ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গ্রাম বাংলার একাল সেকাল

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯

গ্রাম বাংলার একাল সেকাল

এক সময় গ্রাম বাংলায় নবান্নের আনন্দে ভরপুর ছিল। কার্তিক মাস আসলে মাঠের এবং ধান ক্ষেতের পানি একেবারে শুকিয়ে যেত। মাঠে তখন সোনালি ধানের ঢেউ খেলত। কৃষকরা তখন ধান কেটে বাড়ি নেয়া শুরু করত। তখন চারদিকে ধান কাটার ধুম পড়ে যেত। গ্রামের প্রতি বাড়িতে, বাড়িতে ধান তোলা শুরু হতো। কৃষক-কৃষাণীরা মাঠের ধান উঠানে বা আঙ্গিনার এক পাশে ঘুরিয়ে, ঘুরিয়ে মুরি বা পাড়া দিয়ে রাখত। সেই পাড়া বা মুরি থেকে উঠানের মাঝে বড় একটি কাঠ বা শক্ত কিছু পেতে সেই কাঠের মধ্যে ধান পিটিয়ে পিটিয়ে ধান তুলতো আবার সারা উঠানের মধ্যে ধান গাছ ছড়িয়ে, ছিটিয়ে দিয়ে অর্থাৎ মারা দিয়ে ধান গাছ থেকে ধান পৃথক করে নিত। গ্রাম বাংলার কৃষক সমাজ ধান লওয়ার জন্য এভাবে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করত। দেশ স্বাধীনের আগে এবং পরে আমর যতটুকু মনে পড়ে আশির দশক পর্যন্ত গ্রাম বাংলার মানুষেরা হাতে, মাটিতে বা কাঠের মধ্যে পিটিয়ে ধান গাছ থেকে ধান পৃথক করত। নব্বই এর দশক থেকে কৃষিকাজে বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মেশিনের সাহায্যে ধান লওয়া শুরু হয়েছে। ধান গাছ থেকে ধান পৃথক করার পর সেই ধান গুলিকে কুলা, চালুইন দিয়ে জেরে চিটাগুলো পৃথক করে ভাল বা পরিপক্ব ধানগুলো রোদে শুকিয়ে জাবারে বা ডোলে পুড়িয়ে রাখত। আবার কিছু ধান সিদ্ধ করে তৎক্ষণাৎ রোদে শুকিয়ে চালে পরিণত করত। আমরা মাকে দেখেছি, আব্বা যখন ক্ষেতের ধান কাটার সময় হতো তখন মার সঙ্গে আলাপ করত ক্ষেতের ধান পেকেছে ধান কেটে বাড়িতে আনতে হবে। তুমি মানুষ নিয়ে তৈরি হও, ধান লইতে হবে। তখন মা পাশের বাড়ির চাচি, জেঠি, খালা, বা বড় বোনদের বলত আগামী পরশু, তরশু আমাদের বাড়ি এসে ধান লইতে হবে এবং কাজ করে দিতে হবে। তখন সবাই হাঁসি মুখে আসত এবং সারাদিন এমনকি দুপুর রাত পর্যন্ত কাজ করে যেত। আমার মা এবং আমরা কোনদিন তাদের কাজের লোক বলতাম না। তারা আমাদের পরিবারের সদস্যদের মতো হয়ে খাওয়া-দাওয়া করত এবং বিভিন্ন রকমের নবান্নের পিঠা-পুলি তৈরি করে দিত এবং কাজকর্ম করত। এখন যেভাবে কাজের লোকদের সঙ্গে বাসায় বাড়িতে ব্যবহার করা হয়, গ্রাম বাংলার কাজের মানুষের সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করা হতো না। তারা পরিবারের সদস্যদের মতোই পরিবারে খাওয়া-দাওয়া এবং কাজকর্ম করত। সারা হেমন্ত এবং শীতকাল আমাদের পরিবারে বিভিন্ন পিঠা পায়েস তৈরি হতো এবং আমরা পরম তৃপ্তিসহকারে খাওয়া-দাওয়া করতাম। হেমন্তকালে গ্রামের মাঠ দিয়ে যখন স্কুলে আসা-যাওয়া করেছি তখন খুব আনন্দ লাগত। সারা মাঠে তখন সোনালি ধান দেখা যেত। ঝাঁকে-ঝাঁকে টিয়া পাখি ধান ক্ষেতে আসত এবং পাকা ধানের ছড়া নিয়ে উড়ে যেত। গ্রামের কৃষকরা ধান ক্ষেত থেকে ধান কেটে যখন বাড়ি আনত তখন সেই দৃশ্য খুবই সুন্দর লাগত। আবার দেখা যেত ধান ক্ষেতের গর্তে পানি ঢেলে ইঁদুর তুলত। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সেই দৃশ্য দেখত এবং মাঠের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করে ইঁদুর মারত। এই শীতের সকালে নবান্নের পিঠা পায়েস খেয়ে স্কুলে আসা-যাওয়ার মজাটা অন্যরকম ছিল। আমরা তখন ছিলাম খুব স্বাধীন, নেচে, গেয়ে হেসে-খেলে স্কুলে আসা-যাওয়া করেছি। এখন ছেলেমেয়েদের যেভাবে বইয়ের বোঝা কাঁদে নিয়ে চিন্তাযুক্ত মনে পড়ালেখা করে আমরা সেভাবে করছি না এবং এখনকার মতো প্রতি বছর বইও পরিবর্তন হতো না। আমরা তখন বই কিনে পড়েছি। যার বই