ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুপারনোভায় বিলুপ্তি সাগরের বিশাল প্রাণী

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯

সুপারনোভায় বিলুপ্তি সাগরের বিশাল প্রাণী

আজ থেকে প্রায় ২৬ লাখ বছর আগে প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর আকাশে দারুণ উজ্জ্বল আলোর আগমন ঘটে যা থেকে যায় কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস। ওটা ছিল সুপারনোভার আলো এবং সেই সুপারনোভা ছিল পৃথিবী থেকে প্রায় দেড় শ’ আলোকবর্ষ দূরে। আকাশের সেই অদ্ভুত আলো ফিকে হয়ে আসার বেশ পরে কয়েক শ’ বছরের মধ্যে সেই একই সুপারনোভা বা ধ্বংসপ্রাপ্ত নক্ষত্রের বিস্ফোরণ থেকে উদ্ভূত মহাজাগতিক এনার্জির এক সুনামি আমাদের এই গ্রহে এসে এবং বায়ুম-লে আঘাত হেনে থাকতে পারে। এর ফলে সম্ভবত জলবায়ুগত পরিবর্তন ঘটেছিল এবং তাতে স্কুল বাসের মতো আকারের বিশাল এক হাঙ্গরের প্রজাতিসহ সাগরের বড় বড় জীবজন্তুর ব্যাপক বিলুপ্তি ঘটেছিল। সাগর-মহাসাগরের বড় বড় প্রাণীর ওপর এমন এক এবং সম্ভবত একাধিক সুপারনোভার বিরূপ প্রভাব নিয়ে এক বিস্তারিত নিবন্ধ সম্প্রতি এ্যাস্ট্রোবায়োলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। সেই নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্র ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক এমেরিটাস এড্রিয়ান মেলোট লিখেছেন, ‘আমি ১৫ বছর ধরে এ বিষয়ের ওপর গবেষণা করেছি। এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে সাধারণভাবে আমরা যা জানি তার ভিত্তিতে অতীতে সর্বদাই এমন ধারণা ব্যক্ত হয়েছে যে এসব সুপারনোভা কোন না কোন সময় পৃথিবীর ওপর প্রভাব ফেলে থাকতে পারে। কিন্তু এবার ব্যাপারটা ভিন্ন রকম। আমাদের কাছে এক সুনির্দিষ্ট সময়ে কাছাকাছি এলাকায় সংঘটিত ঘটনাবলীর তথ্য-প্রমাণ আছে। সেই ঘটনাবলী কত দূরে সংঘটিত হয়েছে সে সম্পর্কে আমরা জানি। কাজেই সেই ঘটনাবলী কিভাবে আমাদের পৃথিবীর ওপর প্রভাব রেখেছে তা আমরা প্রকৃতপক্ষে হিসাব করে বলতে পারি এবং সেই সময় কি ঘটেছিল সে সম্পর্কে আমাদের জগত তথ্যের সঙ্গে এর তুলনা করে দেখতে পারি। সেটা আরও বেশি সুনির্দিষ্ট হবে।’ মেলোট বলেন, সাম্প্রতিককালের নিবন্ধগুলোতে প্রাচীন পৃথিবীর সাগর তলদেশে লৌহ-৬০ আইসোটোপ জমে থাকা নিয়ে যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তা থেকে সুপারনোভার সময় ও দূরত্ব সম্পর্কে জোরালো প্রমাণ মেলে। তিনি লিখেছেন, ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি লোকে বলত, ‘ওহে আয়রন-৬০ আইসোটোপের সন্ধান কর। ওটা এক মস্ত সূত্র। কারণ সুপারনোভা ছাড়া অন্য কোন উৎস থেকে ওটার পৃথিবীতে আসার আর কোন উপায় নেই। যেহেতু আয়রন-৬০ তেজস্ক্রিয় তাই পৃথিবীর জন্মের সময় এই পদার্থ তৈরি হয়ে থাকলে অনেক আগেই এর বিলুপ্তি ঘটে থাকত। কাজেই এটা পৃথিবীতে বাইরে থেকে বর্ষিত হতে হয়েছিল। তবে আমাদের কাছাকাছি একটি সুপারনোভা নাকি একাধিক সুপারনোভা ছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। মেলোটের মতে একাধিক সুপারনোভা ছিল এবং তার মধ্যে একটি ছিল অস্বাভাবিক শক্তিশালী ও নিকটবর্তী। আয়রন-৬০ আইসোটাটোপের কিছু কিছু অবশেষ বিশ্লেষণ করলে ২৬ লাখ বছরের পুরনো এবং কিছু কিছু আইসোটোপ ১ কোটি বছরের