ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজশাহীর গ্রামে পুকুর খননের হিড়িক, ভরাট হচ্ছে শহরে

ফসলি জমি হচ্ছে পুকুর, নগরে উঠছে ভবন

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯

ফসলি জমি হচ্ছে পুকুর, নগরে উঠছে ভবন

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ গ্রামে কৃষি জমিতে পুকুর খনন আর শহরে পুকুর ভরাটে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এখন কৃষি জমি নষ্ট করে গ্রামে গ্রামে শুরু হয়েছে পুকুর খননের মহাযজ্ঞ। একইভাবে ক্রমেই পুকুর ভরাট হয়ে যাচ্ছে শহর এলাকায়। শহরে বহুতল ভবন নির্মাণ আর গ্রামে তিন ফসলি কৃষি জমি নষ্ট করে চলছে পুকুর খনন। রাজশাহীর সর্বত্র এখন পুকুর ভরাট আর খননের কাজ চলছে শহর ও গ্রামে। ফলে দিন দিন কৃষি জমি কমছে গ্রামে আর শহরে পুকুরের ওপর গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। এ পরিস্থিতিতে আগামীতে শহরে যেমন পরিবেশ বিপর্যয়ে শঙ্কা রয়েছে একইভাবে গ্রামাঞ্চলে ক্রমেই কমে যাচ্ছে তিন ফসলি কৃষি জমির পরিমাণ। অথচ এ নিয়ে পরিবেশ অধিদফতর ও সিটি কর্পোরেশনের কোন নজরদারি নেই। যে যার মতো পারছে গ্রামে পুকুর খনন আর শহরে ভরাটের কাজে মত্ত। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে রাজশাহী নগরীতে ৯ বিঘার পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। আর রাজশাহীর গ্রামাঞ্চলে পুকুর খননের হিড়িক পড়েছে। বিভিন্ন দফতরে আবেদন ও অভিযোগ জানিয়েও উপকার পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা। তারা বলছে গ্রামের কৃষি জমিতে কোনভাবেই থামছে না পুকুর খনন। পুকুর খননের ফলে চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে গ্রামীণ পাকা রাস্তাগুলো। ধারণ ক্ষমতার বেশি মাটি বহনের কারণে ফাটল ধরছে পাকা রাস্তায়। প্রতিনিয়তই গ্রামীণ সড়ক ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে পুকুরের মাটি বোঝায় ট্রাক্টরের অবাধ চলাচলে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রশাসনের নীরব ভূমিকা ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থামছে না পুকুর খনন। দেদারসে পুকুর খননের কারণে প্রতিবছরই কমে যাচ্ছে ফসলি জমি। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জেলার প্রতিটি উপজেলায় চলছে পুকুর খননের হিড়িক। অভিযোগ উঠেছে আইন অমান্য করলেও ভূমির আকার পরিবর্তন করে পুকুর খননে রসদ ও সাহস জোগাচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুকুর খননের কারণে সাবাড় হচ্ছে কৃষি জমি। ফলে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে জেলার প্রায় ক্ষেতের মাঠে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। পুকুর সংলগ্ন প্রান্তিক ও বর্গা চাষীসহ দরিদ্র জনগণ হুমকির মুখে পড়ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজশাহী জেলায় কৃষি জমি খনন ও সরকারী খাল অবৈধ দখলে মেতেছে এক শ্রেণীর দখলদাররা। জেলার পবার পারিলা ইউনিয়নে চলেছে খাল দখলের মহোৎসব। যে কারণে একটু বৃষ্টি হলেও জলাবদ্ধতা দেখা দেয় ওই এলাকায়। এর আগে পুকুর খনন বন্ধ ও সরকারী খাল অবৈধ দখলমুক্ত করে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন দফতরে আবেদন করেন এলাকাবাসী। বর্তমানে ওই ইউনিয়নের ভবানীপুর, কাপাসমুল, শিরুলিয়া ও ঘোলহাড়িয়া গ্রামের ফসলের মাঠে চলছে পুকুর খনন। শুধু পবার পারিলা নয়, জেলার সব উপজেলায় শুরু হয়েছে পুকুর খননের হিড়িক। এস্কেভেটর মেশিন চলছে এখন ফসলের মাঠে মাঠে। কয়েক বছর ধরে উপজেলা পর্যায়ে পুকুর খননের হিড়িক পড়লেও একটি পুকুরও খনন বন্ধ হয়েছে এমন নজির নেই। অপরিকল্পিত পুকুর খননে এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় পুকুর সংলগ্ন কৃষকরা তাদের বিভিন্ন আবাদ নিয়ে পড়েছেন শঙ্কায়। সরেজমিন জেলার পবা