ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

কি যেন হারিয়ে এলাম ॥ মাকিদ হায়দার ॥ আত্মজৈবনিক

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯

কি যেন হারিয়ে এলাম ॥ মাকিদ হায়দার ॥ আত্মজৈবনিক

(পূর্ব প্রকাশের পর মাঝে মাঝে শাজাহান ভাই নিজেই সাইকেল চালিয়ে যেতেন বিশেষ প্রয়োজনে, আর আমার মেজ চাচার ছেলে বাদশা ভাই আমাকে সাইকেলের রডের ওপর বসিয়ে নিয়ে যেতেন ওই পুষ্পপাড়া, জালালপুর আর আতাইকুলার দিকে। বাদশা ভাই গুলতি দিয়ে প্রচুর ঘুঘু, কানা বক শিকার করত অবলীলায় আর সেই ঘুঘু, আর কানাবককে কুড়িয়ে নিয়ে আনার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। একবার বক তো ঠোকর দিয়ে আমার ডান চোখটাকে প্রায় কানা করে দিতে লেগেছিল। বেঁচে গিয়েছিলাম অল্পের জন্য। শাজাহান জায়গির থাকতেন আমাদের জিলাপাড়ার বাড়িতে, আর খুব সম্ভব তিনি চাকরি করতেন পোস্ট অফিসের টরেটক্কায় এবং এক সঙ্গে তিনি খুব ভাল ফুটবল খেলতেন পাবনা স্পোর্টিং ক্লাবে, সেই দলে বোধ করি আমার অগ্রজ জিয়া ভাইও খেলতেন এবং একই সঙ্গে ফুফাত ভাই চুনু ভাই ও নান্নু ভাইও খেলতেন। সময়টা বোধ করি মধ্য পঞ্চাশের কিছু আগে অথবা পরে, আর সেই মধ্য পঞ্চাশের আগে-পরেই আমাদের জিলা স্কুলের কসিমউদ্দিন মৌলানা আমাকে এবং চুনু ভাই, নান্নু ভাইদের আরেক ভাই বাচ্চুকেও পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি করিয়ে নিয়েছিলেন, প্রিয় কসিমুদ্দিন স্যার। আমাদের জিলাপাড়ার বাড়ির দক্ষিণ দিকে এখনও আছে পাবনা পলিটেকনিক স্কুলের ছাত্রদের ছাত্রাবাস, সেই ছাত্রাবাসের অনেক ছেলেকে দেখতাম শাজাহান ভাই, বাদশা ভাই এবং জিয়া ভাইয়ের সঙ্গে গল্প-গুজব করতে, গল্প-গুজবের বিষয়বস্তু কি যে ছিল জানিনে, তবে একদিন শুনলাম, যে পাবনা শহরের বাণী সিনেমা হলে দিলীপ কুমার এবং মীনা কুমারী অভিনীত কিনাকি একটা দুর্দান্ত টকি এসেছে, সেই টকিতে নাকি দিলীপ কুমার আর মিনা কুমারী তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করেছেন। শাজাহান ভাইদের সেই আড্ডার কথাটি আমার কানের ভেতরে, প্রাণের ভেতরে এমনভাবে আটকে গেল যে, তখনই আমার মনে হলো, টকি আর অভিনয় জিনিসটাকে স্বচক্ষে যদি একবার দেখতে পারতাম, আমি তখনও জানতাম সিনেমা দেখতে গেলে টাকা বা পয়সার প্রয়োজন হতো টিকেট কেটে সিনেমা দেখতে হয় কিন্তু আমার পুঁজি মাত্র ২ আনা পয়সা। একদিন সন্ধ্যার বেশ কিছু পরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বাণী হলের মেয়েদের গেটের নিচ তলার দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা কিছুটা এগিয়ে দিয়ে সেই দিলীপ কুমার আর মীনা কুমারী নাকি মদুবালার টকি মাত্র তিন তিনেক চারেক দেখার ফাঁকেই এক বেঁটে খাটো গেটম্যান বা টর্চ লাইটধারী আমাকে একটু আগেই চড়-থাপ্পর দিয়েছিলেন, তাকে উর্দু-বাংলায় মিশ্রিত শব্দে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেনÑ ব্যাপার কি? সেই