ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বোরহান বিশ্বাস

অভিমত ॥ আওয়ামী লীগের ইশতেহার ও নারীর ক্ষমতায়ন

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২০ জানুয়ারি ২০১৯

অভিমত ॥ আওয়ামী লীগের ইশতেহার ও নারীর ক্ষমতায়ন

সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের মান হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান ষষ্ঠ। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৬’ অনুযায়ী ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭২তম। আর এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে। বাংলাদেশসহ এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নারী শিক্ষা ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘গ্লোবাল উইমেন্স লিডারশিপ এ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১/১১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ওই নির্বাচনে তাদের কঠিন শ্রমলদ্ধ ও বুদ্ধিদীপ্ত ‘দিনবদলের সনদ’ ইশতেহারটি ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। যা তরুণ প্রজন্মের ভোট আকর্ষণে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়। ওই সনদে আর্থ-সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ভাবনার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বেশকিছু ধারা যুক্ত করা হয়। তাতে বলা হয়Ñ ১. নারীর ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘নারী উন্নয়ন নীতি’ পুনর্বহাল করা হবে। ২. নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বৈষম্যমূলক আইনসমূহ সংশোধন করা হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা, কর্মবান্ধব পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৫০টি করেছে। রাজনীতিতে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য ইউনিয়ন কাউন্সিল ও উপজেলা পরিষদ এবং পৌরসভায় সংরক্ষিত নারী আসন এক-তৃতীয়াংশে উন্নীতকরণ এবং সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার নারী। সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে- সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, জেলা প্রশাসক, পুলিশের উচ্চপদ, সশস্ত্র বাহিনী ও জাতিসংঘ শান্তি মিশনে নারীর অংশগ্রহণ- নারীর ক্ষমতায়নের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সংখ্যানুপাত ৪৯.৫ : ৫০.৫, যা কেবল জনমিতিক ভারসাম্যপূর্ণ নয়ই, পৃথিবীতে বিরল এই অনুপাত নারী-শিশুর প্রতি সমাজের সমতাপূর্ণ আচরণের প্রতিফলন। এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নারীর উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে সামনে রেখে বেশকিছু পদক্ষেপ সন্নিবেশিত করে। সদ্য শেষ হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার কথা বলেছে আওয়ামী লীগ। তারা বলেছে- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ’ এবং রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নারীর প্রতি সকল বৈষম্যমূলক আচরণ/প্রথা বিলোপ করা হবে। লক্ষ্য ও পরিকল্পনায় তারা বলছে- ১. ২০২০ সাল নাগাদ উচ্চপর্যায়ের শিক্ষায় নারী-পুরুষ শিক্ষার্থীর অনুপাত বর্তমানের ৭০ থেকে ১০০ শতাংশে বৃদ্ধি করা হবে। প্রশাসন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে নারীর অধিক সংখ্যায় নিয়োগের নীতি আরও বৃদ্ধি করা হবে। ২. নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে তাদের জন্য আলাদা ব্যাংকিং সুবিধা, ঋণ সুবিধা, কারিগরি সুবিধা ও সুপারিশসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে নারীদের কল্যাণে কাজ করছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মহিলা ও শিশু বিষয় সম্পর্কিত জাতীয় নীতি, উন্নয়নমূলক কর্মসূচী গ্রহণ, মহিলাদের আইন ও সামাজিক অধিকার, কর্মের সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এ মন্ত্রণালয় কাজ করছে স্বতন্ত্রভাবে। নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে মজবুত করার জন্যই আওয়ামী লীগ সরকার চাকরিজীবী নারীদের ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করেছে। সন্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে বাবার পাশাপাশি মায়ের নামটিও সংযুক্ত করেছে। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকার কথা বলা হয়েছে। এই অধিকারকে সরকার নিশ্চিতভাবেই প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কাজ করছে। গ্রামীণ নারী সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে মজবুত করার জন্য বিভিন্ন রকম ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হচ্ছে। জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনসহ পুরুষের পাশাপাশি তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদে মহিলাদের জন্য আছে সংরক্ষিত আসন। আবার চাকরিতেও মহিলাদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা। সেই সুবিধা চাকরি পেতে নারীদের জন্য সহায়ক হয়। নারীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বাংলাদেশ এখন বিশ্বের একটি রোল মডেল। গত জাতীয় সংসদে স্পিকার, সংসদনেতা ও প্রধানমন্ত্রী, সংসদ উপনেতাসহ বিরোধী দলের নেতা ছিলেন নারী। সংসদে মোট ৭৩ জন নারীর প্রতিনিধিত্ব ছিল। একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নারী শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন ডা. দীপু মণি। বিচারিক ক্ষেত্রে উচ্চ কিংবা নিম্ন আদালতে আসীন আছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী বিচারক। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়েও রয়েছে নারী সচিব। পাশাপাশি দিন দিন বাড়ছে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা। নারীরা এখন পুলিশ, সেনাবাহিনী কিংবা জাতিসংঘের শান্তি বাহিনীর মতো চ্যালেঞ্জিং কাজে উচ্চপদে দক্ষতার সঙ্গেই কাজ করছেন। নারী বিজ্ঞানী, নভোচারী, গবেষক, উদ্ভাবক, রাষ্ট্রদূত, রাষ্ট্রনায়ক সর্বস্তরেই নারী তাঁর প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। গতানুগতিক ধারায় শিক্ষকতায়, ডাক্তারি পেশায় এবং গণমাধ্যমেও নারীর আধিপত্য এবং দাপট রয়েছে। নারীদের সুরক্ষায় সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে। যেমন : প্রিভেনশন এ্যান্ড রেসট্রেইন অব হিউম্যান ট্রাফিকিং এ্যাক্ট, পর্নোগ্রাফি কন্ট্রোল আইন, পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ আইন ইত্যাদি। নির্যাতিত নারীদের আইনগত সুবিধা এবং অভিযোগ নেয়ার জন্য প্রতিটি জেলায় খোলা আছে স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার। ধর্ষিত নারীদের সহযোগিতা দিতে কয়েকটি সরকারী হাসপাতালেও সরকারের উদ্যোগে জরুরী পরীক্ষার জন্য ডিএনএ ল্যাব খোলা হয়েছে। নির্বাচনে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বেড়েছে। সংরক্ষিত নারী আসন সংখ্যা বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফা বাড়িয়ে এখন তা ৫০ এ দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদ নির্বাচনে এবারই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নারী নির্বাচিত হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৬৯ জন, যা এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ নারী প্রার্থী। এতে জয়ী হয়েছেন ২২ জন। লেখক : সাংবাদিক
×