পুরনো বলে দেখা গেছে। কাছাকাছি একাধিক সুপারনোভার যে উদ্ভব ঘটেছিল তার আরেক প্রমাণ আমাদের মহাবিশ্বের খোদ স্থাপত্যের মধ্যেই নিহিত বলে মেলোট ও তাঁর দল মনে করেন। তাদের মতে সৌরজগতের বাইরের নক্ষত্রম-লীর মধ্যে রয়েছে বিশাল বুদবুদ। সেই বুদবুদের একেবারে প্রান্তে রয়েছে আমাদের অবস্থান। এই বুদবুদের মতো অঞ্চলটি এক বিশাল অঞ্চল যা প্রায় ৩শ’ আলোকবর্ষ লম্বা। অঞ্চলটি মূলত অতি উত্তপ্ত অতি লঘু ঘনত্বের গ্যাসমালা। সুপারনোভার কারণে এই অঞ্চলটি মহাজাগতিক রশ্মী দ্বারা স্নাত হয়েছে। সেই স্নান ১০ হাজার থেকে ১ লাখ বছর স্থায়ী হয়েছে। সুপারনোভা একটি থাক বা এক গুচ্ছ থাক, এ থেকে নির্গত এনার্জি পৃথিবীব্যাপী আয়রন-৬০ এর স্তর ছড়িয়ে দিয়েছিল। সেই সঙ্গে মুওন নামে অন্তর্ভেদী বস্তুকণাও পৃথিবীতে বর্ষিত হয়েছিল যা থেকে প্রাণী জগতে বিশেষ করে বড় বড় প্রাণীর মধ্যে ক্যান্সার ও মিউটেশন ঘটেছিল। মুওন হলো অতিমাত্রায় ভারি ইলেকট্রন। একটা ইলেকট্রনের তুলনায় কয়েক শ’ গুণ বেশি বড় ও ভর সম্পন্ন। এগুলো তীক্ষè অন্তর্ভেদী। স্বাভাবিক অবস্থায় অসংখ্য মুওন আমাদের শরীর ভেদ করে চলে যায়। প্রায় সবই আমাদের শরীর ভেদ করে চলে গেলেও কোন ক্ষতিসাধিত হয় না। মনে রাখতে হবে আমাদের বিকীরণ মাত্রার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আসে মুওন থেকে। তবে মহাজাগতিক রশ্মীর তরঙ্গ আঘাত হানলে এই মুওনের সংখ্যা কয়েক শ’ গুণ বেড়ে যায়। মুওনের সংখ্যা যদি খুব বেশি থাকে এবং এদের এনার্জিও যদি অত্যধিক হয় তাহলে মিউটেশন ও ক্যান্সারের আধিক্য বাড়ে। এটাই হচ্ছে মহাজাগতিক রশ্মীর প্রধান জৈবিক প্রভাব। হিসাব করে দেখা গেছে মানবদেহের সাইজের কোন প্রাচীর ক্যান্সার হওয়ার হার। এই অবস্থায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যাবে। সেই প্রাণী আকারে যত বড় হবে তার ক্যান্সারের ঝুঁকিও ততই বেশি হবে। ২৬ লাখ বছর আগে সুপারনোভার যে বিচ্ছুরণ ঘটেছিল এবং তার বিকীরণের ঢেউ পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছিল তার কারণে প্লায়োসিন-প্লেইস্টোসিন যুগের মাঝামাঝি অধ্যায়ের সাগরের বড় বড় প্রাণীতে বিলুপ্তি ঘটে থাকতে পারে। এই সময়কার ৩৬ শতাংশ প্রাণীবর্গ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বিলুপ্তিটা কেন্দ্রীয়ভূত ছিল উপকূলীয় জলরাশিতে। সেখানে বড় প্রাণীগুলো মুওনের অধিকতর বিকীরণমাত্রা লাভ করেছিল। মুওনের ধ্বংসযজ্ঞ উপকূল থেকে শত শত গজ দূরের সাগরের জলরাশিতে বিস্তৃত হয়েছিল। যত বেশি গভীরের জলরাশি ততই এর তীব্রতা কমে এসেছিল। বস্তুতপক্ষে অগভীর জলরাশির থাকা বিশাল বিশাল ও হিংস্র প্রাণীগুলো সুপারনোভার বিকীরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে থাকতে পারে। ২৬ লাখ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীদের একটি ছিল মেগালোডন। স্টিভেন স্পিলবার্গের বিখ্যাত ছায়াছবি ‘জস’-এর সেই গ্রেট হোয়াইট শার্কের কথা ভেবে দেখুন। কি বিশাল হাঙ্গর ছিল সেটা। ওটা ছিল মেগালোডন। একটা স্কুল বাসের সমান। প্রাণীটি ওই সময়ের দিকে লুপ্ত হয়েছিল মুওনের প্রভাবে এদের বিলুপ্তি ঘটেছিল বলে অনুমান করা যেতে পারে। আকারে যত বড় প্রাণী তাদের বিকীরণের স্পর্শ ততই বেশি হয়েছিল। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×