বেঁটে খাটো যা বললেন, তার সরল অর্থ, এই ছেলেটি দরজা দিয়ে সিনেমা দেখছিল, তাই দু-একটা চড়-থাপ্পড় দিলাম, বুঝলেন বাবু ভাই। কোঁকড়ানো চুলওয়ালা এবং বিশালদেহী লোকটির কেন যেন আমার প্রতি দয়া হলো, তিনি ওই বেঁটে-খাটোকে ধমকের সুরে কি যেন তার উর্দু বাংলা মিশ্রিত ভাষায় বললেন, ধমক খেয়ে বেঁটে খাটো ঢুকে পড়লেন সিনেমা হলের ভেতরে আর সেই কোঁকড়ানো চুলওয়ালা ভদ্রলোক আমাকে কাছে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করলেন, থাকি কোন পাড়ায় সেটাও জেনে নিলেন এবং একই সঙ্গে জেনে নিলেন আমার বাবার নাম, কোন্ ক্লাসে পড়ি, সব কিছু জেনে নিয়ে তাঁর পকেট থেকে নগদ ১ আনা পয়সা হাতে দিয়ে বললেন, সোজা বাড়িতে চলে যাও। বেঁটে খাটো চুল এবং কান ধরে যে ঝাঁকুনিটা একটু আগে দিয়েছিল, দিয়েছিল চড়-থাপ্পড়, সবকিছুই মুহূর্তের ভেতরে ভুলে গেলাম নগদ ১ আনা প্রাপ্তিতে। বাণী হলের পূর্ব দিকে খোলা জায়গায় চিনে বাদাম আর লোকোনদানা দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না, হঠাৎ পাওয়া ১ আনায় চিনে বাদাম আর লোকোনদানা কিনে নিয়ে খেতে খেতে আমি আমাদের জিলা স্কুলের প্রায় কাছাকাছি যখন এসেছি, ঠিক তখনই ঘটল এক মহাবিপদ, দেখি সাইকেল চালিয়ে যেন আমার দিকে আসছেন, আমাদের সেই হেড মৌলানা কসিমুদ্দিন স্যার, সমূহ বিপদ দেখে আস্তে করে বসে পড়লাম স্কুলের পশ্চিম কোনায় জেলখানার দেয়ালের পাশে। ভাগ্যিস সেদিন হেড মৌলানা স্যার আমাকে দেখেননি, দেখলে চিনে বাদাম লোকোনদানা খাওয়া এবং একই সঙ্গে কানডলা খাওয়া যা কিছু পূর্বেই খেয়ে এসেছিলাম, হয়তবা তারই পুনরাবৃত্তি ঘটত কানডলা খাবার মধ্য দিয়ে। সেই ছোট ছিমছাম পাবনা শহরে তখনকার দিনে কত লোকই বা বসবাস করতেন, আর কত জনই স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করতেন সে সংখ্যা আমাদের মতো স্কুল পড়ুয়াদের জানার কথা নয়, শুধু জানার কথা ছিল, হেড মৌলানা যেন, তার কোন ছাত্রকেই সন্ধ্যার পরে বাণী সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে না দেখেন অথবা রূপকথা সিনেমা হলে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড় বড় ব্যানার, এমনকি সন্ধ্যায় ছবি শুরু হওয়ার আগে বাণী হলের ওপর থেকে মাইকের মুখ পূর্ব দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে হেমন্ত, শ্যামল, সন্ধ্যার ভাল ভাল বাংলা গান যেন, তাঁর জিলা স্কুলের ছাত্ররা না শোনে, সেই দিকেই ছিল মৌলনা কসিমুদ্দিন আহমেদের একান্ত প্রচেষ্টা। বোধহয় তিনি চাইতেন, তার ছাত্ররা ভবিষ্যতে যেন মানুষ হয় তাই তিনি প্রতিদিনই সাইকেল চালিয়ে, বাণী সিনেমা হলের সামনে দিয়ে, আর রূপকথা সিনেমা হল ঘুরে তিনি চলে যেতেন, নতুন ব্রিজের উত্তর দিকের একটি লাইব্রেরিতে, আমার মনে হয় ওই লাইব্রেরিটি ছিল তার প্রিয় স্থান। একবার জিলা স্কুলের মাঠে বয়েজ স্কাউটদের জাম্বুরী জাতীয় কিসের যেন এক বিশাল আয়োজন করা হয়েছিল। আমাদের সেই