ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লাল কাঁকড়ার চর

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

লাল কাঁকড়ার চর

কলাপাড়ায় গঙ্গামতি পর্যটনপল্লী ঘেঁষা দীর্ঘ সৈকতে রয়েছে লাল কাকড়ার নয়নাভিরাম বিচরণ। এ জন্য গঙ্গামতির খ্যাতি রয়েছে লাল কাঁকড়ার চর হিসেবে নামকরণের। গঙ্গামতি সৈকত ছাড়াও কুয়াকাটার খাজুরা থেকে খালগোড়া পর্যন্ত আন্ধারমানিক মোহনার বেলাভূমে লাল কাঁকড়ার বিচরণ চোখে পড়ে। নতুন সৃষ্ট, কুয়াকাটার অদূরে চরবিজয় রয়েছে লাল কাঁকড়ার বিচরণভূমি। যেন এক অপূর্ব বিরল দৃশ্য। চোখে দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বিমোহিত হয় আগতরা। আর পর্যটক দর্শনার্থী থেকে শুরু করে স্থানীয় পিকনিক পার্টির সদস্যরা লাল কাঁকড়া ধরতে উন্মুখ হয়ে যান। উন্মাদনা চালান একটি লাল কাঁকড়া ধরতে। ধাওয়া করেন লাল কাঁকড়ার সারিবদ্ধ দলকে। কখনও বালুর আঘাতে কাঁকড়া গুরুতর জখম হয়ে অঙ্গহানি ঘটছে। কেউ ধরতে গিয়ে মেরে ফেলছে। কেউবা ওদের আবাস বেলাভূমের গর্ত নষ্ট করে দিচ্ছেন। এখন লাল কাঁকড়ার জন্য বেঁচে থাকা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। লাল কাঁকড়ার বিচরণ দেখতে কিংবা এদের গতিপ্রকৃতি, ভোঁ দৌড় দেখতে বিজ্ঞান ও পরিবেশসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করার সময় এসে গেছে। নইলে বিচর ভূমির অভাবে লাল কাঁকড়াও হারিয়ে যাবে। এখনই লাল কাঁকড়ার বিচরণ এলাকার পরিধি ছোট্ট হয়ে আসছে। যখন সাগরে ভাটা থাকে তখন সৈকতের পরিধি বৃদ্ধি পায়। তখন লাল কাঁকড়া বালুর নিচের বাসা (গর্ত) থেকে বের হয়ে আসে। বিচরণ করে। দৌড়াদৌড়ি করে। বালু থেকে মাটি আলাদা করে। যেন আলপনায় ঢেকে দেয় সৈকতের বেলাভূমি। খেলতে থাকে একে অপরের সঙ্গে। ওদের স্বকীয়তায় বিচরণ করে নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে। যেখানে একটু মানুষের পদচারণা কম। কোলাহলমুক্ত, সেখানেই লাল কাঁকড়ার বহর দেখা যায়। প্রায় এক/দেড় শ’ মিটার দুর থেকে লাল কাঁকড়ার দল চোখে পড়ে। এরপর পর্যটক দর্শনার্থী যখন ৩০-৪০ মিটার কাছে চলে আসে তখন লাল কাঁকড়ার দল জীবন বাঁচাতে ভোঁ-দৌড় দেয়। তখন কোন কাঁকড়া উল্টে যায়। কোনটা আহত হয় হাত-পা ভেঙ্গে যায়। কোন পর্যটক-দর্শনার্থী হাতে ধরার জন্য লাল কাঁকড়া ধাওয়া করেন। এতে পায়ের তলে পিষ্ট হয়ে কাঁকড়া মারা পড়ে। আবার কাঁকড়ার আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয়রা জানান, লাল কাঁকড়া ধরতে গিয়ে হাতে বালু নিয়ে ওদের শরীরে সজোরে ছিটিয়ে দিলে দৌড়ের সময় চিৎ হয়ে পড়ে যায়। তখন কাঁকড়াটি অসহায় হয়ে থাকে। হাতে ধরা যায়। এভাবে অনেক কাঁকড়া মারা পড়ে। তখন অনিরাপদ ভেবে ওই স্পট থেকে লাল কাঁকড়া বিতাড়িত হয়ে অন্য চরে আবাস গড়ে। এটি স্থানীয় জেলেরা জানায়। গঙ্গামতির জেলে আব্দুল হাকিম জানান, আগে তিন/চার কিলোমিটার সৈকতের সব জায়গায় লাল কাঁকড়া দেখা যেত। কিন্তু পর্যটকসহ মানুষের আনাগোনা বাড়ায় এখন সৈকতের উত্তর দিকটায় লাল কাঁকড়ার দেখা মেলে। দক্ষিণে তেমন একটা নেই। এছাড়া সৈকতজুড়ে ভাড়াটে