নতুন দেখেছি তাকে আগে বলে রেখেছি আগামী বছর তোমার বইগুলো আমাকে দিও আমি কিনে নিব। আমরা এভাবে নতুন-পুরনো বই কিনে পড়ালেখা করেছি। বর্তমানে ছেলেমেয়েরা পুরাতন বই তো কিনা দূরের কথা ঘণ্টায়, ঘণ্টায় নতুন বই কিনে এবং পড়ে। এক বছর যে বইগুলো পড়েছে পরের বছর সে বইগুলো পড়ার প্রয়োজন বোধ মনে করে না। বার্ষিক পরীক্ষার ফল পাওয়ার পর নতুন ক্লাসে উঠে এবং বাজার থেকে নতুন বই কিনা হলে নবান্নের উৎসব আরও বেশি আনন্দ লাগত। যে বন্ধু নতুন বই কিনত তার বই আমরা দেখার জন্য গিয়েছি। তখনকার নতুন বই থেকে একটি নতুন গন্ধ বের হতো যা খুবই ভাল লাগত। এখনকার নতুন বই থেকে তখন কার নতুন বই খুব মজবুত ছিল। লেখা, ছাপা, কাগজ, বাঁধাই খুবই ভাল ছিল। দুই, তিন বছর পড়লেও তেমন ছিঁড়ে যেত না। এখন বই দেখলে মনে হয় ওয়ান টাইম ব্যবহারের উপযোগী। তখন কার বইয়ে গল্প, কবিতাগুলো শিক্ষামূলক, সামাজিক এবং চমৎকার ছিল। প্রথম, প্রথম জানুয়ারি মাসে নতুন, নতুন বই নিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া করতে খুবই ভাল লাগত। আমরা গ্রামের প্রায় সকল বন্ধুরা এক সঙ্গে আনন্দ সহকারে স্কুলে আসা-যাওয়া করতাম। তখন কবি বন্দে আলী মিয়ার আমাদের গ্রাম, রবিঠাকুরের ছোট নদী, কাজী নজরুলের খোকার সাধ, জসীমউদ্দীনের মামার বাড়ি, সুফিয়া কামালের পল্লী স্মৃতি ইত্যাদি কবিতাগুলো পড়তে খুবই ভাল লাগত। শীতের সকালে উঠে পূর্ব দিকে যখন সূর্য উঠত, বাড়ির আঙ্গিনায় সকালের রোদে বিছানা পেতে নবান্নের পিঠা-পুলি খেয়ে পড়তে এবং বিদ্যালয়ের বাড়ির কাজ করতে খুবই ভাল লাগত। অতি প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা বাঙালী সমাজের সেই নবান্নের উৎসব আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সামাজিক পাবির্তনের ফলে গ্রাম বাংলা আস্তে আস্তে নগরায়ণে পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রামের মা, বোনেরা আজ ঢেঁকি, কাইলে ধান ভানে না। আগে কাকডাকা ভোরে উঠে গ্রামের প্রতি বাড়ির মহিলারা ধান ভানত এবং বিভিন্ন রকমের গীত গাইত। সেই ঢেঁকি ছাঁটা চালের ভাত গ্রাম-শহরের মানুষ সবাই খেত। মেশিনে ধান, গম, ভাঙ্গার প্রচলন হওয়ার পর গ্রামের মানুষের অর্ধেকের বেশি পরিশ্রম কমে গেছে। বর্তমান প্রজন্মরা ফাস্ট ফুড বেশি পছন্দ করে। আমাদের ছেলেমেয়েরা সেই নবান্নের পিঠা-পায়েস ইত্যাদি তেমন পছন্দ করে না। তারা বিভিন্ন চাইনিজ খাবার এবং ফাস্টফুড খেতে ভালবাসে। এমনকি গ্রামে যেতেও পছন্দ করে না। তাই গ্রামের বিভিন্ন উৎসবসহ নানা কাজে তাদের অনীহা দেখা যায়। আমাদের সময় শেষ হওয়ার পর তাদের জীবনে নবান্নের উৎসব আর গ্রাম-বাংলায় দেখা যাবে কিনা সন্দেহ আছে। গ্রাম-বাংলায় শহরাঞ্চলের সংস্কৃতি ঢুকে নবান্নের উৎসবকে ম্লান করে দিয়েছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা নিজের বন্ধুদের জন্মদিনসহ বিভিন্ন পার্টির আয়োজন করে বিদেশী সঙ্গীত পরিবেশন করছে। হাজার বছরের বাঙালীর সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে হিন্দী এবং ইংলিশ সংস্কৃতি নিয়ে মেতে উঠছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের বাঙালীর নিজস্ব সংস্কৃতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আমার মনে হয়, তখন নবান্ন কথাটি বই পুস্তকে সীমাবদ্ধ থাকবে। বাস্তবে আর নাও দেখা যেতে পারে। কৃষি কাজে বিজ্ঞান আবিষ্কারের ফলে কৃষি কাজ যেমন সহজ এবং উন্নত হয়েছে তেমনি কিছু, কিছু সংস্কৃতি আছে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই নবান্নসহ গ্রামীণ বিভিন্ন সংস্কৃতি যেন হারিয়ে না যায় সেদিকে আমাদের খেয়াল রেখে কাজ করে যাওয়া উচিত। লেখক : শিক্ষাবিদ
×