উপজেলার ফলিয়ার বিল, হুজুরীপাড়ার কর্ণহার বড় বিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায় লাগাতার পুকুর খননে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে ফসলি জমি ও বিল। হুজুরীপাড়ার কর্ণহার বড়বিলের মধ্যে দিয়ে জুকার ডারা স্লুইস গেট থেকে বাগধানী স্লুইস গেট পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটারের খাল রয়েছে। কর্ণহার বড় বিলের পানি নিষ্কাশনের খাল দখলে নিয়ে তেঁতুলিয়া গ্রামের লিটন আলী বিশাল পুকুর খনন করেন। তার দেখাদেখি প্রভাবশালীরা সেখানে আরও দুটি পুকুর খনন করেন। কিছুদিন আগে আবারও পুকুর খনন করতে থাকলে কর্ণহার বড়বিল পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির সভাপতি নুরুল আমিন সিদ্দিকী অভিযোগ দিলে পবা উপজেলা প্রশাসন বন্ধ করে দেন। তবে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন কর্ণহার পুলিশের সঙ্গে প্রভাবশালীদের অবৈধ যোগাযোগ থাকায় উপজেলা প্রশাসন থেকে অভিযানে আসার আগেই ওরা খবর পেয়ে পালিয়ে যায়। বর্তমানে উপজেলার সুন্দরপুর ঘোষপুকুরে পুকুর খনন করছেন রাহিদুল ইসলাম, তেঁতুলিয়া জোড়গাছার মাঠে তেঘর গ্রামের শাহজাহান আলী পুকুর খনন করছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও আলোকচ্ছত্রে খড়িয়াকান্দি এলাকার মজিবুরের ছেলে রবিউল ও দুর্গাপুরের মৃত জেসারতের ছেলে আব্দুর রহিদ যৌথভাবে পুকুর খনন করছেন। এলাকার কৃষকের কাছ থেকে বার্ষিক বিঘাপ্রতি ১৪ হাজার টাকায় জমি লিজ নিয়ে এই পুকুর খনন করছেন। জেলার বাগমারা ও দুর্গাপুরেও চলছে পুকুর খননযজ্ঞ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন, যেভাবে পুকুর খনন হচ্ছে- এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কবরস্থানেরও জায়গা থাকবে না। পবার পারিলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুল বারী ভুলু জানান, কয়েক বছর থেকে তার ইউনিয়নের অর্ধেক জমি পুকুর হয়ে গেছে। বাকি কৃষি জমিতেও নতুনভাবে পুকুর খননে মেতে উঠেছে প্রভাবশালীরা। গ্রামের ফসলি মাঠে যখন পুকুর খননের হিড়িক পড়েছে তখন শহরের পুকুর ভরাট হচ্ছে দেদারসে। ২০০৯ সাল থেকে রাজশাহী নগরীর পরিবেশ বিপর্যয় রোধে সব ধরনের পুকুর/জলাশয় ভরাট স্থগিত ঘোষণা করে উচ্চ আদালত। তবে আদালতের নির্দেশ মানছেন না কেউ। এরই মধ্যে রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জের প্রায় ৯ বিঘা (তিন একর) পরিমাণের একটি পুকুর গত ১৫ দিনের মধ্যে প্রায় ভরাট করে ফেলা হয়েছে। কিছু অংশ বাকি আছে, সেটিও দুই-তিন দিনের মধ্যে ভরাট সম্পন্ন হবে। পদ্মা নদী থেকে ট্রাকে করে বালু নিয়ে এসে পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নগরীর কাড়িরগঞ্জ এলাকায় হেতেম খাঁ কবরস্থানের উত্তরে বিশালাকায় ওই পুকুরটির অধিকাংশ ভরাট করে সেখানে বালু ফেলে রাখা হয়েছে। পুকুরের দক্ষিণ দিকে একটু অংশ বাকি আছে, সেখানে পানি টলমল করছে। স্থানীয়রা বলেন, পুকুরটি গত ১৫ দিন ধরে ভরাট করা হচ্ছে। এখানে ভবন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েই পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে। স্থানীয় নূরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, পুকুর যেভাবে ভরাট হচ্ছে, এ নিয়ে প্রশাসন কোন পদক্ষেপ নেয়নি। জানতে চাইলে রাজশাহী পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক মামুনুর রশিদ বলেন, পুুকুর ভরাট নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমরা অভিযোগ পেয়ে থাকি। এগুলো নিয়ে স্থানীয় থানা বা সিটি কর্পোরেশন ব্যবস্থা নিতে পারেন বলে দায় এড়ান তিনি। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বলেন, পুকুর ভরাটের কোন তথ্য আমাদের কাছে নাই। তিনি বলেন, নানা কারণে পুকুর ভরাট বন্ধ করার উদ্যোগ আমরা নিতেও পারি না।
×