ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শিউলী আহমেদ

উৎসবের সাকরাইন

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯

উৎসবের সাকরাইন

বাঙালী উৎসব প্রিয়। ১২ মাসে তার ১৩ পার্বণ। এখানে শুধু নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব বা নিজস্ব গোত্রীয় উৎসবই নয়, বর্তমান সময়ে প্রায় সব উৎসবই সবাই পালন করে। তাই সারা বছরই কোন না কোন উৎসব এখানে লেগেই থাকে। তারই একটি ‘সাকরাইন’ -যা আমাদের দেশে এতদিন শুধুই পুরান ঢাকার নিজস্ব উৎসব ছিল। ঢাকায় জন্ম, ঢাকায় বেড়ে ওঠা। কিন্তু এতদিন এইদিকে এভাবে শুনিনি এই উৎসবের কথা। কয়েক বছর যাবত দেখছি এই আধুনিক ঢাকাতেও এর ছোঁয়া লেগেছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর প্রচার খুব ঘটা করে হওয়ায় মনে হয় এর প্রচার অনেক বেড়েছে। আরও কয়েক বছরের মধ্যে হয়ত এটা বর্ষ বরণ বা ফাল্গুনের মতো ব্যাপক আকার ধারণ করবে। পুরান ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তি ‘সাকরাইন’ নামে পরিচিতি। এদিন এখানে পালিত হয় ঘুড়ি উৎসব নামে অতি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। কথিত আছে, ১৭৪০ সালে নবাব নাজিম মুহম্মদ খাঁ এই ঘুড়ি উৎসবের সূচনা করেন। সেই থেকে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এই ঘুড়ি উৎসব পশ্চিম ভারতের গুজরাটেও পালিত হয়। সেখানে মানুষ সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে সূর্যদেবতার কাছে নিজেদের ইচ্ছে ও আকুতি প্রেরণ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় এই দিবস বা ক্ষণকে ঘিরে উদযাপিত হয় উৎসব। নেপালে এই দিবসটি মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রাণ, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রাণ নামে উদযাপিত হয়। দেশভেদে এর নামের মতোই উৎসবেরও ধরনে পার্থক্য থাকে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, দয়াগঞ্জ, গে-ারিয়া, বাংলাবাজার, ধূপখোলা মাঠ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সদর ঘাট, কোর্ট-কাছারিসহ পুরো এলাকার মানুষই পালন করে সাকরাইন। দিনভর ঘুড়ি উড়ানো, ভাল খাবার রান্না, প্রতিবেশীদের মধ্যে খাবার বিতরণ, ঘুরে বেড়ানো। আর নাচ-গান তো আছেই। বিকেল হলে আকাশ ভরে যায় রং-বেরঙের ঘুড়ির মেলায়। পুরান ঢাকার সব বাড়ির ছাদে ছাদে ভরে যায় ছেলে-বুড়ো থেকে নিয়ে ছোট ছেলেমেয়েরা। শুরু হয় ঘুড়ি উৎসব। কাটাকাটি হচ্ছে ঘুড়ি উৎসবের একটা অন্যতম মজার বিষয়। কার ঘুড়ি কে কাটতে পারে। এ নিয়ে কোন মন খারাপ নেই। আর একটি দুটি নয়, হাজার হাজার ঘুড়ি। এ যেন আকাশ ছোঁয়ার উৎসব! কয়েকদিন আগে থেকে চলে সুতায় মাঞ্জা দেয়ার পালা। এই মাঞ্জা দেয়াটা আমার একটু একটু মনে আছে। ছোটবেলায় আমার ভাইদের দেখতাম। কোথা থেকে নষ্ট বাল্ব যোগাড় করত। ওটা পাটায় পিষে চুর করা হতো, কি কি দিয়ে যেন জ্বাল করে একটা আঠা তৈরি হতো। সুতা ওখানে ডুবিয়ে, সিরিষ কাগজে ওই চুর নিয়ে সুতায় লাগিয়ে, সুতা গাছের সঙ্গে পেঁচিয়ে রোদে শুকিয়ে কত কায়দা করে যে এই মাঞ্জা দেয়া হতো! সারাদিন যেত মাঞ্জার পেছনে। নাওয়া-খাওয়াও বাদ হয়ে যেত। সন্ধ্যার পর শুরু হয় আরেক বর্ণিল উৎসব! আকাশ ভরে যায় আতশবাজিতে। সঙ্গে থাকে পটকা, ফানুস, বিভিন্ন রকমের লাইটিং। আর নানা ধরনের গানবাজনা তো আছেই। ছাদে ছাদে যেন আনন্দের বন্যা বইতে থাকে। এই সময় আরও একটা খেলা খেলে পুরান ঢাকার ছেলেমেয়েরা। মুখে কেরোসিন নিয়ে আগুনে ফুঁ দিয়ে আগুনের ফুলকি উড়িয়ে দেয়। যদিও এর মাধ্যমে এখনও কোন দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি, তবু খেলাটা খুব বিপজ্জনক লাগে আমার কাছে। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী, ‘সংক্রান্তি’ একটি সংস্কৃত শব্দ। এ দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালী সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। ভারতের বীরভূমের কেন্দুলী গ্রামে এই দিনটিকে ঘিরে ঐতিহ্যময় জয়দেব মেলা হয়। বাউলগান এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ। শহুরে এই যান্ত্রিক জীবন ছোট এই উৎসবগুলো যেন বাঙালীকে প্রাণ সঞ্চার করে।
×