অনুষ্ঠানে ঢুকতে দেয়া হয়নি, যেহেতু আমরা ক্লাস থ্রি অথবা ফোরের ছাত্র, আমার ফুফাত ভাই বাচ্চুই আমাকে আমাদের বাড়ি থেকে ডেকে স্কুলের দক্ষিণ দিকের গেট পর্যন্ত সবেমাত্র দুজন গিয়েছি, হঠাৎ দেখি হেড মৌলানা স্যার পূর্ব দিকের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলের দিকেই আসছেন, স্যারের বেশ অনেকটা পিছে, বিড়ি ব্যবসায়ী সেকেন্দার মিয়ার ছেলে আমাদের সহপাঠী ফেরদৌসও এগিয়ে আসছে, প্রায় কাছাকাছি এসে ফেরদৌস যা বলল তার সোজা অর্থ, আমরা যেন ওই বয়েজ স্কাউটদের দেখতে না যাই। বাচ্চু একটু এদিক-সেদিক তাকিয়ে ‘জ্যোতি বিড়ি-জ্যোতি বিড়ি’ বার দুয়েক ফেরদৌসকে বলতেই, ফেরদৌস তেড়ে এলো আমাদের মারতে, কিন্তু মারামারি হলো না হঠাৎ হেড মৌলানা স্যার ঘাড়টাকে পূর্বের দিকে ফিরিয়েই, তিনি দূর থেকে এক বিশাল ধমক দেয়ার কারণেই, সমূহ মারামারি থেকে তিন জনই রক্ষা পেলাম, হেড মৌলানা স্যারকে দেখলাম, জিন্নাক্যাপ শেরওয়ানি পাজামা পরিহিত। ফেরদৌসের বাবার যে বিড়ি ফ্যাক্টরি ছিল সেই ফ্যাক্টরির বিড়ির ব্যান্ডলেখা ছিল ‘জ্যোতি বিড়ি’। আমরা ফেরদৌসকে স্কুলে জ্যোতি বিড়ি বলে ক্ষেপাতাম, যার ফলে স্কুলেও মাঝে মধ্যে ছোটখাটো মারামারি হলেও আমার আর বাচ্চুর সঙ্গে ফেরদৌস কোনদিনই পেরে উঠত না। স্কুলের মাঠে গত বছর নাকি তার আগের বছর কি একটা ঘটনা নাকি ঘটেছিল জিলা স্কুলের মাঠে। আজ সেই জিলা স্কুলেই হচ্ছে জাম্বুরী। আমার মন ভীষণ খারাপ যেতে না পারার জন্য। হঠাৎ সকাল বেলা কোথাও যেন আকাশে কালো মেঘ এবং প্রচ- শব্দে বজ্রপাত শুরু হয়ে যাওয়ায়, ঢাকা থেকে জাম্বুরী উপলক্ষে এক ইংরেজ সাহেব নাকি এসেছিলেন জাম্বুরী উদ্বোধন করতে, সেই সকাল নয়টা দশটার দিকেই হঠাৎ বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়ে সেই ইংরেজ সাহেব মারা গেলেন আমাদের জিলা স্কুলের মাঠে। খবরটা আমার মেজ ভাই রশীদ ভাই দৌড়াদৌড়ি করে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। তিনি তখন স্কুলের মাঠের আশপাশেই ছিলেন, সম্ভবত সেটিও সেই মধ্যে পঞ্চাশের আগে-পরের ঘটনা। আবার সেই মধ্যে পঞ্চাশেই আমাদের জিলাপাড়ার বাড়িতেই মারা গেলেন আমার দাদিমা উম্মে কুলসুম। দাদিমা মারা যাবার পর পরই আমার বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, শহরের বাড়িটাকে মাত্র ৪০ টাকা ভাড়া দিয়ে তিনি ফিরে এলেন আমাদের দোহারপাড়া নামক শহরতলির গ্রামে, তখনকার দিনে না ছিল বিদ্যুতের কোন ব্যবস্থা না ছিল টেলিফোন এমনকি একটি রেডিও ছিল না সমস্ত দোহারপাড়া গ্রামে। দোহারপাড়া গ্রামটি শহরের পূর্বদিকে, পাবনা সদর গোরস্তানে অবস্থানটাও তাই, লোকে যাকে আরিফপুর গোরস্তান বলে অবহিত করেন। আদপে এই গোরস্তানটি রাঘবপুর মৌজার ভেতরে, আর এই বিশাল গোরস্তানটির অধিকাংশ জায়গাজমি আমার বাপ- দাদাদের, তারাই গোরস্তানটিকে দান হিসেবে দিয়ে গিয়েছেন এবং একই সঙ্গে গোরস্তানের দক্ষিণ দিকের বিশাল ঈদগাহ মাঠটিও ছিল আমার