ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রেজা সেলিম

নতুন এক স্বপ্নব্রত

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২০ জানুয়ারি ২০১৯

নতুন এক স্বপ্নব্রত

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার একটি আলাপচারিতার সুযোগ ঘটে। ১৬ জানুয়ারি তিনি তাঁর ব্যস্ততম সময়ে আমার ও তাঁর এক নিকটজন অনুরাগী কর্মীর সঙ্গে তাঁর দফতরে বসে মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা, গণহত্যা ও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের পূর্তি চিন্তা নিয়ে তাঁর ভাবনাগুলো শেয়ার করেন ও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেন যে, ইতোমধ্যে অনেক কাজ করা হয়েছে ও আমাদের এখনও অনেক কিছু করার আছে, যা আমাদের দেশের জন্য জরুরী। পরামর্শ দেন যেন আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের সব অর্জনের সত্যিগুলো খুঁজে বের করার কাজ করি। কারণ, এখনও অনেক সত্যি আমাদের আড়ালে রয়ে গেছে যে সত্যিগুলো আমাদের নিজেদের ও পরের প্রজন্মের জানা দরকার। এক শ’ বছর পরে যে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে তখন আমরা থাকব না, কিন্তু আমাদের গর্বগুলো তো থাকতে হবে। আমি বিনয়ের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাই যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১২ বছর এবং অনেক কথা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আমার বয়সী এবং তদুর্ধ এমন আরও আছেন যাদের সংখ্যা আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৫ ভাগেরও নিচে (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর নবেম্বর ২০১৫ সালে প্রকাশিত জনমিতিক হিসাবের হারে), যাদের কাছ থেকে এসব তথ্য ও স্মৃতি আমরা এখুনি সংগ্রহ করতে পারি। ২০২১ সালে আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব তখন যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী অনেক বীরযোদ্ধা ও যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী আমাদের মাঝে হয়ত বেঁচে থাকবেন না। তাঁদের কাছ থেকে অজানা অনেক তথ্য আমরা এখনও পেতে পারি। তিনি উৎসাহ দিয়ে বলেন, এই কাজগুলো আমাদের ও তোমাদের সারা জীবনই করে যেতে হবে। কারণ, ১৯৭১ সালের শত সহস্র ঘটনা কেমন করে এই দেশটাকে বিজয়ের দিকে টেনে নিতে পেরেছে তার আসল ইতিহাস জানিয়ে যাওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব এবং এটি হতে হবে একটি চলমান প্রক্রিয়ার মতো। কিছু বলে চুপ করে থাকলাম বা শেষ হয়ে গেল তা নয়, আমাকে আমার জানা সব কথা বলে যেতে হবে। তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বললেন, যুদ্ধের সময় বাংলাদেশেরই এক গ্রামে কিছু মানুষ পাকিস্তানী মিলিটারির ভয়ে একটি বাঁশঝাড়ের আড়ালে লুকিয়েছিল। ওদের মধ্যে একটি শিশু ছিল, যে হঠাৎ কেঁদে উঠে। আর সেই কান্নার শব্দ পেয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যরা ওখানকার সবাইকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। এরকম অজস্র ঘটনা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে ঘটেছে। ৮০ হাজার গ্রামের অন্তত একটি করে ঘটনার উল্লেখ করলেও এই মুহূর্তে আমাদের হাতে ৮০ হাজার ঘটনার ভা-ার আছে। আমাদের ইতিহাস বিভ্রমের কোন সুযোগ নেই। যা ঘটেছে তা ওপর থেকে, পেয়ে বসা রাষ্ট্রযন্ত্র আমাদের ইতিহাসের নির্মম পদচ্যুতি ঘটাবার চেষ্টা করেছে; কিন্তু এখন আমাদের ঘুরে দাঁড়াবার সময় এবং আমরা ইতোমধ্যে অনেকখানিই ঘুরে দাঁড়িয়েছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করে ও যুদ্ধাপরাধীদের অনিবার্য প্রাপ্য ফাঁসি দিয়ে আমরা আমাদের দেশের ইতিহাসকে অনেকটাই কলঙ্কমুক্ত রাখতে সচেষ্ট আছি। এখন আমাদের শুধু পরের কাজগুলো করে নিতে হবে। আলাপচারিতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৭১ সালের গণহত্যা বিষয়ক গবেষণার সূত্র টেনে বলেন, বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশে সংঘটিত পৈশাচিক ঘটনাবলীর জন্য এককভাবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দায়ী ও তাদের সেসব অপকীর্তির বিবরণ বিশ্ববাসীকে জানাতে আমাদের আরও সহায়ক একাডেমিক যুক্তি এবং প্রমাণ দিয়ে গবেষণাগুলো উপস্থাপন করতে হবে। সে কাজে বড়দের সঙ্গে তরুণদেরও এগিয়ে আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, এরকম কাজে তিনি সব সময়ই সহযোগিতা দিয়ে থাকেন ও ভবিষ্যতেও দেবেন। এর জন্য আমাদের আরও পরিশ্রম করতে হবে। আর এটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সকলের দায়িত্বের মধ্যেই তা পড়ে। আমার কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি কথা, মন্তব্য আর উদাহরণ অনুপ্রেরণামূলক বলে মনে হয়েছে। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি এই ভেবে যে, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, যিনি জাতির পিতার কন্যা ও নিজের জীবন উৎসর্গ করে এই দেশটাকে নিয়েই তিন যুগ ধরে পড়ে আছেন। যিনি নিজের যোগ্যতায় ও কর্ম দক্ষতায় ইতোমধ্যে বিশ্বের সেরা নেতাদের তালিকায় নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। তিনি আমাকে উৎসাহ দিচ্ছেন, যেন আমরা আরও দশজন মিলে দেশের জন্য এসব কাজে নেমে পড়ি। তাঁর পরামর্শ শুনতে শুনতে আমার মনে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণের কথা, ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতার কথা যেখানে তিনি বলেছিলেন যুদ্ধ যদি আরও দীর্ঘ হতো ‘তোমরা কি যুদ্ধ করতে না’? সমস্বরে সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা বলেছিলেন ‘করতাম’! আমারও সে রকম মনে হলো, সেই যুদ্ধ কি চলমান নয়? ’৭৫ সালের পর বাংলাদেশের মানুষ কি আর একটি যুদ্ধে ব্যস্ত হতে বাধ্য হয়নি? তাহলে সেই যুদ্ধে আমাদের তো অংশ নিতেই হবে। আজ যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা নির্দেশনা দেন সেসব তথ্য তুলে এনে দুনিয়ার মানুষকে জানাতে, যেন বিশ্ববাসী উপলব্ধি করে সেই দেশ আজ আর একটি যুদ্ধ করেই চূড়ান্ত অর্থনৈতিক মুক্তি পেতে চাইছে- তখন মনে হয় আমি এই দেশের নাগরিক হিসেবে কত ভাগ্যবান। এমন এক দেশেই আমি জন্মেছি, যেই দেশে একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামের এক অবিসংবাদিত নেতা জন্মেছিলেন, যিনি দেশের আপামর মানুষকে এক ডাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করতে। আর আমি সেই দেশের নাগরিক যে দেশের প্রধানমন্ত্রী চান দেশের মানুষ ’৭১ সালের যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় তাদের মনে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো মন খুলে বলুক আর সবাই শুনুক কেমন করে তাদের প্রতিটি ঘটনা এই দেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস তৈরি করেছে। আমি কত সৌভাগ্যবান, বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা একই দেশের মানুষ, একই আলো-বাতাসের আর একই ভাষায় কথা বলি। আমি অবশ্যই সৌভাগ্যবান, কারণ আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এমনকি সাধারণ মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ে ভাবেন, সাধারণের সঙ্গে সেসব নিয়ে আলোচনা করেন ও আমরা তা জানতে পারি। তাহলে এখন আমাদের কর্তব্য কি? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে, ইউটিউবে আজকাল অনেক তথ্য পাওয়া যায় যেগুলো আমাদের দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের খুঁটিনাটি তথ্য নিয়ে তৈরি করা। সেগুলো একখানে আনা যায় কি-না। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নানারকম ঘটনারও ফুটেজ আছে ইউটিউবে যেগুলো আমরা গবেষণা করে, তথ্য যাচাই করে একটি সাধারণ ডাটাবেজ তৈরি করতে পারি। গ্রামে গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীর তথ্য সংগ্রহ করেছে এমন অনেক উপাত্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যেগুলো নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে; কিন্তু সেগুলো নিয়ে এখন তথ্যমালা গড়ে নেয়া যায়। তিনি ’৭১ সালে নিজের বন্দীদশার ঘটনাও বলেন কেমন করে সেসব ঘটনা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবনের তখনকার ঘটনার সঙ্গে মিলে যায়। আলাপে আলাপে আমরা একমত হলাম বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও অজস্র ঘটনা আছে যেগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি বুঝতে সাহায্য করবে আর সেগুলো নিয়েও গবেষণা করার প্রচুর সুযোগ আছে। প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দেন যেসব বিদেশী কূটনীতিক যুদ্ধের সময় আমাদের পক্ষে কাজ করেছেন তাদের অনেকেই এখন বয়োবৃদ্ধ, তাঁদের খুঁজে বের করা যায় কিনা। নানা দেশের পত্র-পত্রিকায় আমাদের যুদ্ধ নিয়ে অনেক লিখেছে যেসবের অনেক তথ্যই আমাদের অজানা। যদি আমরা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিন আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছরের সুবর্ণ তিথিতে সবাই মিলে সরকারের নির্দেশনামতো নিজেদের আয়ত্তের বা পরিধির মধ্যেই কিছু কাজ করি আমার ধারণা বাংলাদেশ তাঁর শতায়ু জীবনের পটভূমির মৌলিক কাজ অনেকটাই এগিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। তখন আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই কোমল মুখশ্রীর আর দেখা পাবো না সত্যি; কিন্তু তাঁর স্মৃতি পাব। আমরা জানব কোন একদিন আমাদের এক বড় বোন আমাদের মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন দেশের জন্য এমন কিছু কাজ করতে যেন জাতি শত বছরেও আর কখনও মাথা কুটে না মরে যে, আমার হাতে তো কিছুই নেই। আলাপচারিতা শেষে যখন আশীর্বাদের ছোঁয়া নিয়ে তাঁর অফিস থেকে বের হয়ে আসি তখন আমার মনে হয়েছে বাঙালী একদিন এই ঋণ স্বীকার করবে ও টুঙ্গিপাড়ার গ্রামে হাজার স্মৃতি ভর করে নুয়ে আসা গর্বিত বাঙালী সেই বোনের জন্য কাঁদবে- যে বোন একদিন তাদের সঠিক পথ চিনে নিতে সাহায্য করেছিলেন। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×