রায় শতাধিক স্থানে ইসালে সওয়াব মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন তারিখে। ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যামানের অন্যতম প্রধান খলিফা দ্বারিয়াপুর শরীফের পীর সাহেব কিবলা হযরত মাওলানা শাহ সুফী আলহাজ তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতল্লাহি আলায়হি তাঁর পীরের নির্দেশে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে যে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল কায়েম করেন তা আজও ৪ মাঘ তারিখেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে খতমে কুরআন বহুবার করা হয়। এ ছাড়াও বাদ মাগরিব তরিকতের নিয়ম অনুযায়ী এক ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে যিকর-আসকার, তা’লীম-তালকীন প্রদান করা হয়। হাজার হাজার মানুষ যখন একযোগে অনুচ্চস্বরে আল্লাহ্ আল্লাহ্ নাম মুবারক যিকর করে, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ যিকর করে কিংবা জীবনের তাবত গোনাহর কথা স্মৃতিতে এনে তওবার ফয়েজ রপ্ত করে রব্বানা জলামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা ওয়া তারহামনা লানা কুনান্না মিনাল খাসেরিন মনে মনে খেয়ালের সঙ্গে পাঠ করে এবং কাঁদতে থাকে তখন এক অনন্য পবিত্র পরিবেশ সমস্ত মাহফিল আঙ্গিনাজুড়ে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। এশার নামাজ বাদ শুরু হয় বিভিন্ন আলিমের ওয়াজ-নসিহত যা রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত চলে, একপর্যায়ে তাহাজ্জুদ আদায় করা হয়, তারপর বিভিন্ন স্থানে একজন একজন দাঁড়িয়ে সুমধুর স্বরে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম অর্থাৎ আস্সালাতু আস্সালামু আলায়কা ইয়া রসূলাল্লাহ পেশ করতে থাকে। তারপর ফজরের আজান হওয়ার পর ফজরের নামাজ আদায় করা হয়, তার পর যিকর-আসকার, তারপর মিলাদ মাহফিল ও কীয়াম অনুষ্ঠিত হয় অনন্ত পক্ষে দু’ঘণ্টা ধরে, তারপর সওয়াব রিসানী হয় আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে। তামাম আম্বিয়া কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম, শোহাদায়ে কেরাম, আজওয়াজে মুতাহিরা, আশারায়ে মুবাশশিরা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, তরিকতের ইমামগণ সমস্ত ওলী আল্লাহগণ, মুমিন-মুমিনাত, মুসলিমিন-মুসলিমাতসহ যাঁরা ইন্তেকাল করেছেন সবার রুহে সওয়াব পৌঁছানো হয় এবং বিশ্বশান্তির জন্য বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্যসহ তাবত বিষয়ে দোয়া করা হয়। এই সময় বিরাট সমাবেশে যে ক্রন্দনরোল ওঠে তা যেন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করতে থাকে। এসব ইসালে সওয়াব মাহফিলে শরিয়তবিরোধী কোন কিছু হয় না- হতেও পারে না। এসব ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিলকে হিদায়াত লাভের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বললেও অত্যুক্তি হয় না। প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের মাহফিল থেকে বহু লোক হিদায়াত লাভ করে নিজেদের জীবনকে ধন্য করেছে এবং হিদায়াত লাভ করে আসছে। ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে মানুষকে আলোকিত পথের দিকে আহ্বান করা হয়। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : উদ’উ ইলা সাবিলে রব্বিকা বিলহিকমাতি ওয়াল মাওইজাতিল হাসানা- মানুষকে তোমার রব্-এর পথে আহ্বান কর হিকমতের মাধ্যমে এবং সুন্দর সুন্দর ওয়াজ নসিহত দ্বারা। (সূরা নহল : আয়াত-১২৫)। ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল ওই আয়াতেকারিমা পালনের এক অনন্য ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিলের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
×