ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মীম নোশিন নাওয়াল খান

নেহার স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

নেহার স্বপ্ন

রাত আড়াইটা। জানালা দিয়ে খুব সুন্দর একটা রুপালি আলো এসে ছড়িয়ে গেল নেহার ঘরে। আলোটা একটু কমে আসতে সেই আলোর মাঝে দেখা গেল একজন হাসিখুশি পরীকে। তার পরনে সাদা গাউন, হাতে জাদুর কাঠি। খুব হাস্যোজ্জ্বল দেখাচ্ছে তাকে। পরী তার জাদুর কাঠি ঘুরিয়ে নেচে নেচে গান গেয়ে বলল, নেহামণি ঘুমিয়ে যাও, খেলনারা সব ওঠো, বারান্দার টবগুলোতে ফুলরা সবাই ফোটো। পরীর গানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুমন্ত নেহা আরও গভীর ঘুমে ডুবে গেল। পরী না জাগানো পর্যন্ত সে আর জাগবে না। কিন্তু সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো, নেহার ঘরের তাকগুলো থেকে খেলনারা সব জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল। সবচেয়ে আগে ডিমপাড়া মুরগি খেলনাটা তাক থেকে লাফিয়ে নিচে নামল। তারপর একে একে পুতুলগুলো, রোবট, গাড়ি, টেডি বিয়ার- সবাই নেমে এল। শেলফে অগোছালোভাবে ছড়িয়ে থাকা রঙিন ছবির আর রূপকথার বইগুলোও লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এল। বারান্দার টবগুলোতে কুঁড়িরা সব ফুল হয়ে ফুটে সৌরভ ছড়াতে লাগল। পরী এবার হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, তোমরা সবাই কেমন আছ? সোনালি চুলের বার্বি ডলটা নিজের জামার ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, এই দেখছ না কেমন আছি? আমার গায়ে তো ধুলো জমে গেছে রীতিমতো! প্রতিদিন শুধু ওই তাকে পড়ে থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। টেডি বিয়ারটা বলল, একই জায়গায় বসে থেকে থেকে আমার কোমর ব্যথা হয়ে গেছে। একটা রূপকথার বই বলল, আমি কতদিন ধরে বাঁকা হয়ে পড়ে আছি। নেহা আমাকে কখনও খুলেও দেখে না! ডিমপাড়া মুরগিটা বলল, তিন মাস তুমি আমাদের দেখতে আসনি। আর এই তিন মাস আমরা এভাবেই পড়ে আছি। নেহা আমাদের নিয়ে একবারও খেলেনি। টেডি বিয়ারটা বলল, শুধু ওর আম্মুর সঙ্গে রাগ করে একবার আমাকে ছুড়ে মেরেছিল। যা ব্যথা পেয়েছি! সবাই একে একে মনের দুঃখের কথা বলতে লাগল। পরীটা সবার কথা শুনল। তারপর বলল, আমি তো এই তিন মাস অন্য দেশে ছিলাম। আচ্ছা, আমাকে বল, নেহা তো মাত্র ক্লাস টু-তে পড়ে। স্কুলে তো বেশিক্ষণ থাকে না। পড়াশোনারও চাপ নেই। তাহলে ও সারাদিন কী করে? সোনালি চুলের বার্বি ডলটা নেহার বিছানার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ওই যে দেখ, ওর বালিশের পাশেই স্মার্টফোন রাখা। ও সারাদিন ওটা নিয়েই খেলে। পরীটা অবাক হয়ে বলল, এইটুকু মেয়ে স্মার্টফোন নিয়ে কী করে? সে তার জাদুরকাঠি ঘুরিয়ে স্মার্টফোনটাকে জাগিয়ে তুলল। তাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, নেহা তোমাকে নিয়ে কী করে সারাদিন? প্রশ্ন করতে না করতে স্মার্টফোনটা কাঁদো কাঁদো গলায় অভিযোগ শুরু করল। বলল, আর বল না। ও আমার জীবন শেষ করে দিচ্ছে। সারাদিন ও আমাকে নিয়ে গেম খেলে অথবা কার্টুন দেখে। আমার ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর আমি আজকাল বেশিক্ষণ চার্জ রাখতে পারি না। দ্রুত চার্জ ফুরিয়ে যায়। আর তারপর জান, গেমে হেরে গেলে বা অন্য কোন কারণে রাগ হলেই ও আমাকে ছুড়ে মারে। এই দেখ, আমার গায়ে কতগুলো দাগ। পরীটা চিন্তিত হয়ে বলল, এটা তো ভাবনার বিষয়। এমন করে সারাদিন স্মার্টফোন ব্যবহার করলে তো নেহার চোখে সমস্যা হবে, পিঠেও সমস্যা হবে। এমনকি ব্রেনে সমস্যা হওয়াটাও অবাক ব্যাপার না। আর সবচেয়ে বড় কথা, সারাদিন স্মার্টফোন ব্যবহার করে ও ওর শৈশবকে হারিয়ে ফেলছে। বাস্তব জগত থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর দেখ, ওর মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই কিছু