ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল বাংলাদেশ তারুণ্যের চোখে

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

ডিজিটাল বাংলাদেশ তারুণ্যের চোখে

মিরাজ হোসেন, লেকচারার, কিং খালেদ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপায়ণ মূলত ৩টি ক্ষেত্রে হওয়া জরুরী। প্রথমত, ব্যক্তিক, মানবজীবনের যে কোন চাহিদা, সেবা, ব্যবসা অনলাইন থেকে পাওয়া চাই এবং কৌতূহলী মনের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পূরণ, যেটা গুগল খুব চমৎকারভাবে করে আসছে। তবে প্রজন্ম খেয়াল রাখতে হবে যাতে তারা সময় অপচয় না করে গঠনমূলক কাজে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে। তথ্যপ্রযুক্তিতে সবার প্রবেশাধিকার সহজ জরুরী। দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বোচ্চ সহায়ক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সব কিছুরই ভাল মন্দ থাকে। সামাজিক মাধ্যমের অসামাজিক বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে হবে। তৃতীয়টা মানবিক দিক। সম্প্রতি আমরা বিভিন্ন দুর্যোগ বা বিপদে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে খুব দ্রুতই মানবিক সহায়তা পৌঁছানো বা সংগ্রহ করতে দেখেছি। এমনটাই তো চাই। এখন পর্যন্ত ডিজিটাল দুনিয়ার বড় সাফল্য এটাই বলে আমি মনে করি। এছাড়াও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে ডিজিটাল দুনিয়ায় গঠনমূলক কাজে ভূমিকা রাখতে হবে এবং সর্বোপরি দেশের জন্য কাজ করতে হবে। ডিজিটাল জগতে আমাদের দেশকে বিদেশ নির্ভর থাকতে হবে না আশা করি। সবশেষে প্রত্যাশা এই যে বাংলাদেশ উন্নতি করুক। নওরীন নূয়েরী, এইচআর ডেপুটি ম্যানেজার, ব্র্যাক প্রথমে ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। আমি কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করেছি। ভাষা বুঝতে না পারা বা অচেনা রাস্তায় চলতে আমার কোন সমস্যা হয়নি। কেনাকাটা করা, টিকেট কাটা কোন কিছুতেই তাদের ভাষা না জানা কোন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। কারণ ছিল একটাই। আমার মুঠোফোনে কয়েকটি এ্যাপ। দেশে এসে আমি দেখলাম গুগল ম্যাপ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই মুখে অবস্থান বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে বা অনলাইনে অনেক সুবিধা থাকার পরও আমরা ব্যবহার করছি না। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের প্রযুক্তি চর্চা যেন শুধু সামাজিক মাধ্যম না হয়ে জীবনে সহজ করতে ব্যবহৃত হয়। তবে এই প্রজন্মকে নিয়ে এবং বাংলাদেশ নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী। আমাদের প্রযুক্তি প্রিয় প্রজন্মকে নিয়ে অনেক কটু কথা শুনতে পাওয়া যায়। বলা হয় এই প্রজন্ম সারাদিন ফোন বা ল্যাপটপে আটকে থাকে। আমি বিশ্বাস করি এভাবেই ভাল কিছু হচ্ছে এবং সামনেও ভাল কিছু আসবে। কর্মজীবনে একবার একটা প্রজেক্টের জন্য ইন্টারনেট ঘেঁটে সেই সংক্রান্ত সব আর্টিকেল জার্নাল পড়ে ফেললাম। তারপর কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। সেখান থেকেই ফেসবুকে চাকরির জন্য আবেদন করে ফেললাম। ফেসবুকের কর্মী নির্বাচনের কয়েকটি ধাপ পার হলেও শেষ পর্যন্ত বাদ পড়ে যাই। অফিসিয়াল নানা কাজও অনলাইনে বসে এখন সেরে ফেলছি যেখানে ১০ বছর আগে হলে হয়তো এটার জন্য অনেক দূর যেতে হতো। তথ্যপ্রযুক্তির এই গ্রোত এসেছে লেগেছে আমার বাড়ির বাগানেও। আমার মা এখন তার শখের বসে করা বাগানটির যত্ন কিভাবে নিতে হবে সেটা ডিজিটাল মাধ্যম থেকে জানছেন। বাংলাদেশের স্থানীয় কয়েকটি আইটি স্টার্ট আপ দেখিয়ে দিয়েছে তারা তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবে দারুণ কিছু করতে পারবে। আশার কথা হল এই যে সবাই হয়তো সব কিছু জানে না কিন্তু জানতে বাধা নেই, আর এটি হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমের প্রসারের ফলে। আগামীর যুদ্ধ হবে তথ্যযুদ্ধ সেই যুদ্ধে অংশ নিতে বাংলাদেশ পরিণত হয়ে উঠবে এটাই আমার প্রত্যাশা। সিরাজাম মুনির শ্রাবণ, সম্পাদক, জিরো টু ইনফিনিটি (বিজ্ঞান সাময়িকী) এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেটি হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ। স্বপ্ন