ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

গহর বাদশা-বানেছাপরী

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ১৭ জানুয়ারি ২০১৯

গহর বাদশা-বানেছাপরী

২০১৫ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার মঞ্চে প্রথমবারের মতো নাগরিক নাট্যাঙ্গন মঞ্চায়ন করে আমাদের চিরায়ত লোকজ সাহিত্যনির্ভর মঞ্চ প্রয়াস তাদের ২০তম প্রযোজনা ‘গহর বাদশা ও বানেছাপরী’। গত কয়েক বছরে অনেকগুলো মঞ্চায়ন হয়েছে নাটকটির। লোকমুখে শুধু প্রশংসা শুনেছি। কিন্তু আমার পক্ষে এতদিন নাটকটি উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়নি। গত ৯ জানুয়ারি শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তানে নাটকটি উপভোগ করার সুযোগ হলো। আবহমানকাল থেকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আমাদের লোকজ কাহিনীগুলোকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। আর সেই সঙ্গে প্রেম উপাখ্যান যদি থাকে তাহলে তো কথাই নেই। এক কথায় বাজিমাত। ‘গহর বাদশা ও বানেছাপরী’ নাটকের কাহিনীতেও আছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং সেই সঙ্গে প্রেম উপাখ্যান। পৃথিবীতে কিছু ঘটনা আছে যা চিরন্তন। নাটকের এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং ‘গহরবাদশা ও বানেছাপরী’র প্রেম উপাখ্যান সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক। আমাদের এখনকার এই আধুনিক যুগেও দেশে দেশে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র হয়ে চলেছে। আবার যেভাবে বানেছাপরী তার পরীজাতি ত্যাগ করে মানবসন্তান গহরবাদশার সঙ্গে প্রেমের টানে চলে আসে ঠিক তেমনি প্রেমের জন্য মানুষ ঘর ছাড়ছে। নাটকে একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনা, বিশ্বিং বাদশার আত্মহত্যা, পুরো পরিবার এবং গহর বাদশার দুর্গতিপূর্ণ জীবনের মূলে উজিরের ষড়যন্ত্র সুস্পষ্ট। নিয়তির হিসাব বড্ড জটিল। উজির ষড়যন্ত্র করে গহর বাদশাকে শিকারে নিয়ে না গেলে হয়ত গহর বাদশার সঙ্গে বানেছাপরীর সাক্ষাতও হতো না আর ‘গহর বাদশা ওবানেছাপরী’র প্রেম উপাখ্যানও রচিত হতো না। নাটকের গল্পটি মূল পালারই ছায়া। গিলামাইটবনে বিশ্বিং বাদশার শিকার করতে যাওয়া দিয়ে গল্পের শুরু। শিকারের এক পর্যায়ে হরিণ শাবকের দিকে তীর ছোড়েন বাদশা। মানবসন্তানের কান্নায় তিনি বুঝতে পারেন, চরম ভুল হয়ে গেছে। অভিশাপ নিয়ে রাজ্যে ফেরেন তিনি। এর মধ্যে পুত্র সন্তান ঘরে আসে তার। রাজ্যজুড়ে যখন আনন্দের বন্যা, বাদশার মনে সন্তান হারানোর ভয়। পুত্রকে প্রাসাদের বাইরে যেতে দেন না রাজা। কিন্তু শত আয়োজনেও বাদশাহ কি আটকে রাখতে পারে তার নিয়তি। বার বছর বয়সে বিশ্বিং যখন বড় ছেলে গহরকে রাজ্যের অধিপতি করে, তখন উজিরের চক্রান্তে গহর আবদার করে গিলামাইট বনে শিকার করতে যাবে। মায়ের আকুতি, স্ত্রী কলাবতীর মিনতি সব এড়িয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী সরাবনকে বাবাও মায়ের দায়িত্ব দিয়ে গহর যায় শিকারে। গিলামাইট