একটা করতে হবে। সবাই বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ। কিছু একটা কর! পরীটা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, বুদ্ধি পেয়েছি! সবাইকে সে বলল, তোমরা সবাই এবার ঘুমিয়ে পড়। কাল থেকে সবকিছু অন্যরকম হবে। সবাই খুব আনন্দে থাকবে। নেহা তোমাদের নিয়ে খেলবে। সে তার জাদুরকাঠি ঘোরাল। খেলনাগুলো, বইগুলো আর স্মার্টফোনটা সবাই যার যার জায়গায় গিয়ে আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল। এরপর পরীটা নেহার দিক জাদুর কাঠিটা ঘুরিয়ে কিছু একটা বলল বিড়বিড় করে। তারপর একটু হেসে জানালা দিয়ে উড়ে গেল দূর আকাশে। নেহা দেখল সে এক অদ্ভুত শহরে চলে এসেছে। সেখানে তার বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে। কিন্তু এরা কেউ স্বাভাবিক না। এদের বেশিরভাগই অন্ধ, তারা লাঠি নিয়ে হাঁটছে। কেউ আবার খুব খিটখিটে মেজাজের, কেউ কিছু বলার আগেই রেগে যাচ্ছে। নেহা কাউকে খুঁজে পেল না যাকে জিজ্ঞেস করবে সে কোথায় এসেছে আর এখানে সবাই এমন কেন। সে হাঁটতে থাকল। হাঁটতে হাঁটতে সে একটা বাগানে চলে এল। সেই বাগানেও তার বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে। কিন্তু এখানে দৃশ্যটা একদম উলটো। এখানের ছেলেমেয়েরা হাসছে, গাইছে, খেলছে। কারও হাতে বই- তারা বন্ধুদের সঙ্গে মজা করে গল্প পড়ছে। কেউ পুতুল নিয়ে খেলছে। কেউ আবার প্রজাপতির পেছনে ছুটছে। একটা মেয়ে এসে নেহার হাত ধরে বলল, তুমি কে? একা দাঁড়িয়ে আছ কেন? চল আমরা একটা বই পড়ি। আমি আজই নতুন একটা বই পেয়েছি। অনেক সুন্দর রঙিন একটা বই! নেহা মাথা নেড়ে বলল, না না, আমি তো বই পড়ি না। তুমি বরং আমাকে একটু সাহায্য করও। আমাকে বলতে পারবে, আমি কোথায় এসেছি? এখানে সবকিছু এমন অদ্ভুত কেন? সে একটু আগে দেখে আসা ছেলেমেয়েগুলোর কথা জিজ্ঞেস করল। আর এই বাগানের ছেলেমেয়েগুলোর কথাও জানতে চাইল। মেয়েটা মন খারাপ করে বলল, একটু আগে তুমি যাদের দেখে এসেছ, ওরা সবাই স্মার্টফোন আর ট্যাব নিয়ে খেলত। বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করায় ওদের কারও কারও চোখে সমস্যা হয়েছে, তা থেকে ওরা অন্ধ হয়ে গেছে। আবার কারও কারও মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। আর তুমি দেখনি, ওখানে একটা হাসপাতালও আছে। বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করে বিভিন্ন রকম অসুস্থতায় ভোগা ছেলেমেয়েরা ওই হাসপাতালে থাকে। নেহা আঁতকে উঠল। সেও তো অনেক স্মার্টফোন ব্যবহার করে! মেয়েটা বলল, আর আমরা? আমরা সবাই অনেক আনন্দে থাকি। আমরা খেলনা নিয়ে খেলি, গল্পের বই পড়ি, ফুলবাগানে প্রজাপতির পেছনে ছুটি। আমরা সবাই অনেক হাসিখুশি থাকি সবসময়। নেহা ভেবে দেখল, সেও তো বদমেজাজি হয়ে যাচ্ছে। তার মনে তো একটুও আনন্দ নেই। সে সারাদিন গেম খেলে, কিন্তু এত আনন্দ তো কখনও পায় না! সে ঠিক করল, স্মার্টফোন ব্যবহার করা কমিয়ে দেবে। তার খেলনাগুলো নিয়ে খেলবে, বই পড়বে, বারান্দার গাছগুলো দেখাশোনা করবে। সেও এখানের সবার মতো হাসিখুশি থাকতে চায়। কিন্তু এই কথাটা ভাবতে ভাবতেই সে সব ঝাপসা দেখতে লাগল। সে চিৎকার করে উঠে বলল, কী হলো? আমি কেন কিছু দেখতে পাচ্ছি না? কী হচ্ছে? কেউ একজন বলল, তুমিও তো অনেক স্মার্টফোন খেল। সেজন্যই... কথাটা শেষ হলো না। নেহার ঘুম ভেঙে গেল। সে লাফিয়ে উঠে বসল। পাশে রাখা স্মার্টফোনটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওটা হাতে নিয়ে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখল। বিছানা থেকে নেমে তাকে রাখা খেলনাগুলো নামাল। বইগুলো নামাল। এগুলোই তার নতুন বন্ধু। সে এখন থেকে এগুলোর সঙ্গেই সময় কাটাবে। সেও অনেক আনন্দে থাকবে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, দ্বাদশ শ্রেণী অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×