দেখি সরকারের পক্ষ থেকে এমন এমন উদ্যোগ নেয়া হবে যার মাধ্যমে নিজেদের দেশেই তৈরি হবে প্রযুক্তি। তার জন্য দরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে প্রচুর গবেষণা। স্বপ্ন দেখি গবেষণার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সময়ে সময়ে নেয়া হবে বিশেষ উদ্যোগ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার জন্য দেয়া হবে পর্যাপ্ত বরাদ্দ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি তৈরি করা হবে বিশেষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেখানে কাজ করবে হাজার হাজার বিজ্ঞানী। সেখানে হবে বিশ্বমানের গবেষণা। সেসব গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করা গবেষকদের দেয়া হবে ভাল মানের সুযোগ সুবিধা। এ সুবিধা দেখে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যেসব বাংলাদেশী মেধা অন্য দেশে যাওয়ার কথা ছিল তারা থেকে যাবে এদেশেই। যারা অন্য দেশের হয়ে কাজ করছে তারা একসময় চলে আসবে বাংলাদেশে। স্বপ্ন দেখি সরকারের পক্ষ থেকে এমনসব উদ্যোগ নেয়া হবে যার মাধ্যমে তৈরি হবে সুন্দর এক বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ। যে সমাজে কেউ কুসংস্কারে কান দেবে না, কেউ মেতে উঠবে না অবাস্তব গুজবে। মাজেদুল মজিদ মাহমুদ, শিক্ষার্থী, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা চাহিদা ডিজিটাল স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা চাহিদা ডিজিটাল বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে প্রথম যখন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শব্দ দুটি সামনে আসে তখন এরা শুধুই দুটি শব্দ ছিল। অনেকের কাছে হাসির খোরাকের কারণ ছিল এই শব্দ দুটি। ১০ বছর পর তারাই এই জোয়ারের অংশীদার। মোবাইল ব্যাংকিং, থ্রিজি ফোরজি, আসন্ন ফাইভজি, ই-কমার্সে উন্নতি সবই সম্ভব হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির এক গতিশীলতার ফলে। ২য় শ্রেণীতে পড়ার সময় আমার বাড়িতে প্রথম ইন্টারনেট আসে। সেসময়ের নামমাত্র গতি আর আজকের গতির পার্থক্যেই পরিবর্তন স্পষ্ট। তবে এই অর্জন নিয়ে কিন্তু থেমে থাকা যাবে না, অর্জনের গতি বৃদ্ধি করে সামনে আরও অর্জন করতে হবে। এখনও থেকে যাওয়া খুঁটিনাটি সমস্যাগুলো দ্রুতই সমাধান হবে বলে আমি আশাবাদী। টেন্ডার নিয়ে পূর্বে হানাহানি লেগেই থাকত। ই-টেন্ডারের ফলে রাতারাতি সেটা সমাধান হয়ে গেছে। সুশাসন ডিজিটাল মাধ্যম ধরে এভাবেই সমুন্নত হবে। আর সুশাসন আমার মতো প্রত্যেক নাগরিকেরই প্রত্যাশা। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং নীতিনির্ধারকদের ধন্যবাদ। দিনশেষে কিন্তু সবথেকে বড় দায়িত্বটা আমাদের নাগরিকদেরই। গতিশীল এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলানো বাংলাদেশের কারিগর আমরাই। কাজী আফ্রিদা আহসান, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বপ্ন, একটি প্রত্যয়। আমার ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্থ এমন এক বাংলাদেশ যে বাংলাদেশ পরবর্তী যুগে সময়মতো প্রবেশ করবে। শিল্প বিপ্লব ইউরোপকে বহু বছর এগিয়ে দিয়েছিল। সেই বিপ্লবে যারা অংশ নিয়েছিল পরের কয়েক শতক পৃথিবী ছিল তাদের। তাই আমি মনে করি সময়মতো নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল বাংলাদেশ সেই নতুন যুগের ধাপ বলে আমি মনে করি। রাতারাতি সব কিছু বদলে ফেলা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে লক্ষে এগিয়ে যেতে হবে। আমি এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যে বাংলাদেশ বিশ্বমানের অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্য এবং সেবাদাতার মধ্যে প্রথম হবে। বাংলাদেশের অনলাইন সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো হবে বিশ্বের ধনী কর্পোরেট সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি। সে জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রশিক্ষণ এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আছে বলে আমি মনে করি। এখন শুধু বাস্তবায়ন দরকার। ই-গবর্নেন্স এবং শিক্ষা লাভেও ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহারে আমি যথেষ্ট আশাবাদী। আমি আশা করি তারুণের আইডিয়াগুলোকে সরকার প্রণোদনা দিবে। মাটির নিচে প্রাকৃতিক সম্পদ খুব বেশি নেই আমাদের। তাতে কি? সত্যিকারের ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হলে আমরা হবো মাটির উপরেরই এক সম্পদ। তানভীর রহমান পার্থ, ফ্রিল্যান্সার গ্রাফিক্স ডিজাইনার শিক্ষাজীবনেই খণ্ডকালীন কাজ করা। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চেয়েছি শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়ই। উদ্দেশ্য স্বাবলম্বী হওয়া। গ্রাফিক ডিজাইনার নিয়ে কাজ করতে এই জন্যই উৎসাহ পেয়েছি কারণ কাজ করার ক্ষেত্র প্রশস্ত ছিল। ইন্টারনেটের ব্যাপকতা, ডিজিটাল স্পেসে বিভিন্ন সুবিধা আমাদের এগিয়ে নিচ্ছে। তবে এটা সবেমাত্র সূচনা। দিন দিন আরও পরিণত হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। অপ্রাপ্তি কিন্তু আছে তবে প্রাপ্তির সঙ্গে তুলনা করলে সেটা খুব কম। আমি এমন এক ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে এক এক জন তরুণই এক একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে উঠবে। বিশ্বের সব বড় বড় আইটি কোম্পানি ৩/৪ জন মিলেই শুরু করেছিল। পরের দশকে তাদের নিট সম্পদ হয়ে উঠল অনেক দেশের থেকেও বেশি। ছোট ছোট আইটি দলকে বড় কোম্পানিতে রূপান্তর হওয়ার প্রধান শর্ত ভাল পরিচর্যা। বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আওতায় এই পরিচর্যাটা খুব বড় ভূমিকা রাখবে। তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক সেবার এমনভাবে প্রসার ঘটাতে হবে যাতে সর্বোচ্চ সেবাটা অনলাইনে পাওয়া যায়। ব্যবসা, সুশাসন, জবাবদিহির মতো বিষয়গুলোও চলে আসবে অনলাইনের আওতায়। আমি মনে করি সবে মাত্র শুরু। এখনও অনেক পথ বাকি। যেতে হবে অনেকদূর। বর্তমান যুগে বাংলাদেশের উন্নতির কথা বলতে গেলে সর্বপ্রথম যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায় তা হল ডিজিটাল। বাংলাদেশ সরকারের ভিশন ২০২১, ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিকল্পনা, একজন প্রকৌশলী শিক্ষার্থী হিসেবে আমাকেও ভাবায়। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে সবচেয়ে বেশি যা চোখে পরে তা হলো প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই এখন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। গত ২ দশকে বাংলাদেশে প্রযুক্তির ব্যবহারে যে বিপ্লব ঘটেছে তা অবশ্যই চোখে পড়ার মতো। ধনী, গরিব নির্বিশেষে সকলের হাতে মোবাইল ফোন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে খুব সহজেই লেনদেন হচ্ছে। বিদ্যুত বিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিল পরিশোধের কাজ ঘরে বসেই সম্পন্ন করা যাচ্ছে। পরীক্ষার ফরম পূরণ, চাকরির দরখাস্ত ও খবরাখবর খুব সহজেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেরে ফেলা যাচ্ছে। ইদানীং এর ব্যবসাক্ষেত্রে আরও একটি অগ্রগতি ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের ব্যবহার। অনলাইনের মাধ্যমে কেনাবেচার চল ব্যবসাকে এক নতুন রূপ দিয়েছে। স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে উদ্যোক্তারা। এক্ষেত্রে বিস্তার ভূমিকা পালন করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। এছাড়া উবার, পাঠাও, ফুড পান্ডার মতো এ্যাপভিত্তিক সেবাগুলোও সম্ভব হচ্ছে অনলাইনের বিস্তারে। ইভিএমের ব্যবহার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে এসেছে নতুন মাত্রা। একজন বায়োমেডিক্যালের শিক্ষার্থী হিসেবে স্বপ্ন দেখি ডিজিটাল বাংলাদেশে চিকিৎসাক্ষেত্রের প্রসার। চিকিৎসাক্ষেত্রের প্রতিটি অঙ্গনে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার। দক্ষ জনশক্তি তৈরির মাধ্যমে প্রতিটি ক্ষেত্রকে আরও শক্তিশালী করে তোলা সম্ভব। এর জন্য চাই শিক্ষার বিস্তার। শিক্ষাক্ষেত্রে কোন প্রকার দুর্নীতি আমাদের কাম্য নয়। সব মিলে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী। তবে ডিজিটালাইজেশনের এই ধারা যেন শ্লথ হয়ে না পড়ে সেই জন্য সতর্ক থাকতে হবে। তাছাড়াও রাজনৈতিক কারণে যেন এই প্রক্রিয়ায় ভাটা না পড়ে। একটা কথাই বলব বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।
×