ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ফলেন পরিচয়তে

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১৪ জানুয়ারি ২০১৯

 ফলেন পরিচয়তে

‘বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়’ অনেক পুরনো প্রবাদ হলেও বাস্তবতায় তা আজও সমান প্রযোজ্য। ফল দিয়েই তো জানা যায় ফলদ বৃক্ষের নাম। বাংলাদেশকেও অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বে চেনা-জানার ক্ষেত্রে ফলের নাম যে সামনে আসবে তাতে সন্দেহ নেই। ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ দশম দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এ স্থান থেকে উত্তরণে বাংলাদেশকে উৎপাদন ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারণ করার বিকল্প নেই। ফলে ফলময় হয়ে উঠবে বাংলাদেশ একদিন সেদিকেই দেশ ধাবিত হচ্ছে বলে এখন প্রতীয়মান হয়। ‘অপ্রতিরোধ্য দেশের অগ্রযাত্রা, ফলের পুষ্টি দেবে নতুন মাত্রা’- এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত আজ বাংলাদেশের ফলচাষী এবং ফলাহারীরা। এ জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় এবং সাবেক কৃষিমন্ত্রীকে সাধুবাদ ও অভিনন্দন জানাতে হয়। তাদের অদম্য উৎসাহ আর কঠোর শ্রম বাংলাদেশকে ফল চাষে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে। এমনকি ভোক্তার সংখ্যাও ক্রমে বেড়েই চলেছে। বাস্তব যে, খাদ্য ও পুষ্টির অন্যতম উৎস ফল। মানবদেহের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, মেধার বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। পুষ্টিবিদরা বলেন, দৈনিক মাথাপিছু দুই শ’ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। দেশে যে পরিমাণ ফল উৎপাদন হচ্ছে তা চাহিদার চেয়ে কম হলেও ফল খাওয়ার পরিমাণ গত এক যুগে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৬ সালে যেখানে এ দেশের মানুষ দিনে ৫৫ গ্রাম করে ফল খেত তা এখন ৮৫ গ্রামে উঠে এসেছে। এক সময় আম ও কাঁঠাল ছিল প্রধান ফল। আর এখন ২২ প্রজাতির ফল দেশের মানুষ নিয়মিত খায়। ফলাসক্তি বাংলার মানুষের বাড়ছে, তাই গড় আয়ুও বেড়েছে। অসুখে-বিসুখে ফল খাবার চাহিদা অত্যধিক হওয়ার কারণ কম দামে হাতের নাগালে পাওয়া। আগে যেখানে ৫৬ প্রজাতির ফল চাষ হতো, এখন সেখানে হয় ৭২ প্রজাতির। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে এ দেশে গত ১৮ বছর ধরে ফল উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে। একই সঙ্গে বিশ্বের চারটি ফল উৎপাদনে শীর্ষ দশম স্থানে অবস্থানের কারণ উৎপাদনে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে অধিক। বর্তমানে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে, মৎস্য ও ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, সার্বিকভাবে মাংস উৎপাদনে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। ধান, মাছ, মাংসের মতো সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কয়েকটি খাতে বাংলাদেশ কেবল স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, তার অবস্থান ক্রমশ সামনের সারিতে চলে আসছে। গত দশ বছরে শেখ হাসিনার সরকারের একান্ত প্রচেষ্টায় ফল রফতানি প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। ফলের মান রক্ষা করা গেলে রফতানি আরও বাড়বে। দেশী ফলের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে নতুন নতুন রফতানির ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব। শুধু দেশী ফল নয়, বিদেশী ফলের উৎপাদন ও ভোক্তা বাড়ছে। সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর আগ্রহ ও উৎসাহে আঙ্গুর, ড্রাগন, স্ট্রবেরি, এ্যাভোকাডো, ডুমুর, মাল্টা, রাম্বুটান, বেল, নারিকেল, জাম্বুরা, রঙ্গন, সূর্যাডম ও খেজুরের বেশ কয়েকটি জাতের চাষও দেশে দ্রুত বাড়ছে। এসবই বিশ্বের অন্যতম পুষ্টিকর ফল। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতাকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয়েছে। উৎপাদনে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে ‘রোল মডেলে’ পরিণত হবে নিঃসন্দেহে। সবচেয়ে কম জমি আর অধিক মানুষের এই দেশে ফল উৎপাদনে শীর্ষে পৌঁছার পেছনে যে শ্রম ও নিষ্ঠা রয়েছে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একই সঙ্গে নিত্যনতুন ফল চাষের দিক থেকেও সাফল্য অনেক বেশি। গ্রামীণ মা ও শিশুদের অপুষ্টিজনিত রোগ নিরসনে এবং বিকল্প ও সুষম খাদ্য হিসেবে ফলের অবদান অতুলনীয়। ফলের গুরুত্বপূর্ণ দিকসহ বাড়তি খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি জনগণের টেকসই পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এমনিতেই বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের বিদ্যমান সুযোগগুলো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে দেশবাসী আশাবাদী হয়ে উঠছে। ক্রমবর্ধমান পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য ফলের উৎপাদন ও এলাকা বাড়ানো জরুরী। এ দেশের আবহাওয়া ফল চাষের উপযোগী। তাই বছরব্যাপী ফলপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে মানসম্মত চারা, কলম উৎপাদন, নতুন নতুন ফলের জাত উদ্ভাবন এবং আধুনিক উদ্যান প্রযুক্তি বিষয়ে চাষীদের দক্ষ করে তোলার জন্য নয়া ‘হর্টিকালচার সেন্টার’ স্থাপন অত্যাবশ্যক। তদুপরি প্রয়োজনীয় ফল সংরক্ষণ সঠিক পদ্ধতিতে না করায় প্রতিবছর ত্রিশ শতাংশ ফল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষণ সংক্রান্ত সমস্যায় ক্ষতির পরিমাণ যাতে না বাড়ে সেজন্য কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহন ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া অনুসরণের বিকল্প নেই। বলা যায়, ফল চাষে বাংলাদেশে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। ফলময় ফলের ভান্ডার হবে একদিন বাংলাদেশ আর বিশ্ববাসীর চাহিদা মেটাতে হবে সহায়ক। আর বাংলাদেশও বিশ্বে পরিচিত হবে ফলের দেশ হিসেবে। ফলে হোক পরিচয় ‘ফলেন পরিচয়তে।’
×