ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

বাঙালীর গর্ব মহাকাশে জয় বাংলা

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১৩ জানুয়ারি ২০১৯

বাঙালীর গর্ব মহাকাশে জয় বাংলা

বছরটি যখন শেষ হয়েছে, যখন শেখ হাসিনার সরকার দশক অতিক্রম করে আরও ৫ বছর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে তখন ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে ১৮ সালটার প্রাপ্তির দিকে একটু ফিরে তাকানো যায়। একবারে তো সবগুলোর কথা বলা যাবে না তাই একটু একটু করে বিষয়গুলো তুলে ধরতে চাই। বস্তুত, ১৮ সালের সকল অর্জন এত ব্যাপক যে তার প্রতিটির জন্য ভিন্ন ভিন্নভাবে আলোচনা হতে পারে। তবে কিছু কিছু বিষয় আছে যা কোন সময়ের নিরিখে আলোচিত নয়, বরং জাতীয় অর্জন হিসেবে গৌরবের। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১৮ সালের তেমন একটি মহান অর্জন। বরং এই অর্জন কেবল ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে নয়, জাতীয় গৌরব হিসেবেই এটি এই জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন। বাংলাদেশের একটি নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকতে পারে এই ভাবনার সূচনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়কালে। তিনি ১৯৭৫ সালের জুন মাসের ১৪ তারিখে বেতবুনিয়ায় উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র উদ্বোধনের সময় মহাকাশে দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারই সুযোগ্যা কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর রূপকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের লক্ষ্য স্থির করেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের মে মাসে বিটিআরসির কমিশনার (এসএম) কে আহ্বায়ক করে গঠিত ‘স্যাটেলাইট কমিটি’ কর্তৃক ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ নামকরণের মাধ্যমে প্রকল্পের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়। উল্লেখ্য, জাতীয় আইসিটি পলিসি ২০০৯ অনুযায়ী ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসি মহাকাশে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। ২০১৮ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ সফলভাবে উৎক্ষেপণ এবং সেটির সফল পরিচালনা করাটাই অন্যতম বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার। কাজটি সুসম্পন্ন করা ছাড়াও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উপগ্রহ ভূকেন্দ্রের নামকরণ তারই দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এর নামে করতে পেরেছি। আরও স্বস্তির বিষয় যে, আমরা সফলতার সঙ্গে কেবল উৎক্ষেপণের কাজটিই সম্পন্ন করিনি, এটি আমাদের স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কোম্পানির আওতায় এসেছে, এটির চমৎকার ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং পুরো জাতির জন্য এটি গৌরবের সবচেয়ে বড় প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণের সর্বশেষ উদ্যোগের বাইরেও কিছু অতীত কথা আছে। আমার মনে আছে শেখ হাসিনা যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন তখন ৯৭ সালে ‘কেমন করে বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রফতানি করা যায়’ তার উপায় উদ্ভাবন করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করেন। সেই টাস্কফোর্সের প্রধান ছিলেন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। আমিও সেই টাস্কফোর্সের সদস্য ছিলাম। টাস্কফোর্স মোট ৪৫টি সুপারিশ প্রদান করেছিল। কমিটির কাছে আমি বাংলাদেশের একটি নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকার সুপারিশ করতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু টাস্কফোর্স ‘সময় হয়নি’ এই বিবেচনায় প্রস্তাবটি সুপারিশ আকারে পেশ করেনি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বসে থাকেননি। তার সরকার বাংলাদেশের একটি স্যাটেলাইট পাবার প্রকল্প গ্রহণ করে। জাপান সরকার সেই প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে সম্মতিও প্রদান করে। তৎকালীন মন্ত্রী নুরু উদ্দীন খান আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনার বিষয়টি সম্পর্কে জানান। প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হবার প্রাথমিক কারণ ছিল যেÑ জাপানী অর্থায়ন নিশ্চিত করা সময়সাপেক্ষ হয়ে যায়। অন্যদিকে ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকার সেই প্রকল্পটি বাতিল করে। তারই ফলে স্যাটেলাইট নিয়ে আমাদের ভাবতে হয় ২০০৯ সালে। এরপর ১২ সালে ৮৬.