ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তরুণ মানিক মানুষের সেবায় যেন মানিক রতন

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

 তরুণ মানিক মানুষের সেবায় যেন মানিক রতন

যশোর শহরের রেলগেট পূর্বপাড়ার বাসিন্দা মনসুর আলী। বয়োবৃদ্ধ মানুষটির কেউ নেই। নেই কোন সহায়-সম্পদও। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য যখন যেমন তখন তেমন কাজ করতেন। এক পেট, তাতেই চলে যেত। কিন্তু বয়সের কারণে এখন আর সব কাজ করতে পারেন না। কিন্তু চলবে কি করে। কারও কাছে হাত পাতার অভ্যাস নেই তার। এমনই এক অবস্থায় তিনি জানতে পারেন তার বাসার অদূরেই আছে এক তরুণ, যে তার বাঁচার পথ দেখাতে পারে। মনসুর আলী একদিন সেই তরুণ তোফাজ্জেল হোসেন মানিকের কাছে গেলেন। বৃদ্ধকে দেখেই মানিক যে মানবিক ব্যবহারটি করলেন তাতে তিনি বুঝে ফেললেন তার একটা পথ এবার বেরোবে। মনসুর আলী তার সমস্যার কথা মানিকের কাছে খুলে বললেন। জানালেন, এখন আর কোন কাজ করতে পারি না। চেয়ে-চিন্তে বা ভিক্ষে করে খাওয়ারও অভ্যাস নেই। এ অবস্থায় যদি হাজার তিনেক পুঁজির ব্যবস্থা হয় তাহলে কিছু একটা করে খাওয়ার পথ হয়। তোফাজ্জেল হোসেন মানিক ‘গড়বো সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র (জিএসকেএস) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। এই সংস্থা থেকে বিনাসুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা আছে। সংস্থা থেকে মনসুর আলীকে ৩ হাজার টাকা ঋণের ব্যবস্থা করলেন। বৃদ্ধ বাসায় বসে ঠোঙা বানান। তিনি জানান, এ কাজে তার প্রতিদিন আয় হয় দেড় শ’ থেকে দু’শ’ টাকা। কিস্তির টাকা শোধ করেও চলে যাচ্ছে ভালভাবে। জিএসকেএস থেকে বিনাসুদে ঋণ নিয়েছেন ভাপাপিঠে বিক্রেতা পান্নু শেখ, সবজি ফেরিওয়ালা ফাতিমাসহ ১২ জন। তারা সবাই এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা করে সংস্থার কিস্তি শোধ করেও প্রতি দিন ২০০ টাকার মতো আয়ের পথ পেয়েছেন। সংসার জীবনের হা-ভাত অবস্থা নেই এখন তাদের। এই সমাজে বিত্তবান মানুষেরা যখন সম্পদের পাহাড় গড়ার চিন্তায় ব্যস্ত, সমাজের প্রতি ন্যূনতম দৃষ্টি নেই যখন অধিকাংশের, তখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন মানিক নামের এই তরুণটির সমাজকল্যাণে তার ত্যাগ ও নিষ্ঠার কথা কিংবদন্তির কাহিনীর মতো মনে হয়। একেবারেই লেখাপড়া না জানার মতো তিনি। মানিক জানান, হতদরিদ্র বলতে যা, সে রকম পরিবারে জন্ম তার। পড়েছেন ক্লাস ফোর পর্যন্ত। তারপর আর পড়তে পারেননি। লেখাপড়া ছেড়ে আয়ের পথ ধরতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু ১২-১৩ বছর বয়সে আয়ের কি পথ ধরবেন। স্বল্প পুঁজির অল্প ঝুঁকির ব্যবসা ফেরি করে বাদাম ভাজা বিক্রির কাজ শুরু করেন। কিছু দিন বিক্রি করেন আইসক্রিম। তিনি ওই বয়সে ভাবতেন তার মতো অনেক কিশোর আছে যারা দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া শিখতে পারে না। অনেকেই আছে যারা তার মা-বাবার মতো কষ্ট করেন। যদি জীবনে সুযোগ আসে তাহলে এসব মানুষের জন্য কিছু করবেন। এই যার আর্থিক অবস্থা সেই মানিক স্বপ্ন দেখতেন মানুষের জন্য কিছু করার। তোফাজ্জেল হোসেন মানিক তার কাজের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এলাকার সমাজ সচেতন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠন করেন ‘গড়বো সমাজ কল্যাণ সংস্থা (জিএসকেএস)। এই সংস্থার সঙ্গে যশোর শহরের রেলগেট এলাকার ২৭ জন যুক্ত হয়েছেন। তাদের ৭ সদস্যের একটি পরিচালনা কমিটি আছে। এই কমিটির সভাপতি হলেন মিনারা খন্দকার মিনি। মানিক হলেন সাধারণ সম্পাদক। সংস্থাটি যুব উন্নয়ন অধিদফতরের রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে। সুদমুক্ত ঋণ সম্পর্কে মানিক বলেন, এ পর্যন্ত যে টাকা দেয়া হয়েছে তার শতভাগ আদায় হয়েছে। কেউ উপকারকে অস্বীকার করে ঋণ খেলাপী হয়নি। এই খাতে যে টাকা দেয়া হয় তার পুরোটাই নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দেয়া। দরিদ্র অসহায় মানুষের কল্যাণে এ ঋণ কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। কোনদিনই সুদের কারবারের সঙ্গে জিএসকেএস জড়িত হবে না। অভিভাবকদের সমাবেশ করা হয় নিয়মিত। তাদের সামনে তুলে ধরা হয় সমাজের নানা অসঙ্গতির চিত্র। সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। অস্থির হয়ে হয়ে উঠছে পুরো সমাজটা। চলছে নৈতিকতা মূল্যবোধের চরম দুর্ভিক্ষ। অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, অনাচারে সমাজের মানুষ আজ দিশেহারা। এসব অবস্থা থেকে মানুষকে বেরিয়ে এসে সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অল্প পুঁজির স্বল্প শিক্ষার মানুষ মানিকের এ কাজকে শিক্ষিত সমাজের অনেকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে। যাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার কথা তাদের কাছ থেকে কাক্সিক্ষতভাবে পাওয়া যায় না। তাদের ভাবখানা এই যে মানিককে মূল্যায়ন করলে তাদের মূল্য থাকে কি করে। তবে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মানিকের কাজে সন্তুষ্ট। তারা সংস্থার দীর্ঘায়ুও কামনা করে। -সাজেদ রহমান, যশোর থেকে
×