ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিআরটিসি অচলের ধারায় ॥ অগ্নিসন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত বাস-ট্রাকে সঙ্কট চরমে

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ১২ জানুয়ারি ২০১৯

 বিআরটিসি অচলের ধারায় ॥ অগ্নিসন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত বাস-ট্রাকে  সঙ্কট চরমে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অব্যাহত বেতন সঙ্কটে রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির সেবার মান কমছে। অর্থ সঙ্কটের মুখে কার্যত অচলের ধারায় যাচ্ছে সংস্থাটি। জানা গেছে, বিআরটিসির সারাদেশে ২১ ডিপোর মধ্যে শুধু কল্যাণপুর ছাড়া বাকি বিশটিতেই বেতন সঙ্কট চলছে। বিভিন্ন ডিপোতে দুই থেকে সর্বোচ্চ নয় মাস পর্যন্ত বেতন বকেয়া। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাস ও ট্রাক পরিচালনার আয় থেকেই মূলত প্রতিটি ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক বেতন দেয়া হয়। বর্তমানে সারাদেশে বিআরটিসি ডিপো সংশ্লিষ্টদের মাসিক বেতন সাত কোটি দশ লাখ টাকা। কর্তৃপক্ষ বলছে, ’১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে দেশজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা চলে দীর্ঘ সময়। বিআরটিসির অনেক বাস ও ট্রাক জ¦ালিয়ে দেয়া হয়, আতঙ্কে চালকরা গাড়ি চালানো বন্ধ করে দেয়। মূলত সে সময় থেকেই সঙ্কট শুরু। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নষ্ট হওয়া বাসগুলো সময়মতো মেরামত না হওয়া। সব মিলিয়ে বেতন সঙ্কট দেখা দেয়, যা বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। অব্যাহত বেতন সঙ্কটের মুখে রাজধানীর জোয়ার সাহারা বাস ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রায় ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘট করে। বুধবার মন্ত্রণালয় ও বিআরটিসির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আশ^াসে সঙ্কটের কিছুটা সমাধান হলেও শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েই গেছে। ’১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনীতির নামে নাশকতামূলক কর্মকান্ডে বিআরটিসির ১২১ বাস ভাংচুর ও ৪৬ বাস আগুনে পুড়ে যায়। এতে বিআরটিসির ৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। আবার ’১৪ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া চলমান নাশকতা ও সহিংসতায় বিআরটিসির ২৮ বাস ভাংচুর ও ১০ বাস আগুনে পুড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ৮০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিআরটিসি সূত্র মতে, এ বছরের আগস্টের মধ্যে ভারত থেকে নতুন ৫শ’ ট্রাক ও ৬শ’ বাস আনার কথা রয়েছে। এসব গাড়ি আনার পর বিভিন্ন ডিপোতে ভাগ করে দেয়া হবে। নতুন গাড়ি এলেই সঙ্কটের সমাধান হবে। তবে সূত্র জানায়, বিআরটিসিতে বেতন সঙ্কটের বড় কারণ চলাচলের উপযোগী গাড়ির সংখ্যা কমছে। অর্থাৎ নষ্ট গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। আর গাড়ি নষ্ট হলেই সহজে মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হয় না। অর্থ সঙ্কট কিংবা আর মেরামতের উপযোগী নয় কারণ দেখিয়ে দিনের পর দিন গাড়ি ডিপোতে ফেলে রাখা হয়। এর নমুনা হিসেবে দেখা গেছে, জোয়ার সাহারা ডিপোতে অন্তত ৮০ গাড়ি বিকল হয়ে আছে দিনের পর দিন। এরমধ্যে পোড়া বাস ১৯। এই ডিপোর ৬৮ বাস সচল থাকলেও প্রতিদিন গড়ে পঁচিশটির বেশি বাস নষ্ট থাকায় রাস্তায় বের হতে পারে না। বিআরটিসি সূত্রে জানা গেছে, বিআরটিসির ২১ ডিপোর মধ্যে ১৯ বাস ও দুটি ট্রাক। ঢাকায় বাস ডিপোর সংখ্যা ছয়টি। সারাদেশে বাস ডিপো রয়েছে, জোয়ার সাহারা, মতিঝিল, দিনাজপুর, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, সোনাপুর, পাবনা, বগুড়া, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, মীরপুর ও কল্যাণপুর। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি ট্রাক ডিপো রয়েছে। এসব ডিপোতে তিন হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের আগে বিআরটিসির একটি ডিপোর বেতন ছিল ২৫ লাখ টাকা। সর্বশেষ পে স্কেলে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখ টাকার বেশি। এভাবে প্রতিটি ডিপোয় বেতন দ্বিগুণ হয়েছে। বেতন বাড়ার পর বিআরটিসি বহরে যোগ হয়নি নতুন একটি গাড়িও। পাঁচ বছরের বেশি সময় শুধু আলোচনা চলছে এক হাজার ১শ’ নতুন গাড়ি আনার। সেটাও কার্যত আলোর মুখ দেখেনি। অথচ নষ্ট গাড়ি ও রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির তালিকা দিন দিন বেড়েছে। এতে সব ডিপোতে বেতন সঙ্কট বাড়তে থাকে। সব মিলিয়ে ২১ ডিপোর বেতন এখন সাত কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সরকারী প্রতিষ্ঠান বিআরটিসির পাঁচশতাধিক বাস বিভিন্ন ডিপোয় দীর্ঘদিন অচল পড়ে আছে। এসব বাসের মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণগুলো নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আর কম ঝুঁকিপূর্ণগুলো মেরামতের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। অধিক পুরোনো ও জরাজীর্ণ বাসের সংখ্যা ২৮৬ আর কম ঝুঁকিপূর্ণ আছে প্রায় ২৫০। ’১৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির এক বৈঠকে (একনেক) প্রধানমন্ত্রী অধিক পুরোনো ও জরাজীর্ণ বাসগুলো নিলামে তোলার নির্দেশ দেন। বিআরটিসির প্রশাসন বিভাগ থেকে জানা গেছে, বর্তমানে বিআরটিসির ১ হাজার ৫৩৬ বাসের মধ্যে এখন সচল ৯০০ বাস। এগুলোর মধ্যে কিছু বাস বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করে। ২০১০-১৩ পর্যন্ত বিআরটিসিকে বিভিন্ন ধরনের ৯৫৮ বাস কিনে দেয় সরকার। তবে বাজেট বরাদ্দ না থাকা ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দ্রুতই ওগুলো নষ্ট হতে থাকে। পরিবহন সঙ্কট রোধ ও শহরের দূষণ কমাতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ২৫ সিএনজিচালিত একতলা বাস কেনা হয়। পরে বাস্তবায়ন, পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের মূল্যায়নে দেখা যায়, সরবরাহকৃত বাসগুলো স্পেসিফিকেশন মতো ছিল না, তা বিশেষজ্ঞ দিয়ে যাচাইও করা হয়নি। পরবর্তীতে লগবই পরীক্ষায় দেখা যায়, বাসগুলো নিয়ম মাফিক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। ওই বিভাগের মূল্যায়নে এটাও উঠে এসেছে, ঢাকার রাস্তার সঙ্গে সঠিকভাবে মানানসই না হওয়ায় এবং সঠিকভাবে পরিচালিত ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারায় বাসগুলো নিয়ে বিআরটিসিকে দুরবস্থায় পড়তে হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির এক প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দরপত্রে আর্টিকুলেটেড বাসের আয়ুষ্কাল ১২ বছর। অথচ ’১৩ সালের ডিসেম্বরে সংগ্রহ করা ৫০ আর্টিকুলেটেড বাস দুই বছরের মাথায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ’১৬ সালের ১৮ জানুয়ারি এক চিঠিতে বিআরটিসির নতুন কেনা ৪২৮ বাসের মান ও ক্রয় প্রক্রিয়ার ওপর বিআরটিসির মতামত চেয়ে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, বাসে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, বাস জরাজীর্ণ হয়ে পড়া, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র কাজ না করাসহ নানান ত্রুটির বিষয়ে আইএমইডির পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকিউরমেন্ট অব ডাবল ডেকার, সিঙ্গেল ডেকার এ্যান্ড আর্টিকুলেটেড বাসেস ফর বিআরটিসি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৩৭৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় ৪২৮ বাস কেনা হয়। এর মধ্যে ’১২ সালে ২৯০ দ্বিতল বাস (ডাবল ডেকার), ১৩ সালে ৫০ আর্টিকুলেটেড বাস এবং ৮৮ একতলা এসি বিআরটিসির বহরে যোগ হয়। তিনটি প্যাকেজে এসব বাস সরবরাহ করে ভারতীয় কোম্পানি অশোক লেল্যান্ড লিমিটেড। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশী এজেন্ট ইফাদ অটোস লিমিটেড। এসব বাস ঢাকার ভেতরে ও দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলের জন্য বরাদ্দ দেয় বিআরটিসি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাস্তায় বাস নামার দুই-তিন বছর চলতে না চলতেই বেশিরভাগ বাস জরাজীর্ণ কিংবা অকেজো হয়ে পড়ে। বিআরটিসি জোয়ার সাহারা বাস ডিপোর ম্যানেজার নূর ই আলম বলেন, কল্যাণপুর ছাড়া বাকি সবকটি ডিপোতেই দুই থেকে নয় মাস পর্যন্ত বেতন সঙ্কটের মধ্যেই সবাই কাজ করছেন। আশা করি নতুন বাস ও ট্রাক এলে চলমান সঙ্কটের সমাধান হবে। বাস নষ্ট থাকা ও রাজনৈতিক সহিংতায় গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিআরটিসির আয় কমেছে। তাছাড়া সর্বশেষ বেতন স্কেলের কারণে বেতন বাড়লেও আয়ের উৎস বাড়েনি। ফলে সঙ্কট বেড়েছে ১৪ সালের পর থেকেই। জোয়ার সাহারা ডিপোর সঙ্কট সমাধান ॥ নয় মাসের বকেয়া বেতন কয়েক কিস্তিতে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দিয়েছে বিআরটিসির জোয়ার সাহারা ডিপোর চালক ও শ্রমিকরা। তাদের কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিন বুধবার ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মুস্তাক আহমেদ ডিপোয় গিয়ে কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়ে শ্রমিকদের কাজে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। ডিপোর ব্যবস্থাপক নূর-ই-আলম বলেন, কর্মীদের হাতে হাতে এক মাসের ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৫ টাকা দেয়া হয়েছে। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে তারা পাবেন আরও এক মাসের টাকা। এরপর জুলাই পর্যন্ত প্রতি মাসের বেতনের সঙ্গে ধাপে ধাপে বাকি টাকা পরিশোধ করবে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ। এই প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর আন্দোলনরত চালক ও শ্রমিকরা বেলা পৌনে বারোটার দিকে ধর্মঘট তুলে নেয়ার ঘোষণা দেন এবং ডিপো থেকে গাড়ি বের হয়। বিআরটিসির জোয়ার সাহারা ডিপোতে একতলা, দ্বিতল এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিলিয়ে ৬৮ বাস সচল রয়েছে। এসব যানবাহনের আয় থেকেই কর্মীদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে লোকসানের কারণে প্রায় ২৫০ কর্মীর বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ে। সেই বকেয়া পরিশোধের দাবিতে মঙ্গলবার ভোরে জোয়ার সাহারা ডিপোর প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে কর্মবিরতি শুরু করে চালক-শ্রমিকরা। তাদের এই আন্দোলনে বুধবার দুপুর পর্যন্ত টঙ্গী-মতিঝিল, আবদুল্লাহপুর-মতিঝিল, কুড়িল বিশ্বরোড-পাঁচদোনা রুটে বিআরটিসির একতলা ও দোতলা বাস এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের স্টাফ বাস চলাচল বন্ধ থাকে। বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া মঙ্গলবার বিকেলে ডিপোয় গিয়ে তিন মাসের মধ্যে বেতন পরিশোধের আশ্বাস দিলেও শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। বুধবার সকালে ডিপোতে এসে আবার বিক্ষোভ শুরু করে তারা। এই পরিস্থিতিতে সকালে ডিপোতে গিয়ে ধর্মঘটিদের সঙ্গে আলোচনা করেন পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মুস্তাক আহমেদ। পরে তিনি বলেন, বিআরটিসি চেয়ারম্যান আমাকে পরিস্থিতির বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। আমি এসে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রতিশ্রুতি পেয়ে শ্রমিকরা উঠে গেছে। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের সমস্যা আমাদের কারও কাম্য নয়। আমি চালক ও কর্মীদের বলেছি, তারা যেন বকেয়া পরিশোধের সর্বশেষ পরিস্থিতি আমাকে জানায়। আমিও খবর রাখব। বকেয়া বেতনের দাবিতে গত বছর জুলাই মাসেও একবার আন্দোলনে নেমেছিল জোয়ার সাহারা ডিপোর চালকরা। তখন তাদের ১০ মাসের বেতন বকেয়া ছিল।
×