ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

নারী ও শিশু নির্যাতন এবং মানবাধিকার

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯

নারী ও শিশু নির্যাতন এবং মানবাধিকার

বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে নির্যাতন মানবাধিকারের সর্বাধিক লঙ্ঘন। এই নির্যাতন সূক্ষ্ম এবং প্রকট উভয় ধরনেরই হতে পারে। বাংলাদেশে উন্নয়নের ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া বিশাল। কিন্তু এদেশের সংস্কৃতিতে এই সহিংসতা এমন ব্যাপকভাবে গেঁথে গেছে যে, তা প্রায় চোখে না পড়ার মতোই। তবুও এই নৃশংসতা অনিবার্য নয়। যদি এই সহিংসতার প্রকৃত চরিত্রটাকে স্বীকার করে নেয়া হয়, অর্থাৎ একে ক্ষমতার বহির্প্রকাশ এবং বিদ্যমান অবস্থা বজায় রাখার একটা উপায় হিসেবে দেখা হয়, তবে দেশের প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এই স্থিতাবস্থার অবসান ঘটানো সম্ভব হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যেসব অপরাধের বিচার হয় তার মধ্যে রয়েছে যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত মৃত্যু, নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনা, যৌননিপীড়ন, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে শিশুর অঙ্গহানি প্রভৃতি। এই নৃশংস চিত্রকে যথেচ্ছ অতিরঞ্জিত বলে মনে হতে পারে। তবুও এ কথা সত্যি যে, নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা আমাদের জন্য চিন্তার একটি নতুন ক্ষেত্র। আবার এ কথাও সত্য যে, সহিংসতার একটি বিশাল অংশের খবর আমাদের অগোচরেই রয়ে যায়। সমাজ বিজ্ঞানীরা এটি উদ্ঘাটন করেছেন যে, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ব্যাপ্তি এবং সার্বজনীনতা সবচেয়ে অবহিত ধারণাতেও আসে না। ট্রাইব্যুনালে মিথ্যা মামলা দায়ের করার অভিযোগও শুনতে পাওয়া যায়। নিজেদের মধ্যে অন্য কোন বিরোধকে কেন্দ্র করে যৌতুক, ধর্ষণ ও যৌনপীড়নের অভিযোগে মামলা হচ্ছে, যার সংখ্যা কম নয়। কল্পনা করুন, এক শ্রেণীর মানুষকে নিয়মিত ভিত্তিতে যৌতুকের টাকার জন্য নিগ্রহ, ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, গালিগালাজ, এমনকি হত্যার শিকার হতে হয়- শুধু এ জন্য যে, তাদের জন্ম হয়েছিল একটি বিশেষ শ্রেণীতে। আরও কল্পনা করুন যে, ঘর ও কর্মক্ষেত্রে, শ্রেণীকক্ষ বা আদালতে উপাসনালয়, খেলাধুলার মাঠে ক্রমাগত বৈষম্য ও অবমাননার কারণে তাদের দুর্ভোগের পাল্লা আরও ভারি হচ্ছে। খুব কম লোকই অস্বীকার করবেন যে, মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য নারী ও শিশুদের বেছে নেয়া হয়েছে। এ রকম একটা শ্রেণী রয়েছে এবং এর সদস্যরা মানবজাতির অর্ধেক। তবু কদাচিত কথাটির স্বীকার করা হয় যে, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাংলাদেশে মানবাধিকারের সবচেয়ে ব্যাপক লঙ্ঘন। এই লঙ্ঘন নৃশংসতার আকারে অনেকের ওপর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে শুধু তাদের নারী হওয়ার কারণে। বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে যৌতুক দেয়া বা নেয়া নিষিদ্ধ। কয়েক দশক আগেও দেশটিতে যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যা ও নির্যাতন নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। কখনও কখনও স্বামীর পরিবারের যৌতুকের চাহিদা মেটাতে না পেরে নারীদের আত্মহত্যার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধ দমনের লক্ষ্যে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি প্রণয়ন করা হয়। ২০০৩ সালে এই আইন আরও সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়। শুধু তাই নয়, বরং এই আইনের অধীনে দায়ের করা মামলাগুলোর বিচারের জন্য প্রতিটি জেলা সদরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়েছে আইনের ২৬(১) ধারায়। প্রয়োজনে একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশে এমন জেলা বেশ কয়েকটি রয়েছে যে সকল জেলায় একাধিক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বেড়েছে আরও অন্তত ৪১টি। সম্প্রতি ডয়চে ভেলের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ মামলা। আর সাজা পাচ্ছে হাজারে মাত্র সাড়ে চারজন আসামি। বাংলাদেশে ৪৬ জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা এখন ৫৪টি। প্রতিটি জেলায় একটি করে ট্রাইব্যুনাল থাকার কথা থাকলেও তা এখনও হয়নি। আর এই ৫৪টি ট্রাইব্যুনালে এখন মামলা জট লেগেছে। এসব ট্রাইব্যুনালে প্রায় এক লাখ ৪১ হাজার ১৮৭টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর যে ১৮ জেলায় এখনও ট্রাইব্যুনাল নেই সেসব জেলায় এই আইনে দায়ের করা বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৪ হাজার ৮৯৫টি। এই জেলাগুলোতে জেলা জজ অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার বিচার করেন। ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সারাদেশে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মামলা ঝুলে আছে। গড়ে একটি ট্রাইব্যুনালে এখন ১০ হাজারেরও বেশি মামলা রয়েছে। নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে নির্যাতন উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি সাংঘাতিক বড় সমস্যা যার শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া আগামী প্রজন্ম ও সাধারণভাবে সমাজের ওপর পড়ছে। বাংলাদেশে মানব নিরাপত্তার উদাহরণ রচনার ক্ষেত্রে এই সহিংসতা ও নির্যাতনের অবসান ঘটানো একান্ত আবশ্যক। এর অর্থ হতে পারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। ঘরে এবং বাহিরে, সর্বত্রই শান্তি প্রতিষ্ঠা। এটা ছাড়া মানবজাতির অগ্রগতির ধারণা এক নিছক কল্পনামাত্র। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কোন মামলায় প্রথমে বাদী যত উৎসাহের সঙ্গে শুরু করেন অনেক সময়ই সেই উৎসাহ আর শেষপর্যন্ত ধরে রাখতে পারেন না। কেননা প্রায়ই দেখা যায় সাক্ষী হাজির হন না। পলাতক থাকেন অনেক আসামি। তাদের গ্রেফতারের বিষয় থাকে। মালামাল ক্রোকের বিষয় থাকে। আবার আদালতের বাইরে কেউ কেউ মামলা আপোস করে ফেলেন। এর ফলে মামলায় সাজার হারও কমে যায়। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তথা পাবলিক প্রসিকিউটরদের ভূমিকা সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী দক্ষ হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি হয় বহুলাংশে। আর মামলার তদন্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তদন্তে অনেক ত্রুটি থাকে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে দায়ের করা মামলার তদন্ত ঠিকমতো না হলে আদালতে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়। পুলিশকে ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা হয় না। কারণ, দেখিয়ে আরও ৩০ দিন এভাবেই মোট ১২০ দিন সময় নেয়ার সুযোগ পায় তারা। তাই মামলার বিচারকাজ শুরু করতেই দেরি হয়। বিচার শুরু হওয়ার পর ছয় মাসে বিচারকাজ শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নতর। এখনও কোন কোন ট্রাইব্যুনালে ২০০৩ সালের মামলার সন্ধান পাওয়া যায়। উপযুক্ত সাক্ষী, চার্জশিট জটিলতা এবং প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের জন্য গৃহ হচ্ছে ত্রাসের একটি কেন্দ্র। বাড়িতে সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতার সবচেয়ে সার্বজনীন একটি ধরন এবং প্রজননবয়সী নারীর জখম হওয়ার তা প্রধান কারণ। ক্ষেত্র বিশেষে এ সকল বিষয় সংবাদ শিরোনাম হয় আবার কোন কোন ক্ষেত্রে চাপা পরে থাকে। বাংলাদেশের নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নির্যাতন বিষয়ে দ্বার অর্গলমুক্ত করার ব্যাপারটি যেন এমন একটি বিশাল কালো প্রকোষ্ঠের চৌকাঠে দাঁড়ানো যার ভেতরটা সম্মিলিত যন্ত্রণায় প্রকম্পিত হচ্ছে, যদিও প্রতিবাদের ধ্বনি রুদ্ধ হতে হতে একটি গুঞ্জনে পরিণত হচ্ছে। যেখানে অসহনীয় স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে প্রচ- ধিক্কার থাকা উচিত, সেখানে আসছে বরং অস্বীকৃতি এবং গতানুগতিক ধারাকে বহুলাংশে নিষ্ক্রিয়ভাবে মেনে নেয়ার ব্যাপারটি। শৈশব থেকে একটি নারী কি করতে পারে এবং কি হতে পারে সে সম্পর্কে তাঁর কল্পনা যখন সহিংসতার ছায়ায় নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে তাঁর এই শিক্ষা তখনই হয়ে যায়। এবং এই শিক্ষা সে কখনই বিস্মৃত হয় না। পুরুষের আগ্রাসনের মুখে ভয়ের ফিসফিসানি শোনেনি এবং সে অনুযায়ী নিজের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ করেনি, এমন নারী কোথায় আছে? পাঠক, এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠের কয়েকটি সত্যকে বিবেচনা করে দেখুন- যে সত্যগুলো নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে মানবাধিকার সংক্রান্ত আলোচ্যসূচিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দাবি করতে পারে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়টি। লেখক : আইনজীবী [email protected]
×