ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বই ॥ প্রবাসে নাড়ির টান

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯

বই ॥ প্রবাসে নাড়ির টান

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কবি মাহমুদা দেওয়ান মনে প্রাণে একজন বাঙালী। সেখানে নাগরিকত্ব তাঁর দীর্ঘদিনের। তাঁর শৈশব, কৈশোরের জন্মভূমি বাংলাদেশের টান হৃদয়ে ক্ষরণের সৃষ্টি করে বলেই তিনি বাংলায় কাব্যচর্চা করে যাচ্ছেন আর তারই ফলস্বরূপ প্রকাশিত হলো ‘শিকড়ের বন্ধন’। শিকড় এখানে তাঁর জন্মের মাটি বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাস করা প্রবাসীরা বাংলাদেশের জন্মমুহূর্তে মহান মুক্তিযুদ্ধে সাংগঠনিক পর্যায়ে বিপুল অবদান রাখেন এবং এখনো তাঁরা দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ ও গতিশীল রাখতে তাঁদের পাঠানো রেমিটেন্স বিপুল অবদান রাখছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে উত্তরণ পর্যায়ে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদাজনক অবস্থান-প্রত্যাশী কবি মাহমুদা দেওয়ানের চৌত্রিশটি কবিতা নিয়ে এই ‘শিকড়ের বন্ধন’। এ বইয়ের প্রতিপাদ্য প্রিয় বাংলাদেশের প্রতি হৃদয়নিংড়ানো ভালবাসা। কবিতাগুলো দুই পর্বে ভাগ করা। প্রথম পর্বে মা, জন্মভূমি, স্বদেশ। দ্বিতীয় পর্বে আল্লাহ, বিবেক ও প্রাসঙ্গিক কবিতামালা। অত্যন্ত সরলভাবে লেখা কবিতায় এক ধরনের ¯িœগ্ধতা কাব্যময়তাকে ধরে রেখেছে। যেমন, ‘আজ তাই তুমি সে অনুভব করতে পারো/ মাতৃত্বের দাবিটা যে কী! এতো কাছে ছিলে সেদিন, তবুও তোমায় বলা হয়নি/ মাগো তোমায় ভালোবাসি।’ (মা গো তুমি কই : পৃ-১০) মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কবির গভীর শ্রদ্ধা ও একাত্মতা আমাদের গরীয়ান করে তোলে। সমাজের কিছু লোক যখন জাতির বীরাঙ্গনাদের মূল্যায়ন করে না, তখন কবির প্রাণ কেঁদে ওঠে, ‘ঘূণে ধরা সমাজ নাকি বীরাঙ্গনাকে ধর্ষিতা নয়, পতিতা বলে/ ওই নির্বোধদেরকে বলতে হবে,/ এরা বাংলার মা-বীরাঙ্গনা মা, এরা জাতির মা,/ তারপরও যদি নির্বোধদের বিবেকের দরজা খুলে।’ (জাতির মা বীরাঙ্গনা : পৃ-১২) গণতন্ত্র, সাম্য ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য যে বাংলাদেশকে আমরা মুক্ত করেছিলাম সে বাংলাদেশে ক্রমেই মানবতার অধঃপতন কবিকে নিত্য পীড়িত করে তোলে, ‘হৈ হৈ রৈ রৈ চারদিকে কলরব/ ষোলোই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আয়োজন সব।/ কত কথা, জল্পনা, আবেগ উল্লাসে ভাসে।/ ক্ষণিকের দেশপ্রেম বিজয়ের মাসে।/ ... অযোগ্য আর লোভীরা দেশকে নেয় রসাতলে... / জ্ঞান-চোখ খোল আর বিবেককে জাগাও,/ হারানো মেরুদ- খোঁজে না,/ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ গড়ো-/ দাসত্ব নয়, নেতৃত্ব দাও;। (হাসবে লাখো শহীদ/ পৃ : ১৬) এভাবে প্রবাসে দেশের সব খবর কবির কাছে পৌঁছে যায় আর কবির অন্তর বেদনায় নীল হয়ে যায়। ‘আল্লাহ, বিবেক ও প্রাসঙ্গিক’ পর্বে সৃষ্টিকর্তার কথা তুলে ধরেছেন কবি : ‘একবার শুধু বলে দেখো,/ আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট/ পার হতে এই দুটি জাহান/ আসবে যত ঝড় তুফান/ নিমেষে আমার খোদা দেখেন সামাল...। (আল্লাহ আমার আরোগ্যদাতা : পৃ-৩৩) কবি আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থার কথা স্মরণ করে আশা প্রকাশ করেন, তিনিই মানুষের প্রকৃত কল্যাণদাতা, মুক্তিদাতা। ‘বিবেক’ অংশে কবির কবিতায় ‘সত্যের মূল্যবোধ মিথ্যের অন্তরালে,/ সুখের উদ্বোধন দুঃখের তাপে/ জীবনের স্বার্থকতা মরণের অনুরাগে। (বিবেক মনুষ্যত্বের প্রতীক : পৃ-৩৫) ‘মিথ্যার প্রেক্ষিতে সত্য চড়া মূল্য পায়,/ সত্য আলোকিত মিথ্যার প্রতি ঘৃণায়।/ সত্য প্রতিষ্ঠায়/ মিথ্যার অমানবিক চেহারা উদাহরণ হবে,/ মিথ্যা শুধু ঘৃণাই কুড়ায়।’ (কার গুণে কে চলে : পৃ-৪২) বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবির মা-বাবা, নানভাই, ভাই-বোন, সন্তান ও সন্তানতুল্য এবং নাতি-নাতনিকে। একজন কবি, একজন সাহিত্যিকের দায়িত্ব সমাজকে সঠিক পথে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত দেয়া এবং মানুষকে মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতে ও উন্নীত হতে সহায়তা করা। সে দায়িত্ব নিউইয়র্ক সাহিত্য একাডেমির সদস্য কবি মাহমুদা দেওয়ান সুন্দরভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন তাঁর ‘শিকড়ের বন্ধন’ কাব্যগ্রন্থে। বাংলাদেশের জাতীয় বিভিন্ন চিত্রশোভিত কবির স্ব-পরিকল্পিত আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ ভেতরের কাব্যমালঞ্চের ইঙ্গিতবহ। ঐতিহ্যবাহী কালান্তর প্রকাশনীর প্রবাসী কবির গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। মুদ্রণ এবং বাঁধাই পারিপাট্যে আগামী প্রিন্টিং এ্যান্ড পাবলিশিং কোং-এর কাজটি একটি শোভন প্রয়াস বলা যায়। কবি মাহমুদা দেওয়ানের ‘শিকড়ের বন্ধন’ কাব্যের বহুল প্রচার আমাদের স্বকীয় জাতীয় চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ ও বিশ্বে মর্যাদাজনক উত্তরণ উদ্বুদ্ধ করবে নিঃসন্দেহে।
×