বনে গিয়ে গহর বন্দী হয় বিশ্বিং দানবের হাতে। অবশেষে বহু যুদ্ধ ও সংগ্রামের পর সে বনের বানেছাপরীকে নিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে দেখে রাজ্য উজিরের দখলে। অবশেষে তার বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে জয় করে তার রাজ্য। সত্যের জয় অবধারিত, তাই সকল বাঁধা পেরিয়ে গহর পরিশেষে জয় করে বিশ্বিং রাজ্য। পৃথিবীর সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এক সময় সত্য, সুন্দর এবং মুক্তির পথে যেতেই হয়। গহর বাদশা বানেছাপরী নাটকের শেষটি ও আমরা দেখতে পাই সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে মুক্তির বিজয় নিশান ওড়াতে। নাটকটির পুনর্কথন ও নির্দেশনা দিয়েছেন হৃদি হক। কাহিনী বিন্যাস এবং নির্দেশনায় আমি বলব শতভাগ সফল হয়েছেন তিনি। প্রথমত আমার কাছে নাটকটি মঞ্চায়নে যে জিনিসটি সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছে তা হচ্ছে এর বিশাল ক্যানভাসের বিশাল আয়োজন। মঞ্চায়নে দেখেছি অসংখ্য অভিনেতা, অভিনেত্রী ও কলাকুশলী। কিন্তু সংখ্যাটি যে এতবড় ধারণা করতে পারিনি। নির্দেশক হৃদি হকের জবানীতে পরে জানতে পেরেছি ষাটের অধিক কর্মীর এক বিশাল টিমের সমন্বয়ে মঞ্চায়ন হয়ে চলেছে নাটকটি। এতবড় একটি টিম ম্যানেজমেন্ট করে গত কয়েক বছরে একের পর একের সফল মঞ্চায়ন করে যাওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। বলতেই পারি হৃদি হক এক গ্রেট বস এবং নির্দেশক। নাটকের কাহিনীর সঙ্গে সাজু খাদেমের নান্দনিক মঞ্চ পরিকল্পনা অনেক বেশি বিশ্বস্ত করে তুলেছে নাটকটিকে। সঙ্গীত ও আবহসঙ্গীত করেছেন কামরুজ্জামান রনি। তিনি তার কাজ দিয়ে দর্শক হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছেন। ওয়ার্দারিহাব তার সুন্দর কোরিওগ্রাফিতে মন ভরিয়ে দিয়েছেন। মাহমুদুল হাসান প্রত্যেকটা চরিত্রের সঙ্গে সার্থক পোশাক পরিকল্পনা করেছেন। আর আলোক পরিকল্পনায় ঠা-ু রায়হান বরাবরের মতোই মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তার আসাধারণ আলো আমাদের রূপকথার রাজ্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। সবশেষে অভিনয়ের কথা বলতেই হয়। নির্দেশনার পাশাপাশি বানেছাপরী চরিত্রে হৃদি নিজেকে উজাড় করে তুলে ধরেছেন। বিশ্বিং বাদশা, গহর বাদশা, উজিরসহ প্রতিটি চরিত্র তার যথাযথ চরিত্রের মাঝেই আবদ্ধ থেকে অভিনয় প্রচেষ্টা চোখে পড়েছে। এক মুহূর্তের জন্য চরিত্র থেকে কাউকে বের হতে দেখা যায়নি। পুরো কাজটিকে সমন্বয় করে সব মিলিয়ে এক দারুণ টিমওয়ার্ক আমাদের উপহার দিয়েছেন নির্দেশক হৃদি হক। ঢাকার মঞ্চে এক সার্থক মঞ্চায়ন বলতেই হয় এই নাটকটিকে। তরুণ নির্দেশক হৃদি হক এবং নাগরিক নাট্যাঙ্গন আমাদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতে ঢাকার মঞ্চে বেশি বেশি করে আরও বড় ক্যানভাসে বড় কাজ আমাদের উপহার দেবেন নির্দেশক হৃদি হক এবং নাগরিক নাট্যাঙ্গন সেটিই প্রত্যাশা। জয়তু হৃদি হক এবং নাগরিক নাট্যাঙ্গন।
×