কিংবা ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল চলাচল এত বেড়ে গেছে যে লাল কাঁকড়া মারা পড়ছে। এসব জেলের মন্তব্য, দূর থেকে বাইনোকুলারসহ যেকোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লাল কাঁকড়ার বিচরণ দেখা উচিত। নইলে লাল কাঁকড়া হারিয়ে যাবে। নাম থাকবে লাল কাঁকড়ার চর। কিন্তু কাঁকড়া থাকবে না। এ লক্ষ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে লাল কাঁকড়ার বিচরণ দেখতে, এমন সতর্কতা সংবলিত সাইনবোর্ড লটকানো প্রয়োজন। মার্কিং করা প্রয়োজন। লাল কাঁকড়ার চর বিচরণে পর্যটক-দর্শনার্থীসহ সাধারণ মানুষের করণীয় বিষয় সংবলিত সাইনবোর্ড দেয়া যেতে পারে। এটির বাস্তবায়ন করতে এখনই উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে পরিবশ কর্মী মোস্তাফিজুর রহমান জানান। কুয়াকাটা-কলাপাড়ার পরিবেশ প্রতিবেশসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। যে স্পট পর্যটকের কাছে এখন যে কারণে আকর্ষণীয় সেই জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করা প্রয়োজন। কাঁকড়া আর্থ্রোপোডা পর্বের একটি ক্রাস্টাসীয় প্রাণী। লাল কাঁকড়া এর একটি প্রজাতি। এ পর্যন্ত কাঁকড়ার ৬,৭৯৩টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। সদা সতর্ক লাল কাঁকড়ার বিচরণদৃশ্য দূর থেকেই কিছুটা অবলোকন করা যায়। এটি সাইজে খুবই ছোট্ট। এরা কোন কিছুর শব্দ পেলেই নিমিষেই ভোঁদৌড়ে গর্তে ঢুকে পড়ে। লেন্স ব্যবহৃত ক্যামেরাবিহীন এর ছবি তোলা দুরূহ কাজ (উইকিপিডিয়া)। বর্তমানে কলাপাড়ায় লাল কাঁকড়ার বিচরণ এলাকা ক্রমশ কমে যাচ্ছে, এ জন্য পরিবেশ কর্মী রুমান ইমতিয়াজ তুষার জানান, স্পট এবং এলাকা নির্দিষ্টকরণ করা প্রয়োজন লাল কাঁকড়া দেখার জন্য। নইলে মনোলোভা এ দৃশ্যসহ জীববৈচিত্র্য পরিবেশ-প্রতিবেশ সব হারিয়ে ফেলব আমরা। দেশবরেণ্য পরিবেশবিদ প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘লাল কাঁকড়ার কাজ হচ্ছে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করা। ওরা আলপনার মতো করে বীচে। বালু থেকে মাটিকে আলাদা করতেই এমনটি করছে লাল কাঁকড়া। এক্ষেত্রে লাল কাঁকড়ার বিচরণ ক্ষেত্র অবলোকনে ইকোট্যুরিজম করতে হবে। পর্যটক-দর্শনার্থীকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। নির্দেশনা সংবলিত সাইনবোর্ড দেয়া যেতে পারে। বন বিভাগকে এ জন্য দায়িত্ব নিতে হবে। পর্যটককে বোঝাতে হবে ‘আপনি এদের (কাঁকড়া) প্রতি সদয় হোন।’ সচেতন করার বিকল্প নেই। পরিবেশবিদ আরও বলেন, ‘প্রকৃতিকে চুপি চুপি দেখতে হয়।’ বন বিভাগ মহিপুরের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। কলাপাড়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য মোঃ তানভীর রহমান জানান, পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট জোন করে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। প্রতিবেশ-পরিবেশসহ জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় সকল পদক্ষেপ নেয়া হবে। -মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে
×