ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গল্প ॥ তিমির তরঙ্গ

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯

গল্প ॥ তিমির তরঙ্গ

দু’টি গল্প ইউনিভার্সিটির সর্বত্র চরম অবস্থা বিরাজ করছে। সমস্ত ছাত্র সমাজ আজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বেশির ভাগ ছাত্রই বাঙালীর স্বাধিকার প্রশ্নে সোচ্চার। স্বাধীনতা নিয়ে তারা আপোসহীন মনোভাব পোষণ করে। ভারত বিভাগের পর যে স্বাধীনতা এসেছে তা যে বাঙালীর প্রকৃত স্বাধীনতা নয় তা তারা বেশ ভাল করে উপলব্ধি করছে। আসলে স্বাধীন জাতি যদি অন্যের মুখাপেক্ষি হয় তাহলে তাকে আর স্বাধীন বলা যায় না। বাঙালীদের অবস্থাও হয়েছে তাই। তারা যে স্বাধীনতা পেয়েছে সে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে। আজ পশ্চিম পাকিস্তানীরা এদেশের অনাহুত অভিভাবক সেজে বসেছে। পরাধীনতার গ্লানি আছে সত্য, কিন্তু স্বাধীনতার নামে যে অপমান-অবমাননা, শোষণ-নিপীড়ন তা আরও অধিক গ্লানিকর। বাঙালী মুসলমানদের হেয় করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে অপকৌশলগুলো ব্যবহার করেছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর। পশ্চিমের সুবিধাভোগী দল বাঙালীদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগতভাবে অস্পৃশ্য করার যে কুপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তার নজির ইতিহাসে বিরল। যে বাঙালীর দ্বারাই পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল পাকিস্তান লাভের পর এখন তাকেই বলা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক। তাকে উপস্থাপন করা হচ্ছে সকলের ঘৃণার পাত্র ও উপহাসভরে। আক্রমণটা প্রথমে এসেছিল ভাষার ওপর। অজুহাত ছিল জাতীয় ঐক্য। তাদের মতে বাংলা পরিত্যাগ করে উর্দু শিখলে পাকিস্তানের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত এবং সুসংগঠিত হবে। বাঙালীরা যখন রুখে দাঁড়াল তখন তারা সুর পাল্টাল। পরবর্তী আক্রমণ আসল বাংলা সাহিত্যের উপর। বাংলা হিন্দুদের ভাষা। কাজেই তা পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। বাংলা-উর্দু জগাখিচুড়ি তৈরি করা লেখক গোষ্ঠীও পাওয়া গেল। পাকিস্তানীরা বলল বাংলা সাহিত্যে যে সংস্কৃতির লালন করা হয়েছে তা কোনভাবেই অখ- বাংলার সংস্কৃতি হতে পারে না। সে সংস্কৃতির সূতিকাগার হচ্ছে কলকাতা এবং তার ধারক-বাহক বাংলার মুসলমান নয় বরং হিন্দুরা। তাই সেই সংস্কৃতিও মুসলমানদের গ্রহণ করা উচিত নয়। এর জবাবে মুসলমানরা বলল, সাহিত্যের ক্ষেত্রে হিন্দুরা অগ্রণী ভূমিকা রাখার কারণেই তাদের সংস্কৃতি সেখানে বিকাশিত হয়েছে কিন্তু সেই সাহিত্যে বাংলার আলো-বাতাস ও মাটির সেঁাঁদা গন্ধ এবং চিরায়ত জীবনের মৌলিক উপজীব্য পাওয়ায় মুসলমানরা সে সকল সাহিত্যিকগণকে নিজেদের লোক বলে এবং সেই সাহিত্যকে তারা নিজেদের সম্পত্তি বলে গ্রহণ করেছে। তাই তারা পাকিস্তানকে সন্তুষ্ট করতে পূর্ব পাকিস্তানের শরৎচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ হতে চায় না। কেননা সাহিত্যিক তৈরি হয় না, সাহিত্যিক জন্ম নেয়। এর মাঝে বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়েই একজন সামরিক অফিসার বাঙালীদের আদিম অধিবাসী বলে ব্যঙ্গ করল এবং শিক্ষা-দীক্ষা-শক্তিতে পশ্চিমাদের তুলনায় খর্ব বলে ঠাট্টা করতে ছাড়ল না। সেদিন বিকেলে শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে বসে শাহীনরা এসব নিয়েই আলোচনা করছিল। তার সহপাঠী রশিদ, সেলিম এবং অন্যান্যরাও চায়ের কাপ খালি করে বসে আছে। হঠাৎ সেলিম বলে উঠল, যাই বলিস শাহীন, আমার ধারণা এই নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবেই। শাহীন