ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এক কৃতী নারীর সফল মা হয়ে ওঠা

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯

এক কৃতী নারীর সফল মা হয়ে ওঠা

এক প্রতিভাময়ী নারী গর্ভ থেকে তিন মেধাবী নারীর জন্ম। যাদের প্রত্যেকেই রত্ন, বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত। জন্মদাত্রী নিজেও একজন গুণী মানুষ। বগুড়ায় জন্ম নেওয়া আলোকিত এই নারী নজরুল সঙ্গীতে স্বর্ণপদক লাভসহ ‘সঙ্গীত প্রভা’ উপাধি পেয়েছেন। আলোকিত এই মানুষটি অনেকটাই আড়ালে চলে গেলেও পারিবারিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির লালিত্য স্নেহে ঠিকই তার প্রতিভার কিরণদ্যুতি ছড়িয়েছেন। সঙ্গীতপ্রতিভা দিয়ে তিনি তার জাত চিনিয়েছিলেন। তাঁর তিন মেয়ে এখন স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। মহীয়সী এই নারীর নাম তাহমিদা হোসেন রুমা। ১৯৫৭ সালের ২ জানুয়ারি বগুড়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন সফল এই রত্নগর্ভা মানুষটি। তার পিতা প্রয়াত তাজমিলুর রহমান ছিলেন বগুড়া জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের খ্যাতি পাওয়া তাজমিলুর রহমান কবি হিসেবেও সুখ্যাত ছিলেন। তার মা আনোয়ারা রহমানও অধ্যক্ষ ছিলেন। সাহিত্যিক হিসেবেও ছিল সুখ্যাতি। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া তাহমিদা হোসেন রুমা নিজে এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও আশির দশকে বগুড়ার সাংষ্কৃতিক অঙ্গনে তিনি নামডাক ছড়িয়েছিলেন। ফলস্বরূপ বগুড়া শিল্পকলা একাডেমি শিল্পীপুলের ‘এ’ গ্রেডের শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। বগুড়া জেলা পরিষদ আয়োজিত নজরুল গীতি প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদকও লাভ করেন তিনি। সিরাজগঞ্জে আয়োজিত সঙ্গীত অনুষ্ঠানে তিনি ‘সঙ্গীত প্রভা’ উপাধি লাভ করেন। রংপুর বেতারে ‘নজরুল পরিষদ’এর শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং বিটিভির ‘নবকল্লোল’ অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। মুলত আশির দশকের সঙ্গীতাঙ্গনে অর্থাৎ আধুনিক গান, রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীতে তাহমিদা রুমা সোনা ফলিয়েছিলেন। তবে জাতীয় পর্যায়ে সুনাম কুড়ানোর আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকে। যে কারণে ধীরে ধীরে তার প্রতিভাও অস্ত যেতে থাকে! তবে সঙ্গীত অঙ্গনের খেরোখাতা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায় তাঁর সন্তান ভাগ্যের সম্পদ। তিন কন্যা সন্তানের জননী এখন সফল জননীই নয় রত্নগর্ভা। তাহমিদা রুমার দক্ষতা ও অর্জন আজ সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে অহঙ্কার করবার মতো বিষয়। তাহমিদা রুমার প্রথম সন্তান মাহবুবা হোসেন (৩২তম বিসিএস) বগুড়া মুজিবুর রহমান সরকারী মহিলা কলেজের ইংরেজী প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। জামাতা মোঃ হাবিবুল হাসান (৩৩তম বিসিএস) নওগাঁর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত। দ্বিতীয় সন্তান মাহামুদা হোসেন (৩৪তম বিসিএস) ঝিনাইদহের শৈলকুপা সরকারী কলেজে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক। জামাতা মোঃ নজরুল ইসলাম (৩৪তম বিসিএস) ময়মনসিংহের গৌরিপুর সরকারী কলেজে প্রাণিবিদ্যার প্রভাষক। তৃতীয় সন্তান মনজিরা হোসেন ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্নি চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্বে আছেন। রত্নগর্ভার স্বামী মোসাদ্দেক হোসেন হেলাল পেশায় ইঞ্জিনিয়ার (অব:) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। ষোলোআনা সংসার বলা যায় তাঁর। গানের বুলবুল রুমা বিয়ের পর থেকে সংসারের বিবি হয়ে ঠিকই গৌরবের অধিকারিণী হয়েছেন। একদিকে স্বামীর জন্য অন্যদিকে সন্তানদের জন্য গর্ববোধ করেন। আর দেশ গর্ব করে তাঁর জন্য। এই মেধাবী, অদম্য, সাহসী নারী নিজের স্বপ্ন, লক্ষ্যে হয়তো পুরোপুরি পৌঁছতে পারেননি তবে সন্তানদের মধ্যে তার স্বপ্ন বুনে গেছেন। এবং ঠিকই তারা লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। তাঁর রক্তে আছে মেধা ও প্রজ্ঞা তাইতো সকল প্রজ্ঞালাবণ্য ছাপিয়ে তিন কন্যাকে মানুষ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তারা প্রত্যেকেই উচ্চপদস্থ সরকারী চাকরিজীবী। তিনটি সন্তান, তিনজনই মেয়ে আর মেয়ে বলে কথা, তিনজনই রত্ন। সংসারে নাকি পুত্র সন্তান আশীর্বাদ! আজ আর এই কথার ভিত্তি নেই। নারী-পুরুষের সমতা, সক্ষমতা, যোগ্যতা এখন সমানে সমান। সংসারে নারী পুরুষের থেকে বেশি কাজ করে, বেশি দায়িত্ব পালন করে এবং সমানতালে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর সবকিছু সামলে মর্যাদার সঙ্গে চাকরি করে দেশের অর্থনীতিতে, সমাজে ও সংসারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে চলেছেন। আজ আর কন্যা সন্তান সংসারে বোঝা বা অভিশাপ নয়, বরং আশীর্বাদ। তিন কন্যার পিতা মোসাদ্দেক হোসেন হেলাল প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ। তিনকন্যার ওজস্বি পিতার কণ্ঠে এক স্বর, পুত্র সন্তান নেই বলে কোন আক্ষেপ নেই তার। বরং এই বেশি মর্যাদার ও সম্মানের যে, আমার তিনটি সন্তানই কন্যা এবং তারা ও তাদের স্বামীরাও দেশে সর্বোচ্চ চাকরি করে। পিতা-মাতা হিসেবে আমাদের গর্বের পাশাপাশি আখেরাতে জান্নাতের দরজা হয়তো খুলেও যেতে পারে। বর্তমানে এই রত্নগর্ভা মা কুষ্টিয়ার কুমারখালীর দুর্গাপুরে বাড়ি করে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন।
×