ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্টিয়ারিং কমিটির মিটিং হলো না, ভাঙ্গনের মুখে ঐক্যফ্রন্ট

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৭ জানুয়ারি ২০১৯

স্টিয়ারিং কমিটির মিটিং হলো না, ভাঙ্গনের মুখে ঐক্যফ্রন্ট

শরীফুল ইসলাম ॥ জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের রেষারেষি শুরু হয়েছে। আর এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে তার সম্পর্কহানির পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ভাঙ্গনের সুর লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে বিএনপির সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের রেষারেষির অবসান ঘুচিয়ে পরবর্তী কর্মসূচী ঠিক করতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ক’জন নেতার চেষ্টায় বুধবার এ জোটের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও উভয় পক্ষের কিছু নেতার আপত্তির কারণে তা হয়নি। সূত্র মতে, নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকার বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেননি ড. কামাল হোসেন। তবে এক পর্যায়ে গণফোরাম. নাগরিক ফোরাম ও জেএসডির (রব) ক’জন নেতা এবং লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্ন কৌশলে ড. কামাল হোসেনকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত রেখেই জোট করতে রাজি করান। তখন ড. কামাল হোসেনকে বোঝানো হয়েছিল যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন নেই সেহেতু তারা দলগত নয় বিএনপির প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। আর তাদের ভোট ব্যাংক কাজে লাগাতে পারলে জোট লাভবান হবে। এর পর নির্বাচনে জোট ভাল ফল করবে এমন একটি আশাবাদ থেকে কামাল হোসেন জামায়াতের বিষয়ে তেমন আপত্তি করেননি। কিন্তু এ নির্বাচনে ভরাডুবির পর বিভিন্ন মহল থেকে জামায়াত বিরোধী সমালোচনা চলতে থাকায় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১২ জানুয়ারি রাজধানীর মতিঝিলে গণফোরামের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করে ভুল হয়েছে বলে মন্তব্য এ দলের সঙ্গে আর রাজনীতি করবেন না বলে জানান গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, জামায়াতের সঙ্গে কখনও রাজনীতি করিনি, ভবিষ্যতেও করব না। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল বলেন, আমি যখন ঐক্যে সম্মতি দিয়েছি তখন জামায়াতের কথা আমার জানা ছিল না। এটা ঐক্যফ্রন্ট গঠনে ভুল ছিল। এছাড়াও তড়িঘড়ি করে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে যেসব ভুলত্রুটি হয়েছে তা সংশোধন করা হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, জামায়াতের ২২ জন প্রার্থীকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়ার বিষয়টি আমি জানতাম না। দেয়ার পর বিএনপির কাছে আমি ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম। তারা বলেছেন সবাই ধানের শীষের প্রার্থী এখানে জামায়াতের কেউ নেই। বিএনপিকে জামায়াত ছেড়ে আসতে চাপসৃষ্টি করা হবে কি না সে বিষয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, আমিতো মনে করি জামায়াত ছেড়ে আসতে বিএনপিকে চাপ দেয়া যেতে পারে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকলে ভবিষ্যতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থাকবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, জামায়াত নিয়ে কোন রাজনীতি নয়, অবিলম্বে এ বিষয়ে সুরাহা চাই। সংবাদ সম্মেলন করে জোটে জামায়াত থাকা প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যের পর জামায়াত নেতারা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এর ফলে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যকে সহজভাবে নিতে পারেনি বিএনপি হাইকমান্ডও। তাই বিএনপি নেতারাও ড. কামাল হোসেনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগে সক্রিয় ভূমিকা থাকলেও বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকায় শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট আত্মপ্রকাশের আগেই সরে আসেন বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এভাবে জামায়াতকে নিয়ে জোট গঠনের জন্য বিএনপি ও ড. কামাল হোসেনকে মাসুল দিতে হবে বলেও তিনি তখন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ জোটে যোগ দেন অধ্যাপক বি চৌধুরী। ১৩ জানুয়ারি তোপখানা রোডের বিএমএ মিলনায়তনে বিকল্প ধারার নবনির্বাচিত ২ সাংসদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দলটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডাঃ বি চৌধুরী জামায়াতকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর এখন ভুল স্বীকার করায় এ জোটের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনকে ধন্যবাদ জানান। সেই সঙ্গে তিনি ড. কামাল হোসেনকে উদ্দেশ করে বলেন, জামাতকে নিয়ে জোট করে যে ভুল করেছেন তার জন্য এখন জাতির কাছে ক্ষমা চান। অধ্যাপক বি চৌধুরী ড. কামাল হোসেনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনি নাকি জানতেন না যে জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য হতে চলেছে, এটি আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না । তবুও আমি খুশি হয়েছি, এত দিন পরেও তার উপলব্ধি হয়েছে। আজকে প্রমাণ হয়েছে আমরা বিকল্পধারা এত দিন যে কথা বলেছি, সে কথা সঠিক। কামাল হোসেনের আজকে বলা উচিত ছিল, তখন আপনাদের বিশ্বাস না করা ভুল ছিল। ওই টুকু যখন বলেছেন, তখন বাকিটুকুও বলতে পারতেন। জামায়াতকে জোটে নিয়ে এখন ভুল স্বীকার করায় বিকল্প ধারার কাছেও কামাল হোসেনের ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে একটি জাতীয় সংলাপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সংলাপে আওয়ামী লীগসহ দেশের সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানোরও সিদ্ধান্ত হয়। এ নিয়ে প্রস্তুতি জোরদার করতে বুধবার গণফোরামের মতিঝিল