স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ক্ষমতা হস্তান্তর করলে ভাল। তবে করবে কিনা সেটাই চিন্তার বিষয়। আমার কি মনে হয় জানিস, ওদের একটা নীল নকশা আগে থেকেই করা রয়েছে। যখন একজন ক্ষমতা ছাড়বে, তার জয়গায় ওদেরই আরেকজন আসবে। ওরা বাঙালীদের কখনো শাসন ক্ষমতা দেবে না। ওদের কথাবার্তায় আমি এটুকু অন্তত নিশ্চিত যে ওরা কখনও এদেশের মানুষকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তানের ফল-ফসল নিয়ে পশ্চিমারা সমৃদ্ধ হবে অথচ এখানকার শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে তাদের কোন পদক্ষেপই নাই। পুনরায় চায়ের ফরমায়েশ দিয়ে শাহীন বলতে লাগলো দুর্বৃত্তরা আসলে কখনও ধর্মের কথা শোনে না। আমরা এতদিন যাদের মুসলমান বলে বিশ্বাস করেছি এবং ভাল বেসেছি তারা আসলে দুর্বৃত্ত। তারা বোঝে শুধু একটা জিনিস-ক্ষমতা। রশিদ বলল, কিন্তু শাহীন ওদের সঙ্গে যে যুদ্ধ করবি, তার অস্ত্র-শস্ত্র কোথায় পাবি? সংগ্রাম শুরু হলেই দেখবি অস্ত্র কোথা থেকে চলে এসেছে। বিপুল শক্তি আমেরিকার বিরুদ্ধে সামান্য ভিয়েতনাম কোথা থেকে অস্ত্র পাচ্ছে? আলজেরিয়াবাসীদের কে অস্ত্র দিয়েছিল? এমন সময় রাবেয়া এসে ক্যান্টিনে ঢুকল। রাবেয়া সম্পর্কে শাহীনের খালাত বোন। ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। শাহীনের মাস্টার্সটা শেষ হলেই বিয়ের দিনক্ষণ পাকা করা হবে। শাহীন বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাবেয়াকে নিয়ে বের হলো। হাঁটতে হাঁটতে রাবেয়া বলল বাবা আজ তোমার কথা জিজ্ঞেস করল। অনেকদিন বাসায় আস না। এলিফ্যান্ট রোডের আজিজ মোটরসের পেছনে পুরনো একটা বাড়িতে রাবেয়ারা থাকে। বাদাম খেতে খেতে রাবেয়া বলল, তোমার রাজনীতি করা আম্মার একদম অপছন্দ। মা বলে রাজনীতিবিদরা কখনও অবসর পান না। শাহীন হো হো করে হেসে উঠে বলল, তোমার মাকে বলবে রাজনীতিবিদদের অবসর কাটে মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ভেবে। এর মাঝেই তারা মজা খুঁজে পায়। তাছাড়া দেশের অবস্থা সবসময় এক রকম থাকবে না। ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর একটা বিহিত হয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। সকলেরই ধারণা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে শেখ মুজিবই উইন করবেন। এখন পশ্চিমারা সেটা মেনে নেবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে রাবেয়াকে রিক্সায় তুলে দিয়ে হলের পথ ধরল শাহীন। জহুরুল হক হলে থাকে ও। তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। আজ ৫ মার্চ। দেশের পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে গেছে। শাহীনের আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হলো। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নির্বাচিতরা এখনও ক্ষমতা বুঝে পায়নি। এর মাঝে অনেক কিছু ঘটে গেছে। ২ মার্চ কলা ভবনের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার শপথ নেয়া হয়। সেদিন ডাকসু নেতাদের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে শাহীনও অংশ নিয়েছিল। ওরা এখন রেসকোর্স ময়দানের জনসভা সাফল্যম-িত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাই বলাবলি করছে শেখ মুজিব পরশুদিনের জনসভায় গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘোষণা দেবেন। ৭ মার্চ বিকেলের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ১৮ মিনিটের এক তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রাখলেন। তিনি ভাষণে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তাতে পাকিস্তানীরা নির্ঘাত তার পেছনে উঠে পড়ে লাগবে। ২৫ মার্চ, সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার গাঢ় হতে শুরু করেছে। জগন্নাথ হলে শাহীনদের একটা গোপন মিটিং ছিল। সবাই চলে যাওয়ার পর রাত দশটার দিকে শাহীন বের হলো। জগন্নাথ হলে ওদের গ্রামের একটা ছেলে থাকে। শাহীনের আব্বা তার কাছে চিঠি ও কিছু টাকা পাঠিয়েছিলেন। তা নিয়ে শাহীন হলের পথে পা বাড়াতেই রাস্তায় কয়েকটা দানবরুপী মিলিটারি ট্রাক দেখতে পেল। ব্যাপার কি দেখার জন্য শাহীন পাশের গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিল। হঠাৎ বিদ্যুত চলে গেলে পুরো এলাকাটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। তারপর যা দেখলো শাহীন তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। হলের সামনে ট্রাক থামিয়ে সেনারা ভেতরে ঢুকে গেল। ঢুকেই যাকে সামনে পেল এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করল। শাহীন নিজের চোখ এবং কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। হলের ছাত্রদের আর্তচিৎকারে তার কান-মাথা ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। স্টেনগানের ভয়ঙ্কর শব্দ ছাপিয়ে উঠছিল ভয়ার্ত ছাত্রদের চিৎকার চেঁচামেচিতে। হাত পা অবশ হয়ে আসছিল শাহীনের। থপ করে মাটিতে বসে পড়ল সে। একটু পর কি ভেবে শাহীন উঠে হাঁটতে থাকে ঝোপঝাড়ের তীর ঘেষে। রাস্তা দিয়ে হেডলাইটের বড় ট্রাকগুলো ইতস্তত ছুটাছুটি করছিল। চারদিকের চিৎকার-চেঁচামেচি বেড়েই চলেছে। রোকেয়া হলের পেছনের ডোবা পার হওয়ার সময় ছাত্রীদের গগনবিদারি চিৎকারে শাহীনের গায়ের লোম শিউরে উঠে। চোখে যেন শর্ষেফুল দেখতে পাচ্ছে শাহীন। কি হচ্ছে এসব! কোন রকমে নিজেকে ধাতস্থ করে হলে যাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করে রাবেয়াদের বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা করল শাহীন। ওদের কি অবস্থা কে জানে! তবে এলিফ্যান্ট রোড পর্যন্ত যাওয়া যে মোটেও সহজ হবে না তা শাহীন বুঝতে পারছে। শাহীন এ গাছের আড়ালে ও দেয়ালের ওপরে করে মিলিটারিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যখন রাবেয়াদের বাড়ির কাছে পৌঁছল তখন রাত প্রায় বারোটা। এ পর্যন্ত আসতে রাস্তা-ঘাটে অসংখ্য বিভীষিকাময় দৃশ্যের সাক্ষী হতে হয়েছে শাহীনকে। নিহতদের রক্তে সয়লাব প্রত্যেক বাড়ির খোলা গেট। কোন বাড়ি থেকে থেমে থেমে ভেসে আসছিল আহতদের আর্তনাদ। রাবেয়াদের বাড়িতে ঢুকতেই স্তব্ধ হয়ে গেল শাহীন। চৌকাঠের উপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে আছে রাবেয়ার বাবা-মায়ের লাশ। রাবেয়া! অস্ফুট চিৎকার করে শাহীন ভেতরে প্রবেশ করল। ঘরের ভেতরের দৃশ্য দেখে শাহীনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। গুলিবিদ্ধ রাবেয়ারা তিন ভাইবোন জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। মেঝেতে শক্ত হয়ে আছে তাদের রক্ত। মাথা নিচু করে বোবা কন্নায় ভেঙ্গে পড়লো শাহীন। হঠাৎ তার মনে হলো যেন রাবেয়ার হাত নড়ে উঠল। দ্রুত কাছে গিয়ে হাত কোলে তুলে নিল শাহীন। মুমূর্ষু কণ্ঠে রাবেয়া পানি চেয়ে তাকাল তার দিকে। শাহীন অন্ধকার হাতড়ে টিউবওয়েল থেকে পানি এনে রাবেয়ার মুখে ধরল। রাবেয়া তোমাকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব। কিচ্ছু হবে না তোমার। নিজেকেই সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করল শাহীন। রাবেয়া একবার শুধু শাহীন বলেই চোখ বন্ধ করল চিরতরে। শাহীনের মনে হচ্ছিল যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। পৃথিবী ছোট হয়ে আসছিল ওর। কায়মনোবাক্যে শাহীন প্রার্থনা করছিল এই তিমিরের রাত যেন কখনও শেষ না হয়। অন্ধকারে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে বড্ড ইচ্ছে করছিল ওর।
×