ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

গফরগাঁওয়ের লাফা বেগুন

ডিম্বাকৃতি, ঢেউ খেলানো অমসৃণ ॥ আসছে সোনালি দিন

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯

ডিম্বাকৃতি, ঢেউ খেলানো অমসৃণ ॥ আসছে সোনালি দিন

শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ বেগুন বেগুন কাব্য আমার গায়ে দিচ্ছো তুমি আগুন, ঝলছে যাওয়া খোসা ছিলে তেল, নুন, ঝাল লঙ্কা দিয়ে পেঁয়াজ কেটে ঝাঁঝিয়ে দিয়ে অবশেষে চটকে দিলে! আহা! আপনার কী গুণ! বলুন তো দাদা আমি কি বেগুন। ২০ বছর আগে প্রায় বিলুপ্ত গফরগাঁওয়ের লাফা বেগুন আবার ফিরে পাচ্ছে তার হারানো যৌবন। বেগুনের নাম কেন বেগুন হয়েছে, সে রহস্য উদ্ঘাটন খুব সহজ নয়। বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় অতি চেনা এই সবজিটির নামকরণ হয়েছে বড় হেলাফেলা করে। নামে তার যত নির্গুণের বহির্প্রকাশ থাকুক না কেন বাস্তবে কিন্তু ঠিক তার উল্টো। বেগুনের বেগুনী বা সবুজ বর্ণের যে চামড়া তার যে উচ্চমাত্রার এন্টিঅক্সিডেন্ট গুণাগুণ রয়েছে, তা এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। রয়েছে বহু রকমেরÑ ছোট,বড়, ডিম্বাকার বেগুনের জাতও। তেমনি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গফরগাঁওয়ের লাফা বেগুন (গোল বেগুন)। একটা সময় ছিল যখন গফরগাঁও রেলস্টেশনে হকার ডাক ছেড়ে বলছে, লাগবনি ভাই লাগবনি গোল বাইগুন লাগবনি। ভাই আইলে নারে/দেখলে নারে/খাইলে নারে গফরগাঁওয়ের গোল বেগুন। এমন গানের সুর শোনা যেত ব্রহ্মপুত্র নদের পালতোলা নৌকার মাঝিমাল্লার, মাঠেঘাটে কৃষক-শ্রমিকের মুখে মুখে এ বেগুন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে নানা গান, কবিতা। আর এখনও এসব গান-কবিতা মানুষের মুখে মুখে। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের লাফা বেগুনের স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। বেগুনের আকৃতি গোল কিন্তু দেহ মসৃণ নয়। ঢেউ খেলানো খাঁজকাটা। দেশের ঐতিহ্যবাহী এ বেগুনের নাম ‘লাফা বেগুন’। অনেকেই একে গোল বেগুন বলে ডাকে। বড়া ও ভাজির জন্য প্রসিদ্ধ ও সুস্বাদু এ বেগুন। কথিত আছে, আগে কোন বিয়ের উৎসবে ঐতিহ্যবাহী লাফা বেগুন খাদ্যের তালিকায় না থাকলে বরপক্ষের খাবারে অপূর্ণতা থেকে যেত। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, বরকে বড় থালায় খাবার দেয়া হলে সেই থালায় লাফা বেগুনের ভাজা না থাকলে বর বিয়েতে অস্বীকৃতি জানাত। অতীতে একহালি (প্রায় ১০ কেজি) বেগুন নিয়ে বড় কোন কর্মকর্তার দরজায় হাজির হলে মিলে যেত সরকারী চাকরি। এখন নানা সমস্যার কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে লাফা বেগুন। আবারও চাষ করছে গফরগাঁওয়ের চর আলগী নয়াপাড়া গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে মাসুদ মিয়া। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার চর আলগী ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় লাফা বেগুনের চাষ হতো। একটি বেগুনের ওজন হতো ২/৩ কেজি পর্যন্ত। কোন প্রকার সার প্রয়োগ ছাড়াই এ বেগুন উৎপাদন হতো। তবে প্রাকৃতিক জৈবসার কিছু নিয়ম-কানন, পাকপবিত্র হয়ে এ বেগুনের চাষ করা হয় বলে জানান কৃষক। কোন রকম অপবিত্র শরীর নিয়ে লাফা বেগুন ক্ষেতে গেলে কয়েকদিন পরেই বেগুনের গাছ মরে যায়। কয়েক বছর যাবৎ ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনে লাফা বেগুন চাষাবাদের জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। লাফা বেগুনের উন্নত বীজ কোথাও না পেয়ে কৃষকরা নিরূপায় হয়ে এর পরিবর্তে বিভিন্ন জাতের বেগুন চাষ করছে। এর মধ্যে হলো : ভোলানাথ, সিংনাথ, ইসলামপুরী, বারী বেগুন, খটখটিয়া, তারা ও ঝুড়ি বেগুন। কৃষক মাসুদ মিয়া জানান, বিলুপ্ত হওয়া এই লাফা বেগুনের বীজ অনেক কষ্ট করে ইসলামপুর থেকে এনে এক একর দশ শতাংশ জমিতে চাষ করেছি। সর্বসাকুলে প্রায় ৯০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বিক্রি করেছি ২ লাখ টাকার মতো। সর্বমোট ৩ লাখ টাকার ওপর বেগুন বিক্রি করতে পারবে বলে জানান কৃষক মাসুদ মিয়া। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে ৪শ’ একর জমিতে বিভিন্ন জাতের বেগুনের চাষ হচ্ছে। উপজেলার চর আলগী, টাঙ্গাব, দত্তেরবাজার ও সালটিয়া ইউনিয়নে বেগুনের চাষ হয়ে থাকে। এই ৫টি ইউনিয়নের ১৪শ’ ৪০টি পরিবার বেগুন চাষে সুফল ভোগ করবে। চর আলগী ইউনিয়নের লাফা বেগুন বাংলাদেশের ঐতিহ্য। এটাকে আমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। কৃষক জীবন, সুলতান বলেন, লাফা বেগুন চাষের জন্য উন্নত বীজ না থাকায় এর বিকল্প হিসেবে আমরা ভোলানাথ ও ইসলামপুরী বেগুনের চাষাবাদ করছি। ইসলামপুরী ও ভোলানাথ বেগুন দেখতে অনেকটা লাফা বেগুনের মতো দামও ভাল। তবে খাওয়ায় স্বাদ কম। এবার চর আলগী ইউনিয়নের মাসুদ মিয়া ২০ বছর পর লাফা বেগুনের চাষ করে গফরগাঁও তথা ময়মনসিংহের ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। লাফা বেগুনের অপর চাষী জীবন মিয়া জানান, বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে দু-একজন লাফা বেগুনের চাষ করেন। আগের মতো আর এখন লাফা বেগুনের চাষ হয় না। ভরা শীত মৌসুমে চলে লাফা বেগুনের চাষ। রাতের শেষ প্রহরে মাটি ওলটপালট করে দিতে হয়। প্রতি সপ্তাহে অল্প সেচ দিতে হয়। এ জাতের বেগুনগাছ মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণ রস টেনে নেয়। কৃষক জীবন মিয়ার দাবি জরুরী ভিত্তিতে লাফা বেগুনের ভাল বীজ সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি। ময়মনসিংহ জেলার কৃষি অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল মাজেদ জনকণ্ঠকে বলেন, গফরগাঁওয়ের আবহাওয়া ও মাটি বেগুন চাষের জন্য উপযোগী। আশা করছি, চলতি রবি মৌসুমে বেগুন চাষ আমাদের লক্ষ্যমাত্রা এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি রবি মৌসুমে ১৫ কোটি টাকার বেগুন উৎপাদন হবে গফরগাঁওয়ে। তিনি বলেন, হারিয়ে যাওয়া লাফা বেগুনের বীজ সংগ্রহ করে কৃষক মাসুদ যে ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে তাকে সহায়তার জন্য কৃষি বিভাগ সব সময় তৎপর।
×