ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে বিড়ম্বনার শিকার নারী চালকরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৭ জানুয়ারি ২০১৯

সড়কে বিড়ম্বনার শিকার নারী চালকরা

ওয়াজেদ হীরা ॥ রাজধানীর বাসিন্দা শাহিনুর আক্তার। সময় বাঁচাতে আর স্বস্তিতে গন্তব্যে যেতে প্রতিনিয়তই স্কুটি চালিয়ে ছুটতে হচ্ছে রাজধানীর সড়কে। যাতায়াতের সময় আশপাশের মানুষ অনেক সময়ই বাঁকা চোখে তাকায়। কখনও ছুড়ে দেয় বাজে মন্তব্যও। তাতে অবশ্য থেমে যান না শাহিনুর। ব্যস্ত রাজধানীতে শাহিনুরের মতো হাজারো স্কুটি বা মোটরবাইক চালানো মেয়েকে প্রতিদিনই নানা কটু কথা আর হয়রানির মধ্য দিয়ে রাস্তায় চলাচল করতে হয়। নারীরা কেউ প্রতিবাদ করছেন, কেউ মুখ বুঝে সহ্য করে চলে যাচ্ছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মানুষের এসব আচরণ ‘যৌন হয়রানি’র শামিল মনে করছেন সচেতন ব্যক্তিরা, যা দূর করতে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর বিকল্প নেই। বাংলাদেশে সাধারণত মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর বেশিরভাগই পুরুষ হলেও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন রাজপথে হরহামেশাই দেখা যায় নারী বাইকারদের। হেলমেট পরা বহু নারী রং-বেরঙের স্কুটি চালিয়ে প্রতিনিয়ত ছুটছেন। তবে নারী চালকদের চলার পথের আশপাশের পরিবেশ এখনও ভাল নয়। অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেন। পুরুষশাষিত সমাজে অনেকেই মেয়ে চালককে মেনে নিতে পারছেন না। যদিও বাজে কথায় কান দিচ্ছে না স্বাধীনচেতা নারীরা। দৃঢ় সাহসিকতা আর দৃপ্ত প্রত্যয়ে যেখানে খুশি বাইক চালিয়ে ছুটছেন এসব অদম্য নারী। আফসানা জামান গত ১৪ জানুয়ারি বিকেলের দিকে ঢাবির টিএসসিতে স্কুটি নিয়ে থামলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু যুবক বাঁকা চোখে বার বার তাকালেন। একই সঙ্গে খারাপ মন্তব্যও করে বসলেন দু’একজন। আফসানাও দমবার পাত্রী নন। কড়া প্রতিবাদ করলেন। মানুষের উপস্থিতিতে নিজেদের ভুল বুঝে কেটে পড়ল যুবকরা। আফসানা বলেন, একটি মেয়ে গাড়ি চালালে সমস্যা কী, এটাই বুঝি না। প্রতিদিনই নানা মানুষ নানাভাবে তাকায়, মনে হয় আজব কোন কিছু দেখছে। এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্থ হয়ে এখন প্রতিবাদ করা শিখে গেছি। আফসানার মতো সবাই প্রতিবাদী হন না। কেউ কেউ নানা কথা শুনেও মুখ বুজে গন্তব্যে ছুটে যায়। রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায়, নানা পয়েন্টে যানজটে স্কুটিতে বসে থাকতে দেখা যায় নারীকে। যাদের অনেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কেউ কলেজ, কেউ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ছুটছেন গন্তব্যে। ব্যস্ত সড়ক বাংলামোটরে স্কুটি নিয়ে যাওয়ার সময় নিউভিশন গণপরিবহনের এক হেলপার বার বার বলে যাচ্ছিল ‘ওস্তাদ বাঁয়ে লেডিস’। আর বাসের অভ্যন্তরের যাত্রী ‘লেডিস’ দেখার জন্য তাকালেন। অথচ কোন পুরুষ মোটরবাইক চালিয়ে গেলে হেলপার বলে দেয় বাঁয়ে মোটরসাইকেল। ফার্মগেটের বাসিন্দা সুহানা প্রতিদিন নিয়ম করে বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেয়া করেন বাইকে। তিনি বলেন, আমাদের অনেক কথা শুনতে খারাপ লাগে, তবে না শোনার ভান করে চলে যাই। সময় ও স্বাচ্ছন্দ্যতার জন্যই তো আমি গাড়ি চালাই। তবে অনেক সময় কিছু শিক্ষিত মানুষ যেসব আচরণ করেন তা পুরোপুরি ‘সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্টে’র শামিল। মঙ্গলবার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে যানজটে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী এক নারী বাইকারের উদ্দেশে পাশের মাইক্রোর চালক টিপ্পনি কেটে বললেন, ‘আফা দেখি হুন্ডা চালায়। গাড়ির সঙ্ঘে বাইজা গেলেই বুজবেন ঠ্যালা।’ জ্যাম শেষে চলা শুরু মাত্র অনেকটা ইচ্ছা করেই গাড়িটা একটু চাপিয়ে হালকা ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করে ওই চালক। প্রতিদিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে নারী বাইকাররা নানা ধরনের হয়রানি, কটুবাক্য শুনেও থেমে নেই নারীর অগ্রযাত্রা। কয়েক বছরে আরও বেড়েছে নারী চালক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারী বাইকারের কেউ কেউ এ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ারিংও করছেন। এতে একদিকে স্বস্তিতে গন্তব্যে যেতে পারছেন অন্যদিকে কোন নারী চালক যাত্রীকে রাইড শেয়ার করে বাড়তি টাকা আয় করছেন। ইতোমধ্যেই শাহনাজ আক্তার নামের সাহসী এক নারী শুধু স্কুটি চালিয়ে সংসার ও বাচ্চাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন খবরে সামাজিক মাধ্যমসহ সব জায়গায় আলোড়ন তুলেছে। যানজটসহ গণপরিবহনে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রাজধানীর কর্মজীবী নারীর আগ্রহও আছে এ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির এক তথ্যে জানা গেছে, দেশে মোটরসাইকেল চালানোর জন্য এ পর্যন্ত চার হাজার নারীর লাইন্সেস নেয়ার কথা। নারী মোটরসাইকেল চালকদের নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ উইমেন রাইডার্স ক্লাব’। সংগঠনটি নারী চালকদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মোটরসাইকেল র‌্যালি ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ক্লাবটির প্রাপ্ত তথ্য, নগরীতে এখন প্রায় দুই হাজারের বেশি নারী মোটরসাইকেল চালান আর এই নারীর ৯০ শতাংশই কর্মজীবী। অথচ ’১৭ সালেও এরা ছিলেন মাত্র ২/৩ শ’। এছাড়া নারী বাইকারদের ক্লাবের কথাও শোনা গেছে। শহীদ সন্তান ডাঃ নুজহাত চৌধুরী শম্পা জনকণ্ঠকে বলেন, আমি আমার ১৭ বছরের মেয়েকে এখনই ড্রাইভিং শেখাচ্ছি। মেয়েদের কোন ক্ষেত্রে পিছিয়ে রাখা যাবে না। আর রাস্তাঘাটে মেয়েদের নিয়ে যারা নানা খারাপ আচরণ বা দৃষ্টি দেয় তারা স্রেফ যৌন হয়রানি করছে। আমার শহুরে মেয়েটার যদি এই অবস্থা হয় গ্রামের মেয়েদের অবস্থা কি হবে একটু ভেবে দেখুন। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সবার মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার। একাধিক নারী বাইকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরুষরা যদি পারে তবে আমরা ন কেন নয়। আর নারী মানেই শুধু চার দেয়ালে বন্দী জীবন নয়। শুধু রান্নাবান্না আর ঘর সামলানো নয়। বাইকারদের মতে, একটু ফ্রিভাবে অফিস কিংবা গন্তব্য স্থানে যেতে আমরা একটি বাহন চালাই। অথচ শুরুর দিকে মানুষ এটিকে অনেক খারাপ হিসেবেই নিত। এখনও এত আধুনিকতার যুগে অনেকেই ভালভাবে দৃষ্টি দেয় না, কটু কথা বলে। নার্গিস সুলতানা আজিমপুর থেকে নিয়মিত অফিস করেন মহাখালী। তিনি বলেন, আমি যখন ২০১৬ সালের শেষদিকে স্কুটি নিয়ে বের হতাম। আশপাশের দোকান থেকে শুরু করে রাস্তার সব মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। যেন অদ্ভুত কিছু দেখছে। আর এখন সেই পরিবেশটা আগেম মতো নেই, তবে শেষও হয়ে যায়নি। এখন অনেক প্যান্ট-শার্ট পরা শিক্ষিত মানুষও বাজে মন্তব্য করে যা শুনতে খারাপ লাগে। অবশ্য আমি সময় বাঁচাতে এবং গণপরিহনের মানুষের ধাক্কা থেকে তো নিরাপদ আছি। নারীনেত্রী খুশি কবীর জনকণ্ঠকে বলেন, দেখুন, আমাদের সমাজে নারীরা নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলছে। নারীরা মুখ বুজে থাকতে থাকতে এখন প্রতিবাদও করছে। মূলত পুরুষরা মেনে নিতে পারে না নারীর উন্নতি বা স্বাধীনতা। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বা কটুকথা এক ধরনের হয়রানি। এদিকে, রাইড শেয়ারিং এ্যাপে পাঠাও, উবার, ওভাইয়ের মতো শুধু নারীদের জন্য যুক্ত হয়েছে রাইড শেয়ারিং সেবা ‘ও বোন’ ‘লিলি’। এছাড়া ট্রাফিক সার্জেন্ট হিসেবে নিয়োগকৃত নারী সার্জেন্টদেরও কাজের সুবিধার্থে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে স্কুটি। ফলে কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে আগের চেয়ে তাদের সুবিধা হচ্ছে। মেয়েদের উপযোগী স্কুটি ও মোটরসাইকেল আমদানি করছে কোম্পানিগুলোও। এসব মোটরসাইকেল ও স্কুটি সাধারণত ৫০ সিসি থেকে সর্বোচ্চ ১২৫ সিসি পর্যন্ত হয়ে থাকে। দুই চাকার যানগুলোর কিছু তেলে এবং কিছু রিচার্জের মাধ্যমে চলে। বাংলামোটর এলাকায় মোটরসাইকেলের শোরুম ও পার্টসের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিন দিন নারীদের মোটরসাইকেল চালানোর হার বেড়েছে। প্রতিদিনই কমবেশি নারীরা বিভিন্ন বাইকের খোঁজ নিচ্ছেন। শুধু মোটরসাইকেলই নয়, নারীরা চার চাকার গাড়ি চালালেও কখনও কখনও বিদ্রƒপ করা হচ্ছে। বসুন্ধরা সিটির সামনে আহসান নামের এক যুবক আরেকজনকে দেখিয়ে বলল ‘ঐ দেখ মাইয়া গাড়ি চালায়’। মেয়েরা কেন গাড়ি চালাবে না এমন প্রশ্নে কোন উত্তর দিতে পারেনি ঐ যুবক। বাংলাদেশ ডাক বিভাগে কর্মরত নারী ড্রাইভার সানজিদা খানমের মতে, নারীদের প্রতি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। আমি যখন প্রথম চাকরিতে যোগদান করি তখন আমার অনেক পুরুষ সহকর্মী আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাত। তাদের একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল, মেয়ে মানুষ আবার ড্রাইভিং করে নাকি! কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমি তাদের ধারণা পাল্টে দিয়েছি। ২০১৭ সাল থেকে সরকার পুরুষের পাশাপাশি কিছু নারী চালকের হাতে তুলে দিয়েছেন ডাকবাহী মেইল গাড়ির চাবি। দক্ষতার প্রমাণ রাখছেন তারা। গত বছর সফটওয়্যার প্রকৌশলী তানিয়া আলম তার স্কুটিতে করে সন্তানকে আনানেয়ার সময় খোদ পুলিশের তির্যক বাক্যের সম্মুখীন হন। অভিযুক্ত ট্রাফিক সদস্য সাইফুল ইসলাম গাড়িচালকদের তানিয়া আলমের স্কুটিতে ধাক্কা দেয়ার জন্য উসকে দিচ্ছিলেন। সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি বেশ আলোচনায় আসে। সবার মন্তব্য ছিল, স্কুটি চালানো অপরাধ কিনা? উত্তরার কাকলি আক্তার প্রতিদিন স্কুটি নিয়ে বের হন। তিনি বলেন, আমি যখন রাস্তায় বের হই তখন আমার স্কুটির চেয়ে আমার শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভয়ঙ্কর বিষয় হলো অনেক সময় কিছু ছেলে পেছনে পেছনে বাইক নিয়ে আসে, কখনও পেছন থেকে ধাক্কাও দেয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, সমাজ, রাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার হার বাড়ছে তবে প্রকৃত শিক্ষা মনে হয় পাচ্ছি না। এসব বিষয়ে এখনও লিঙ্গ বৈষম্য করা হয়। শারীরিক হয়রানিই শুধু যৌন হয়রানি নয় এসবও আমরা বুঝতে চাই না। সমাজ উন্নয়নে নারী-পুরষ সবাই ভূমিকা রাখছে। তাই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। পরিবেশ করতে হবে নারীবান্ধব। ঠিক কি কারণে সমাজে যে কাজ পুরুষ করতে পারে, নারী করতে গেলে তাকে কেন শুনতে হয় বিচিত্র, অশালীন কথা Ñএ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, নারীদের যে আচরণগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সেটা একটা সাবলীল আচরণ। কিন্তু পুরুষ সদস্যরা সেটাকে স্বাভাবিকভাবে দেখছে না। মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট আচরণিক গ-ির মধ্যে দেখতে পছন্দ করে পুরুষরা। এর বাইরে যদি কোন মেয়ে কোন আচরণ করে তখন সেটা তারা মেনে নিতে পারে না। কিন্তু মেয়েরা সেই সনাতনী পুরনো ধাঁচে চলতে থাকবে সেটা হতে পারে না। প্রতিবার নতুন নতুন পরিস্থিতির মুখে মেয়েদের পড়তে হয়, যেটাকে পরিস্থিতি না বলে বলা উচিত হয়রানি, যৌন হয়রানি, শারীরিক, মানসিক হেনস্থার শিকার। সমাজের বিশিষ্টজন ও সচেতন ব্যক্তিরা মনে করছেন, নারীর চলার পথ সুন্দর-সুগম করে দিতে সমাজের মানুষগুলোই ভূমিকা রাখবে। প্রত্যেকের সচেতনতা আর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালে যেমন কমে আসবে হয়রানি তেমনি নারী পাবে নিরাপত্তাও।
×