বাপ-দাদাদের, সেই গোরস্তানের দক্ষিণ দিকের যে গ্রামটি সেই গ্রামটির নাম আরিফপুর। শহরের বাড়িটি ছেড়ে চলে আসায় সব চাইতে বেশি খুশি হয়েছিলাম আমি। ইতোমধ্যে ফুটবল খেলোয়াড় শাজাহান ভাই শহরেই জোগাড় করে নিয়েছিলেন তার শ্বশুরালয়, আর মেজ চাচার ছেলে বাদশা ভাই, পড়লেখা ছেড়ে দিয়ে তিনি আমার মেজ দুলাভাই আবুল মুনছুরের সঙ্গে পাড়ি জমালেন ঢাকা শহরে। জিয়া ভাই রাজশাহী কলেজে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর রশীদ ভাই ম্যাট্রিক ক্লাসের দ্বারপ্রান্তে, তিনি গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র। পুরো দোহারপাড়া গ্রামটিতে মাত্র ১০-১২ ঘর জনবসতি ছিল, অধিকাংশই চাষবাস করেন, মাত্র একজন লোক পাবনা জজকোর্টে পিয়নের চাকরি করতেন, নাম মোফাকখর হোসেন, তবে তিনি দোহারপাড়া আরিফপুরের লোকজনের কাছে পরিচিত ছিলেন টেংরাভাই হিসেবে। এই পুরো দোহারপাড়া গ্রামে শিক্ষার হারটাও সেভাবে বিস্তৃত লাভ না করলেও গ্রামের উত্তর দিকের কবীর দারোগার বাড়ির সুরুজ ভাই বোধকরি এডওয়ার্ড কলেজে পড়তেন, আর আমাদের বাড়ির জিয়া ভাই রাজশাহীতে। আরিফপুরের হয়তবা দু-চারজন, তবে বলরামপুরের দুজন কৃতী ছাত্র ইতোমধ্যে এমএ পাস করে ফেলেছিলেন, একজন ফকরুল ইসলাম, আরেকজন তাঁরই অগ্রজ। আমাদের দোহারপাড়ার চারদিকেই বনজঙ্গল-বাঁশঝাড়। দোগাছি রাস্তার উত্তর-দক্ষিণে ব্রিটিশ আমলের বিশাল পাকুড়গাছ, পাকুড়গাছের মাথায় শুকুনদের আবাসস্থল, মাঝরাতে সেই শকুনদের বাচ্চারা যখন ডাকাডাকি করত, শুনলে মনে হতো কোন বাচ্চা শিশু, সেই পাকুড়গাছের মাথার উপর থেকে কাঁদছে। আর সন্ধ্যায় এবং শেষ রাতে ভীষণ জোরে কাঁদত বা ডাকত আরিফপুর গোরস্তানের মানুষখেকো বিশাল বিশাল দেহের অধিকারী শিয়ালগুলো। ডাক শুনলেই ভয় হতো বিশেষত যখনই আমাদের বিশাল পুকুরের পূর্ব দিকের বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে ডাক দিত, তখন আমার মনে হতো, শিয়ালগুলো নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র করছে কিভাবে আমাদের পোষা লাল মোরগ কাজলীকে, আর রীনাবুর পোষা ছাগলের ৩টি বাচ্চাকে কিভাবে খাবে তারই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ওই সব মানুষখেকো শিয়ালের দল। পড়ালেখা শিকেয় উঠল, পেছনে যেহেতু হেড মৌলানা স্যার নেই, সেই সঙ্গে নেই সময়মতো স্কুলে যাওয়া, যার ফলে ক্লাস ফোরেই নাম কাটা গেল জিলা স্কুলের খাতা থেকে। তখন আমি দোহারপাড়ার ছেলেদের নেতা। কাঁচের গুলি, মাছ ধরা, ঘুঘু ধরা, কবুতর পোষা, মুরগি, ছাগল, এমনকি গাইগরুও আমার দখলে চলে এলো এবং একই সঙ্গে, শীতসকালে উঠে বিভিন্ন খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে সেগুলো জ্বালিয়ে পাটালিগুড় বানিয়ে খাবার কি আনন্দ, সে আনন্দের ভাগ কাউকে কোন দিনই দেয়া সম্ভব নয় বলেই আমার ছোটকালে খুব ইচ্ছে হতো আমি বড় হলে, পাড়ার তাহের গাছির মতো পাটালিগুড় বানিয়ে পাঁচসিকে, দেড় টাকা সেরে বিক্রি করব, আর