৮১ কোটি টাকার একটি প্রস্তুতি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় ১৪৬.৪১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এ প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের উদ্দেশে ‘স্যাটেলাইট কমিটি’ বিস্তারিত বিবরণসহ টেন্ডার দলিল প্রস্তুত করে। এ প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলে ৩২টি পরামর্শক সংস্থা প্রস্তাব দাখিল করে। মূল্যায়নের পর বাছাইকৃত ৭টি সংস্থার কাছে দরপ্রস্তাব চাওয়া হয় এবং প্রাপ্ত দরপ্রস্তাব মূল্যায়ন করে সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কর্তৃক অনুমোদনের পর ‘এসপিআই’ নামক মার্কিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত ২৯ মার্চ ২০১২ তারিখে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অরবিটাল স্লট : স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য অরবিটাল স্লট একটি প্রধান ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে বাংলাদেশের ফাইলিংকৃত ৭৪ ডিগ্রী, ১৩৩ ডিগ্রী, ৬৯ ডিগ্রী এবং ১০২ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশ অরবিটাল স্লটসহ অন্যান্য অরবিটাল স্লট নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। বাংলাদেশের নিজস্ব ফাইলিংকৃত উপরোক্ত অরবিটাল স্লটগুলোর কো-অর্ডিনেশন জটিলতা এবং তরঙ্গ ব্যবহারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয়তার নিরিখে বিকল্প অরবিটাল স্লট অনুসন্ধান করা হয়। এই অনুসন্ধান কালে ৪৫ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমা হতে ১৩৫ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমা পর্যন্ত আর্কের মধ্যে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিক এর ১১৯.১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমা অরবিটাল স্লট লিজ/ক্রয়ের মাধ্যমে ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যায় এবং সার্বিক দিক বিবেচনায়, প্রকল্পের কারিগরি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসপিআই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের জন্য ১১৯.১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশ অরবিটাল স্লটটি উপযোগী হিসেবে সুপারিশ করে। অতঃপর ইন্টার স্পুটনিকের সঙ্গে প্রথমে একটি এমওইউ স্বাক্ষর হয় এবং পরে মোট ২৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার মূল্যে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে একটি ব্যবসা পরিকল্পনাও তৈরি করা হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প অনুমোদন : বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ সংক্রান্ত কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য পরামর্শকের সহায়তায় প্রস্তুতকৃত ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ’ শীর্ষক প্রকল্পের ‘ডিপিপি’ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং পরিকল্পনা কমিশনে দীর্ঘ পর্যালোচনার পর গত ১৬/০৯/২০১৪ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ‘একনেক’ সভায় মোট ২৯৬৭.৯৫৭৭ কোটি টাকায় (জিওবি ১৩১৫.৫১৩৫ কোটি টাকা ও প্রকল্প সাহায্য ১৬৫২.৪৪৪২ কোটি টাকা) প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের সংশোধিত মূল্য মোট ২৭৬৫.৬৬২৫ কোটি টাকা (জিওবি ১৪০৬.৯০৫৩ কোটি টাকা ও প্র:সা: ১৩৫৮.৭৫৭২ কোটি টাকা)। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ’ প্রকল্পের প্রধান অঙ্গসমূহ হলো ঃ স্যাটেলাইট নির্মাণ, কক্ষপথে উৎক্ষেপণ, দুটি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন স্থাপন ও ফ্যাসিলিটি নির্মাণ, স্যাটেলাইট পরিচালনার জন্য একটি আন্তর্জাতিকমানের কোম্পানি গঠন, প্রয়োজনীয় বীমা সংগ্রহ, অরবিটাল স্লট লিজ/ক্রয় এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনা। স্যাটেলাইট সিস্টেম ক্রয় : বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিস্টেম ক্রয়ের উদ্দেশে বৈদেশিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান-এর সহায়তায় কারিগরি বিনির্দেশ ও দরপত্র প্রণয়ন করা হয়। প্রণীত টেন্ডার দলিলের ভিত্তিতে মার্চ ২০১৫ তে আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হলে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডা ও চীনের মোট ০৪টি স্যাটেলাইট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। মূল্যায়ন কমিটির বিচার বিশ্লেষণের পর ফ্রান্সের থ্যালাস এলেনিয়া কোম্পানি একমাত্র সফল দরদাতা হিসেবে নির্বাচিত হয়। ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি স্যাটেলাইট সিস্টেম ক্রয় প্রস্তাবটির অনুমোদন দেয়ার পর ১১ নবেম্বর ২০১৫ তারিখে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীসহ সংসদীয় কমিটির মাননীয় সদস্যবৃন্দ, কূটনীতিক ও দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের উপস্থিতিতে থ্যালাসের সঙ্গে মোট ১৯৫১,৭৫,৩৪,৪৮২/- টাকা মূল্যে স্যাটেলাইট সিস্টেম ক্রয়ের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (সংশোধিত চুক্তি মূল্য কমে গিয়ে মোট ১৯০৮৭৫ কোটি টাকা)। কাভারেজের আওতা : কারিগরি বিনির্দেশ ও চূড়ান্ত ডিজাইন অনুযায়ী ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ ১১৯.১ ডিগ্রী পূঃদ্রাঃ অরবিটাল লোকেশনে সফল তরঙ্গ সমন্বয় সাপেক্ষে সমগ্র বাংলাদেশ, সার্কভুক্ত দেশসমূহ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং ‘স্তান’ ভুক্ত দেশসমূহের অংশবিশেষ কাভারেজের আওতায় আসবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর কমিউনিকেশন মডিউল ও সার্ভিস মডিউল : ২০১৭ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর প্রধান দুটি মডিউল (কমিউনিকেশন মডিউল ও সার্ভিস মডিউল) তৈরি ও একীভূতকরণ এর কাজ এবং সোলার প্যানেল, এন্টেনা তৈরির কাজ শেষ হয়। প্রকল্পের বৈদেশিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এর ০২ জন অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও তদারকিতে থ্যালাসের উক্ত ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাসিলিটিতে বর্ণিত কার্যাদি সম্পন্ন হয়। বস্তুত, ২০১৬ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর নির্মাণ কাজ চলতে থাকে। নির্মাণ কাজ শেষে গত ১৭-২১ নবেম্বর ২০১৭ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর প্রিশিপমেন্ট সম্পন্ন করার আগে প্রায় ৬ মাস ধরে মোট ৪টি ধাপে থ্যালাস কর্তৃক সকল প্রকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সফল উৎক্ষেপণ : স্যাটেলাইটটি মহাকাশে উৎক্ষেপণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস এক্সকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সকলের নিরলস পরিশ্রম শেষে বহুল প্রতীক্ষিত বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’, উৎক্ষেপণের জন্য চূড়ান্তকৃত দিনক্ষণ অনুযায়ী গত ১১ মে ২০১৮ যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বিকাল ৪:১৪ মিনিট অর্থাৎ ১২ মে ২০১৮ বাংলাদেশ সময় ভোর রাত ২:১৪ মিনিট-এ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেইপ ক্যানাভেরাল-এ অবস্থিত লঞ্চপ্যাড থেকে লঞ্চ ভেহিকেল ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। এমন প্রস্তাবনা ছিল যে মন্ত্রী হিসেবে আমি যেন উৎক্ষেপণকালে উপস্থিত থাকি। কিন্তু আমি দুটি কারণে এই উৎক্ষেপণে উপস্থিত থাকিনি। প্রথমত. যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তির উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সেখানে ছিলেন- তাই আমার থাকার প্রয়োজন ছিল না। দ্বিতীয়ত. স্যাটেলাইট উদ্বোধনের পরের দিন আমরা দেশে একটি জাতীয় উৎসব উদযাপন করব। যথাসময়ে উৎক্ষেপণের কাজটি না হবার ফলে আমরা সেই অনুষ্ঠানটি দেরিতে করি। ৩১ জুলাই ১৮ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করে আমরা বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ জাতীয়ভাবে উদযাপন করি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোন কাজে লাগবে : সংক্ষেপে জানা যেতে পারে যে, এই স্যাটেলাইট আমাদের কোন্ কোন্ কাজে লাগছে। ১. বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে উন্নত টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার সেবা প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক ডিজিটাল সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীদের সরাসরি শহরের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে না গিয়েও রোগীর টেস্ট রিপোর্ট এক্সরে-ইমেজ ইত্যাদি তথ্য ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে শেয়ার করে চিকিৎসা সেবা নেয়ার জন্য যে টেলি-মেডিসিন প্রযুক্তি আছে তাও সম্ভব হবে এ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। যেহেতু বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কভারেজ দেশের সর্বত্র বিদ্যমান তাই দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, চরাঞ্চল ও দ্বীপের এ সকল সেবা প্রদান করা যাবে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দূরের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত প্রফেসরের ক্লাস ই-লার্নিং বা ই-এডুকেশন পদ্ধতিতে ঘরে বসে সম্পন্ন করা যাবে। দেশে ব্যাপকভাবে ডিজিটাল কানেক্টিভিটির প্রসার ঘটার পরও দুর্গম এলাকার জন্য স্যাটেলাইটের সহায়তা খুবই প্রয়োজনীয় হবে। