ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড়, কিন্তু ঋণ পাচ্ছে না গ্রাহক

ব্যাংক ঋণ কি সোনার হরিণ ॥ নারী উদ্যোক্তারাই বেশি হয়রানির শিকার

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯

ব্যাংক ঋণ কি সোনার হরিণ ॥ নারী উদ্যোক্তারাই বেশি হয়রানির শিকার

রহিম শেখ ॥ গাজীপুর জেলার উদ্যোক্তা মোহাম্মদ মহসিন। প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে ব্যবসায় নামেন। ৯ বছর ধরে তিনি পরিবহন ও পার্টস ব্যবসা করে আসছেন। তার প্রতিষ্ঠানের নাম মহসিন অটো সেন্টার। গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে তিনি একটি বেসরকারী ব্যাংক থেকে প্রায় ১৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। বিপরীতে ব্যাংকে জামানত রেখেছেন ২৪ শতক জমি। নির্ধারিত সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করলেও ব্যবসা সম্প্রসারণে আরও ১৬ লাখ টাকা ঋণের আবেদন করেন তিনি। কিন্তু আবেদনের এক বছরেও ঋণ পাননি তিনি। শুধু মহসিন নন, বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আরেক উদ্যোক্তা অনলাইন প্রতিষ্ঠান গুটিপার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমা মিজি। জানালেন, ব্যবসা শুরুর দিকে একটি বেসরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নেন তিনি। ঋণ পেলেও প্রথমে তার আবেদন নাকচ করা হয়। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমার ফাইলটা ফেরত পাঠিয়ে দেয় ওরা। তারা ঋণ দিতেই চায় না। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশের কথা বললাম। তারা তখন বলে মেয়াদ নেই, আরও নানা অজুহাত দেখিয়ে ফাইল ফেরত পাঠায়। পরে ওই ব্যাংকেরই এক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাকে দিয়ে বারবার বলিয়ে ফাইলটার কাজ শুরু করা হয়। রি-পেমেন্টসের বিষয়ে তাদের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। এরপর আমার ফাইল ওরা আবার রিভিউ করে।’ আরেক উদ্যোক্তা আসিফা রহমান। ’১৬ সাল থেকে নিজ উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করেন। গত বছরের শুরুতে একটি বেসরকারী ব্যাংকের অনুকূলে এসএমই ঋণের জন্য আবেদন করেন তিনি। কাগজপত্রের জটিলতা দেখিয়ে এখন পর্যন্ত সে ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়নি। তিনি আদৌ ব্যাংক ঋণ পাবেন কি-না জানেন না আসিফা। একটি সরকারী ব্যাংকের গ্রাহক হাবিবুর রহমান বলেন, ১ লাখ টাকা ঋণ চেয়ে ৬ মাস ঘুরেছি। ঋণ পাইনি। শুধু সরকারী ব্যাংক নয়, বেসরকারী প্রায় সব ব্যাংকে এ ধরনের ঘটনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বলেন, একটি বেসরকারী ব্যাংকে ১৫ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেছি। ব্যবসা সন্তোষজনক হওয়ার পরও ঋণ দেয়নি ব্যাংকটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংক ঋণ নিয়ে প্রতিটি উদ্যোক্তারই রয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। উদ্যোক্তারা বলছেন, অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা ঋণ দিতে শুধু ঘুষই দাবি করেন না। থাকে আরও অনেক আবদার। এসব কারণে অনেক নারী ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা বলছেন, ব্যাংক ঋণ যেন সোনার হরিণ। ঋণ নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে অনেকেই ইদানীং এনজিও থেকে ঋণ নিচ্ছেন। জাতীয় শিল্পনীতি-’১৬ অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার মধ্যে ঋণ বিতরণ করতে হবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ’১৮ সালের ৬ মাসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে (এসএমই) ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে ঋণ বিতরণ করেছে, তার মধ্যে নারীরা পেয়েছেন মাত্র ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে সব বাধার মুখোমুখি হন, তা হচ্ছে হয়রানি। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ঋণের বিষয়ে অজ্ঞতা বা ভীতিও কাজ করে নারীদের মাঝে। এই পরিস্থিতিতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু নীতি-সমর্থন ও বাড়তি সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উইমেন চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিডব্লিউসিসিআই) উইমেন চেম্বারের সহসভাপতি হাসিনা নেওয়াজ জনকণ্ঠকে বলেন, এসএমই খাতের জন্য ঋণের মোট বরাদ্দের ১৫ শতাংশ পাওয়ার কথা নারী উদ্যোক্তাদের। সেই ঋণ ব্যাংকগুলো দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা পাচ্ছেন মূলত ঢাকার বড় কয়েকজন। ব্যাংকগুলো নিয়ম রক্ষায় ঋণ দিয়ে শুধু কোটা পূরণ করছে। জানা গেছে, গ্রাহক ঋণ পাচ্ছে না অথচ ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। বর্তমানে তা আরও বেড়েছে। এ টাকা মূলত অলস অর্থ। এসব অর্থের বিনিয়োগ বাড়াতে এবং আমানতের চাপ কমাতে ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের সুদের হার কিছুটা সমন্বয় করলেও গত দুই বছরে ব্যাংকগুলো ব্যাপক হারে আমানতের সুদের হার কমিয়েছে; কিন্তু সেই হারে ঋণের সুদের হার কমায়নি। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর আয় কমে যায়। আয় বাড়াতে ঋণের ওপর যখন তখন চার্জ আরোপ করছে, আবার সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে যে গ্রাহক ইতোমধ্যে ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন তাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং রিফর্মস উপদেষ্টা এস কে সুর চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, চলমান, তলবি ও মেয়াদী ঋণের যেসব গ্রাহক টানা তিন বছর ভালভাবে ঋণ পরিশোধ করেছেন, যাদের কোন ঋণ শ্রেণীকৃত হয়নি এবং তিন বছরের মধ্যে কোন প্রতিষ্ঠানে তাদের ঋণ খেলাপী হয়নি, তারা ‘ভাল ঋণগ্রহীতা’। এমন গ্রাহকদের ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন, ভাল উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে দেশের কার্যরত সকল ব্যাংকই আন্তরিক। জানা যায়, মূলত ঋণ দেয়ার সময় বেশকিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। ওই শর্তের বেড়াজালে স্বল্পসুদের ঋণেও উচ্চ হারে সুদারোপ করছে ব্যাংকগুলো। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় কোন সুফল পাচ্ছিল না গ্রাহক। এমনকি অতিরিক্ত সুদহার থেকে রেহাই পেতে কোন কোন গ্রাহক মেয়াদপূর্তির আগেই ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করেন; কিন্তু তাতেও পুরো মেয়াদ হিসাব করে তার ওপর নির্দিষ্ট হারে সুদ আদায় করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো এক গ্রাহকের অভিযোগে দেখা যায়, ওই গ্রাহক ১১ শতাংশ সুদে একটি বিদেশী ব্যাংকে ২০ বছর মেয়াদে ‘গৃহঋণ’ গ্রহণ করেন; কিন্তু অনেক শর্তের ভেতরে একটি শর্ত ছিল ২ বছর পর ব্যাংকটি সুদ পরিবর্তন করতে পারবে। ওই শর্তের ওপর ভিত্তি করে ২ বছর পরই ঋণের সুদ ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। এর প্রতিকার চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করেন ওই গ্রাহক; কিন্তু আগে থেকেই শর্ত থাকায় এবং এ সংক্রান্ত কোন আইন বা নির্দেশনা না থাকায় ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখনও এ ধরনের অনেক অভিযোগ আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। সূত্র জানায়, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন খাত দেখিয়ে সার্ভিস চার্জ আদায় করে ব্যাংক। যেমন কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্পের ঋণের প্রায় ১৬ থেকে ১৮ ধরনের চার্জ আদায় করছে ব্যাংকগুলো। লোন এপ্লিকেশন ফি, লোন প্রসেসিং ফি, ডকুমেন্টেশন ফি, সার্ভিস চার্জ, লিগ্যাল ফি, সার্ভে ফি, মর্টগেজ ফি, আর্লি সেটেলমেন্ট ফি, ব্যাংক গ্যারান্টি, মনিটরিং ফি, রিনিউয়াল ফি ইত্যাদি নামে চার্জ আদায় করে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি চার্জের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে কোন কোন ব্যাংক। এতে ঋণের কার্যকর সুদ হার ৪ থেকে ৬ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। কোন গ্রাহক চলতি ঋণ হিসেবে যদি ১০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন, দুই মাসে সুদসহ ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করার পর বাকি ৬ লাখ টাকাও পরিশোধ করতে চান, তাহলে তাকে ওই টাকার বিপরীতেও সুদ পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রাহকের স্বাক্ষর সম্বলিত পাঁচ থেকে ছয়টি ব্লাঙ্ক চেক নেয় ব্যাংক। ওই চেক নিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তারা টাকা আত্মসাত করেছেন বলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে লিখিত অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কোন কারণে গ্রাহক টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে বা গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক খারাপ হলেও জামানত হিসেবে নেয়া চেক দিয়ে আদালতে মামলা করে ব্যাংক। এক্ষেত্রে গ্রাহকের এ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চেক ফেরত আসায় ডিজঅনার মামলা করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান বলেন, চেক গ্রহণ করা ঋণের বিপরীতে এক ধরনের সিকিউরিটি। যথাসময়ে ঋণ ফেরত না দিলেও ওই সিকিউরিটি ব্যবহার করেই আদালতে মামলা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সুদ সব সময় বাজারভিত্তিক রাখার জন্য সুদ পরিবর্তনের শর্ত থাকে; কিন্তু আমাদের দেশে ব্যাংক কখনও সুদ কমায়নি, সব সময় বাড়ায়। এটি হয়েছে কারণ ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়নি। গ্রাহকরা এক ধরনের মনোপলির মধ্যে পড়ে গেছেন। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণগ্রহীতারা বেশি বিপাকে। সুদ থেকে রেহাই পেতে গ্রাহক আগেই ঋণ পরিশোধ করতে চাইলে সেক্ষেত্রে আর্লি সেটেলমেন্ট ফি আদায় করছে। এগুলো বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। কোন ঋণের ক্ষেত্রে অহেতুক সুদহার বাড়ানো হচ্ছে কি না তা দেখার উদ্যোগ নিতে হবে।
×