কার্যালয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জামায়াত নিয়ে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত এ বৈঠকটি হয়নি। ২০ জানুয়ারি ড. কামাল হোসেনের সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা রয়েছে। তাই এর আগে বিএনপির সঙ্গে তাঁর ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে কি না এ নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে জানা গেছে ড. কামাল হোসেনকে ম্যানেজ করতে লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোন অবস্থাতেই বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে চায় না। আর এ জন্যই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নানা কৌশলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনকে ম্যানেজ করে ২২টি আসনে জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেন। পরে গোপনে আরও ৩টি আসনে জামায়াতকে ধানের শীষ দেয় বিএনপি হাইকমান্ড। তবে তখন ড. কামাল হোসেন কিছু না বললেও নির্বাচনে ভরাডুবির পর বিভিন্ন মহল থেকে চাপের মুখে পড়তে হয় তাকে। তাই নিজের ইমেজ রক্ষায় সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াত সম্পর্কে তিনি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন। প্রকাশে সংবাদ সম্মেলন করে দীর্ঘদিনের জোট সঙ্গী জামায়াত সম্পর্কে ড. কামাল হোসেনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার বিষয়টিকে ভালভাবে নিতে পারেনি বিএনপি। আর এ জন্যই ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে দলের সিনিয়র নেতাদের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তবে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিএনপিকে দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতমুক্ত করার জন্য চাপ দিয়ে আসলেও শেষ পর্যন্ত তা না হওয়ায় কিছুটা ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যের পর তা বিষয়টিকে ভালভাবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু জামায়াতকে ছাড়া বিএনপি রাজপথের কর্মসূচী পালন ও ভোটের রাজনীতিতে অচল মনে করে দলীয় হাইকমান্ড কিছুতেই জামাতকে দূরে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন না। আর এ কারণেই ড. কামাল হোসেনের কথা শুনে বিএনপি হাইকমান্ড নাখোশ হয়েছেন। তাই তারা জামায়াত প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যে আপত্তি জানিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, জামায়াত নিয়ে ড. কামালের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত। অভিজ্ঞ মহলের মতে, স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াত তাদের অতীতের ভুলভ্রান্তির জন্য এখনও ক্ষমা চায়নি। তাই দেশের অধিকাংশ মানুষ এ দলটিকে ঘৃণা করে। এ ছাড়া জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকায় প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ জামায়াতের রাজনীতিকে সমর্থন করে না। আর উচ্চআদালতের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করায় এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন করারও কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু বিএনপি ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অধীনে দলীয় পরিচয়েই নির্বাচন করার সুযোগ করে দেয়। তবে নির্বাচনের আগে এ নিয়ে তেমন হৈচৈ না হলেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনে ভরাডুবির পর ড. কামাল হোসেন ও বিএনপি হাইকমান্ড দেশে-বিদেশে নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এ পরিস্থিতিতে ড. কামাল হোসেন জামায়াতবিরোধী বক্তব্য দিয়ে জোট গঠনে নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়েন। তবে তারপরও বিএনপি জামায়াত সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু না বলে এ দলটির সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার কৌশল নেন। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরখানেক আগে জামায়াত, বিজেপি ও ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে ৪ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। এর পর আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে ৪ দলীয় জোটগতভাবে। নির্বাচনে বিজয়ের পর সরকার গঠন করতে গিয়ে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতাকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগানোর সুযোগ করে দেয়ায় চরম সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। তাই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪ দলীয় জোটের ভরাডুবি হয়। কিন্তু তখন দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে জামায়াত ছাড়ার জোরালো চাপ আসলেও বিএনপি হাইকমান্ড এ দলটির সঙ্গ ত্যাগ না করে সম্পর্ক আরও জোরদার করেন। ২০১২ সালে জামায়াতকে রেখেই আরও ক’টি দলকে নিয়ে প্রথমে ১৮ দলীয় জোট এবং পরে ২০ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। ১৪ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জামায়াত নিয়ে ড.কামাল হোসেনের বক্তব্য গণফোরামের। এটি ঐক্যফ্রন্টের বক্তব্য নয়। আমরা নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে কোন আলাপ-আলোচনা করিনি। জামায়াত ইস্যুতে ঐক্যফ্রন্টে ফাটল ধরবে কিনা জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ঐক্যফ্রন্টে কোন ফাটল ধরার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনালের (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ভিন্ন মত ও পথের লোকজনকে নিয়েও কখনও কখনও রাজনীতি করতে হয়। আর এ কারণেই এবার বিএনপির সঙ্গে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোটের প্রার্থী হয়েছিল জামায়াত নেতারাও। তবে ড. কামাল হোসেন নির্বাচনের আগে কিছু না বলে এখন কেন জামায়াতকে নিয়ে নির্বাচন করা ভুল ছিল বলছেন তিনিই ভাল বলতে পারবেন। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।
×