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য বিপর্যয়ের সময় স্যাটেলাইট খুবই প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে। ২. কোনরূপ কেবল সংযোগ ছাড়াই ঘরে রিসিভার যন্ত্র স্থাপন করে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ডিটিএইচ (ডাইরেক্ট টু হোম) প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্যাটেলাইট টিভির বিভিন্ন চ্যানেল দেখা যাবে। ডিজিটাল এ পদ্ধতিতে টিভি চ্যানেলের গুণগতমান কেবল টিভির চেয়ে অনেক উন্নত। ডিটিএইচসহ স্যাটেলাইটভিত্তিক নতুন সেবার মাধ্যমে নতুন আয়ের সুযোগ হবে এবং এসব বিভিন্ন সেবায় লাইসেন্স ফি ও স্পেকট্রাম চার্জ বাবদ সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। ৩. যেসব স্থানে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল স্থাপন করা সম্ভব নয় অথবা রেডিও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক নেই সেসব জল ও স্থলসীমায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার সেবা প্রদান করা যাবে। ৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ অর্থাৎ ঝড়, বন্যা বা ভূমিকম্পে টেলিযোগাযোগের জন্য ব্যবহƒত অপিটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক বা ট্রান্সমিশন টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হবে। ৫. বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার এর মধ্যে ২০টি বাংলাদেশের জন্য এবং ২০টি দেশের বাইরের জন্য ব্যবহার করা যাবে। এ ২০টি ট্রান্সপন্ডার লিজ বা ভাড়া প্রদান করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। অর্থাৎ বর্তমানে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে তার পরিবর্তে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হব। ৬. বর্তমানে বিটিভি ওয়ার্ল্ডসহ দেশের সব কয়টি বেসরকারী টিভি চ্যানেল অনুষ্ঠানসূচী সম্প্রচারের জন্য বিদেশী স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ফলে বিদেশী স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীলতা আর থাকবে না এবং বিদেশী স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ প্রদেয় বিপুল বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। ৭. স্যাটেলাইট টেকনোলজি ও সেবার প্রসারের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে যা দেশের বেকারত্ব কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে। সর্বোপরি স্পেস টেকনোলজির জ্ঞান সমৃদ্ধ একটি মর্যাদাশীল জাতি গঠনে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট অনবদ্য ভূমিকা রাখবে। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর ৫৭ তম দেশ হিসেবে গৌরব অর্জন করায় বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে মহাকাশ প্রযুক্তি ব্যবহারের পথ উম্মুক্ত হয়েছে। এর ফলে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ভূমিকা হবে সুদূরপ্রসারী। হেনরী কিসিঞ্জারের তলাহীন দেশটি আজ তার স্যাটেলাইটটির গায়ে জয় বাংলা লিখে মহাকাশে উড্ডীন করতে পেরেছে; সেটি পুরো জাতির জন্য এক মহা গৌরবের। আমার নিজের কাছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিয়ে তিনটি বিশেষ অহঙ্কারের বিষয় আছে। প্রথমত, এই প্রকল্পটি আমরা নির্ধারিত বাজেটের কমে সম্পন্ন করতে পেরেছি। দ্বিতীয়ত, এটি সর্বোচ্চ ১৫ বছর চলমান থাকার কথা থাকলেও এখনকার মূল্যায়ন অনুসারে এর আয়ু ১৮ বছর হবে। তৃতীয়ত, এই স্যাটেলাইটটি পরিচালনা করছে আমাদের সন্তানরা। এবার আমরা স্বপ্ন দেখতেই পারি যে, শেখ হাসিনার হাত ধরে আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ মহাকাশে প্রেরণ করব। আমাদের বড় সুবিধা হচ্ছে যে আমাদের সন্তানরা পরের স্যাটেলাইট যেমন চালাতে পারবে তেমনি আমাদের নতুন করে উপগ্রহ ভূকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে না এবং প্রধানমন্ত্রী সামগ্রিক বিবেচনায় মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চার জন্য দেশের প্রথম এ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়টির আইনও পাস করেছেন। কৃতজ্ঞতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি যিনি কেবল স্যাটেলাইট করেননি এর ভবিষ্যতটাও নির্ধারণ করেছেন। আমি আশা করি, সহসাই আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর কাজ শুরু করব। লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সম্পাদক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
×