পড়ালেখা করেই বা কি হবে, যেহেতু আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি বড় হলে গাছি হব। যেমন, রবীন্দ্রনাথ হতে চেয়েছিলেন নোয়াখালীর মাঝি। আমাদের দোহারপাড়ার দক্ষিণ দিকের গ্রামটির নাম ইতোপূর্বে বলেছি, আরিফপুর। সেই আরিফপুর আর দোহারপাড়ার মাঝখানে দিয়ে যে রাস্তা দোগাছি হয়ে সুজানগর হয়ে যমুনা নদীর তীরবর্তী সাগরকান্দি নামক গ্রামে গিয়েই শেষ হয়েছে। শের শাহের আামলে নির্মিত এই রাস্তাটি, কথিত আছে এই রাস্তা দিয়েই পালিয়ে এসেছিলেন সম্রাট শাজাহানের পুত্র শাহসুজা। পরবর্তীতে শাহ সুজার নামানুসারে সুজানগর গ্রামের নামকরণ করা হয়। এ সবই আমার শোনা গল্প, এই গল্পটি আমি শুনেছিলাম আমার আরেক চাচার ছেলে মোতালেব হোসেন ফনি ভাইয়ের নিকট থেকে, ফনি ভাই পাবনা গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে পড়তেন ক্লাস সিক্স অথবা সেভেনে। তিনি আম-কাঁঠালের দিনের মর্নিং স্কুল শেষ করে এসেই ওই দোগাছি রাস্তার দক্ষিণ দিকের আমাদের শরিকানা ফজলী বাগানের কাঁচা ফজলি আম, বেশ অনেকগুলো নিজেই গাছ থেকে পেড়ে সকাল ১০-১১টার দিকে, লবণ-সর্ষের তেল দিয়ে সুন্দর করে কলার সবুজ পাতার ওপর মাখিয়ে আমাদের খেতে দিয়ে, প্রায়ই বলতেন, মর্নিং স্কুলের গল্প এবং শাহ সুজা কেমন করে তার দলবল নিয়ে শের শাহের তৈরি এবং রাস্তা দিয়ে গিয়ে উঠেছিলেন সুজানগরে। মোতালেব হোসেন ফনি ভাই, স্কুলের ইতিহাস স্যারের কাছে যেভাবে শুনতেন তিনি ঠিক ঠিক সেভাবেই আমার কাছে, হামিদ এবং কায়েস ও মিরাজের নিকট ওই একই ভঙ্গিতে বলে যেতেন, আমার মনে হতো, ফনি ভাই বোধকরি নিজ চোখে শাহ সুজাকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন। এসব গল্প প্রায়শই আমাদের শরিকানা সেই বিশাল ফজলিী বাগানের ভেতরে বসে বসেই হতো। ঠিক এমনি চৈত্র-বোশেখ মাসের কোন একদিন ঠিক হলো আমাকে জিসিআই স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য আব্বা, রশীদ ভাইকে নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু আমি তো হব পাটালিগুড় বিক্রেতা, আমার পাড়ার তাহের গাছি। ফনি ভাই প্রায়ই এসে তাঁদের জিসিআই স্কুলের গল্প করেন, অঙ্কের স্যার রমেশ বাবু আজকে তাদের ক্লাসের এক ছেলেকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন বেঞ্চের ওপর, ভূগোল স্যার মহেন্দ্রনাথ অধিকারী, মোজাহার স্যার, রহমান স্যার এমনকি স্কুলের মাঠের পূর্বদিকের পানির কলের পাশে জামরুল গাছের নিচে সাধুপাড়ার কালো কুচকুচে শাজাহানের যে চিনেবাদাম, লোকোনদানা, চুরমুর খাস্তা এবং তেলে ভাজার যে বর্ণনা মাঝে মাঝে দিতেন, শুনেই মনে হতো, জিলা স্কুলের চেয়ে তাহলে ওই জিসিআই স্কুলটিই ভাল। ফনি ভাইয়ের কথার জাদুতে এবং আমার বাবার হুকুমেই রশীদ ভাই সেই গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে জিসিআইতে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করালেন পাঁচের দশকের একদম শেষ দিকে। (চলবে)
×