বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিগত ১০ বছরে দেশের যে উন্নয়ন হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে তার চেয়ে বেশি উন্নয়ন করতে হবে। আর তা বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রশাসনসহ সকল ক্ষেত্র দুর্নীতি মুক্ত করতে হবে। তাই কেউ দুর্নীতি করলে, ছাড় নয় সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তা হলে দেশের মানুষ সঠিকভাবে সেবা পাবে। পাশাপাশি প্রশাসনকে দক্ষ ও গতিশীল করতে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার সকালে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশ দেন।
সকাল দশটায় শুরু হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এই মেয়াদের প্রথম সমন্বয় বৈঠক। শুরুতে কুশলবিনিময় সম্পন্ন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহমদ সূচনা বক্তব্য দেন। পরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বক্তব্য দেন। এর পরই প্রধানমন্ত্রী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। শুরুতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে এলাকায় বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয় সেই এলাকা থেকে এই প্রথম মন্ত্রী করা হয়েছে। তাও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোঃ নজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মোঃ আবুল কালাম আজাদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুনির্দিষ্ট একটা নির্দেশনা যেতে হবে একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত, কেউ দুর্নীতি করলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। যে লক্ষ্য আমরা নিয়েছি আশাকরি তা পূরণ করতে পারব। তার জন্য প্রয়োজন সুশাসন, তার জন্য দরকার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা।
তিনি বলেন, আমরা বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা এত বেশি বৃদ্ধি করে দিয়েছি- সেই ক্ষেত্রে আমি তো মনে করি, আমাদের দুর্নীতির কোন প্রয়োজনই নেই, যা প্রয়োজন এর সব তো আমরা মেটাচ্ছি, তাহলে দুর্নীতি কেন হবে? কাজেই এখানে মানুষের মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। মানুষের সেবা করতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষের কথা ভাবতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধেও আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ, মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা দিয়েছি। তেমনি দুর্নীতির বিরুদ্ধেও ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা দিয়েছি।
কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা সরকার পরিচালনার মূল জায়গাটা হলো এই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ এখানে। সে ক্ষেত্রে আপনাদের দায়িত্ব কিন্তু অনেক অনেক বেশি। রাষ্ট্র পরিচালনার হার্ট জনপ্রশাসন। আপনাদের সেভাবে কাজ করতে হবে, আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করবেন।
পদোন্নতির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে শুধু জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি নয়, এখানে দক্ষতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। কে কত বেশি কাজ করতে পারে, সততার সঙ্গে কাজ করতে পারবে এবং নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলবে- সব কিছু বিবেচনা করে পদোন্নতি হওয়া উচিত।
পদ ফাঁকা পেলেই পদায়ন নয়- মন্তব্য করে যার যে বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ রয়েছে তাকে সেই জায়গায় পদায়ন করারও নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল সুবিধা ব্যবহার করার মাধ্যমে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত হতে পারে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা সময় বাংলাদেশে দরপত্রের বাক্স ছিনতাই হতো। আমরা ই-টেন্ডারে চলে গেলাম। এখন আর টেন্ডার বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা শোনা যায় না। এভাবেই আমি মনে করি, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা অনেকটা নিশ্চিত করা যায়, আমরা সেটাও করব।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ধরা হলেও এটা ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য থাকবে, প্রবৃদ্ধি এই পাঁচ বছরের মধ্যে যেন ১০ ভাগে উন্নীত করতে পারি। বিগত ১০ বছরে দেশের যে উন্নয়ন হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে তার চেয়েও বেশি উন্নয়ন করতে হবে। এটা সবাই মনে রেখে কাজ করবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যে লক্ষ্য স্থির করেছি সেটা আমরা করতে পারব। এজন্য দরকার সুশাসন, দরকার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা। আমরা সরকারী কর্মচারী আইন পাস করেছি ২০১৮ সালে। এখন এ আইনটা কার্যকর হবে। কার্যকর করার সময় অনুশীলন করতে থাকব। এ সময় এর সমস্যাটা চোখে পড়তে পারে। তখন প্রয়োজন মতো এটা সংশোধনও করা যাবে। তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে। ৬ মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ অন্তত এক বছর মেয়াদী হতে হবে। আগে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ হবে করতে হবে। প্রফেশনাল প্রশিক্ষণ পরে হবে। আর বিদেশে প্রশিক্ষণে যে যে বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেবে, তাকে সেই সংশ্লিষ্ট পদে পদায়ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী সচিবদের হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণে না পাঠিয়ে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সচিবরা দেশের কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাদের চাকরিও থাকে শেষ পর্যায়ে। তাই অপেক্ষাকৃত নবীনদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তারা বেশি দিন দেশকে উন্নত সেবা দিতে পারবেন।
তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের জন্য একটি সমন্বিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গঠন করতে হবে। কর্মকর্তাদের জন্য সকল প্রশিক্ষণই যেখানে হবে। পুরো এলাকা একটি শহরের মতো করে গড়ে তুলতে হবে। সেখানে সব সুযোগ-সুবিধাও থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, একটি সমন্বিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়তে কেরানীগঞ্জের মেগার চর এলাকায় ২০ একর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজারেও একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যা যা প্রয়োজন সবই করা হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। প্রশাসনকে গণমুখী, জনবান্ধব করতে হবে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যে সকল কর্মকর্তারা ঢাকায় আসেন, তাদের থাকার জন্য ব্যবস্থা বাড়ানো হবে। প্রশাসনের শূন্য পদ পূরণের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
দশম জাতীয় সংসদের মতো এবারও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিদর্শন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের মাধ্যমে সেই কার্যক্রম শুরু করলেন তিনি। কাজে গতিশীলতা আনতে ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে ২৯৯ আসনের মধ্যে ২৫৭টিতে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জোটগতভাবে তারা পেয়েছে ২৮৮ আসন। অন্যদিকে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ও তাদের জোট (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) পেয়েছে মাত্র আটটি আসন। পরে ৭ জানুয়ারি ৪৬ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া ২৪ মন্ত্রী, ১৯ প্রতিমন্ত্রী ও তিন উপমন্ত্রী রয়েছেন।