ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানী হয়ে উঠল উৎসবের নগরী

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২০ জানুয়ারি ২০১৯

রাজধানী হয়ে উঠল উৎসবের নগরী

ওয়াজেদ হীরা ॥ শীতের সকাল ৯টা। রাজধানীবাসীর অনেকের ঘুম তখনও ভাঙ্গেনি। অথচ ঢাকার উপকণ্ঠ থেকে বিশেষ করে নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ কিংবা সাভার থেকে হাজারো নেতাকর্মী বহনকারী গাড়ি এসে পৌঁছেছে রাজধানীতে। গাড়ি থেকে নেমে ঢাকঢোল বাজিয়ে খ- খ- মিছিল নিয়ে উৎসবের আমেজে যাত্রা শুরু করল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পানে। শনিবার ছিল আওয়ামী লীগের বিজয় সমাবেশ। আর এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীর সমাবেশস্থলসহ আশপাশের বিভিন্ন জায়গা হয়ে উঠলো উৎসব স্থল। লাখো মানুষের ¯্রােতে গোটা রাজধানী হয়ে গেল উৎসবের নগরী। বাংলামোটর, শাহবাগ, কাকরাইল, মৎস্যভবন, পল্টন, গুলিস্তান, নিলক্ষেতসহ অন্যান্য জায়গা ঘুরে দেখা গেছে মানুষের উৎসবমুখর যাত্রার দৃশ্য। আর সব পথ যেন এসে মিলল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। যেখানে অনুষ্ঠিত হলো আওয়ামী লীগের বিজয় সমাবেশ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভে আওয়াামী লীগের পক্ষ থেকে বিজয় সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী আসেন বিকেল তিনটায়। এর অনেক আগে থেকেই গানে গানে সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। আর দূর-দূরান্ত থেকে নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ যানজট এড়াতে সকালেই এসে পৌঁছান রাজধানীতে। আর বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরাও বেলা ১১টার মধ্যেই চলে আসেন শাহবাগ এলাকায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লালো মানুষের পদচারণায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশ হয়ে উঠে মানুষের মিলনমেলা। লাখো নবীন-প্রবীণদের একাত্মতা জানান দিল শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা অসাধারণ এবং তিনি এক অন্যান্য নেতা। নরসিংদীর পলাশ থেকে আসা ষাটোর্ধ বয়সী হাফিজুর রহমান বলেন, ফজরের নামাজের পরপরই বের হয়েছি। গাড়িতে এসেছি যানজট পাই নাই। শেখের বেটিরে একবার দেখতে এলাম। বয়স হইছে যদি আর না দেখতে পাই। বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে, নেতাকর্মীরা গাড়ি থেকে নেমে সমাবেশস্থল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে থেমে থেকে গান, আড্ডা, খাবার, স্লোগান কিংবা সেলফি সবই করছেন। উৎসবের রঙ ছড়ালো পথে পথেই। সমাবেশস্থল থেকে গোটা রাজধানী বিজয়ে আনন্দে মানুষের ¯্রােতে মিলেমিশে একাকার। অধিক মানুষের কারণে রাজধানীতেও গণপরিবহন অনেকটা কম ছিল। এদিকে লাখো মানুষের সমাগমে নানা রঙের ব্যানার-ফেস্টুন, জাতীয় পতাকা, দলীয় পতাকা, নৌকা, বাদ্য যন্ত্র এবং স্লোগানে মুখর হয়ে উঠে আশপাশের এলাকা। উদ্যানে প্রবশের গেট খোলার পর বেলা ১২টা থেকে নেতাকর্মীরা প্রুবেশ করতে শুরু করেন। যারা উদ্যানে প্রবেশ করতে পারেনি তারা আশপাশের রাস্তায় বা আইলেনের ওপর বসে যান। মাইক থেকে প্রচার করা বক্তব্য কিংবা গান শুনেন উদ্যানের বাইরে থেকেই। নেতাকর্মীদের বড় অংশ তরুণ-তরুণী। যারা বর্তমান সরকার প্রধানকে অসাধারণ নেতৃত্ব গুণ হিসেবেই দেখছেন। তরুণদের মতে প্রধানমন্ত্রীর দেশ পরিচালনা করা এবং নেতৃত্ব গুণ অসাধারণ। টঙ্গি থেকে আসা সোরহাব ও তার একাধিক বন্ধুরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের জন্য এতো দ্রুত আমরা উন্নয়ন করতে পারছি। বিশে^র নেতারা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রশংসা করে যা এই দেশের মানুষ হিসেবে আমি গর্ব করি। উদ্যান এলাকায় দেখা যায়, নেতাকর্মীদের মধ্যে নারীদের পরনে লাল ও সবুজ রঙের শাড়ি এবং ছেলেদের বেশিরভাগ লাল ও সবুজ রঙের গেঞ্জি ও টুপি পরে সমাবেশে যাচ্ছেন। কেউ কেউ সাদা ও হলুদ রঙে টি শার্টও পরিধান করেছেন। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বিজয়ের এ দিনে মুজিব তোমায় মনে পড়ে’, ‘বারবার দরকার শেখ হাসিনার সরকার’, ‘যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনা’ ইত্যাদি স্লোগান দিচ্ছিলেন। সমাবেশেকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে নানা ধরনের সাজসজ্জা করা হয়েছে। মাঠ পরিষ্কার, খাবার পানি, পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও করা হয়। বিভিন্ন নেতা দলীয় কর্মীদের জন্য খোলা ট্রাকে করে বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করেন। এছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে নানা স্লোগান সংবলিত ব্যানার দেখা গেছে। যেখানে স্থান পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর ছবি। ছবির নিচে লেখা রয়েছে ‘তারুণ্যের বাংলাদেশ’, ‘গ্রাম হবে শহর’, ‘নারীর অগ্রযাত্রা’, ‘মানসম্মত শিক্ষা’, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা’, ‘শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই হবে সমৃদ্ধ’ ইত্যাদি কথা শোভা পাচ্ছে ব্যানারগুলোতে। সমাবেশে যোগ দেয়া বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থী আফসানা হুমায়রা বলেন, আজকের আধুনিক বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে শেখ হাসিনা। নারী ক্ষমতায়ন থেকে শুরু করে আধুনিক দেশ গড়তে প্রতন্ত্য অঞ্চলেও পৌঁছে দিয়েছেন নানা ধরনের সেবা। আমরা শেখ হাসিনাকে ভালবাসি তাঁর নেতৃত্বকে ভালবাসি। সমাবেশস্থল থেকে আশপাশ এলকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উচ্ছাস। রমনা, মতিঝিল, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শত শত গণপরিবহন দাঁড়ানো অবস্থায় ছিল। বাস সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের কেউ গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ কিংবা ঢাকার ভেতর থেকেই এসেছেন। প্রত্যেক গাড়িতেই অংসখ্য মানুষ এসেছে বলে বাস সংশ্লিষ্টরা জানান। সমাবেশস্থল থেকে একটু দূরে গাড়ি রাখার জন্য স্থান নির্বাচন করে দেয় ডিএমপি। নির্দেশনা অনুসারে বাস থেকে নেমে নেচে গেয়ে কিংবা স্লোগানের তালে তালে সমাবেশস্থলে আসতে দেখা যায় হাজার হাজার নেতাকর্মীদের। শাহবাগ এলকায় খোলা গাড়িতে করে সঙ্গিত পরিবেশন করতে দেখা গেলো। ইস্কাটন বিটিসিএল ভবনের সামনে কয়েক হাজার নেতাকর্মী গান আর দুপুরের খাওয়ার দৃশ্য দেখা গেল। শিল্পকলা একাডেমির সামনেও হাজারো মানুষ। একজন গান গাচ্ছে সবাই শুনছে। জানতে চাইলে এহসান নামের এক যুবক বলেন, সমাবেশ শুরু হতে অনেক বাকি তাই আমরা এখানে নিজেদের মতো উৎসব করছি। ঢাকা মগানগরে বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ডের বিভিন্ন ইউনিটের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, শ্রমিক লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকরা যোগ দেন বিজয় সমাবেশে। এর সঙ্গে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকেও আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা সমাবেশে যোগ দেন। ফলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশের আনন্দ আর মানুষের ¯্রােত ছড়িয়ে যায় গোটা শহরেই। দলীয় নেতাকর্মীরা দলের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে আসলেও সাধারণ মানুষ বেশির ভাগ এসেছেন শেখ হাসিনাকে ভালবেসে বা তাকে এক নজর দেখতে। এই সমাবেশে এসে কেউ নিজেকে সৌভাগ্যবানও মনে করছেন। সাভার থেকে আগত হাবিবুর রহমান পিপলু জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের প্রিয় নেত্রীকে এক নজর দেখতে এসেছি। তার কাজ ভাল লাগে। সকাল ৭টায় তারা রওনা হয়ে ৯টার মধ্যে এসে পৌঁছেছেন বলেও জানান। বিকেল তিনটার দিকে যখন প্রধানমন্ত্রী সবাবেশস্থলে আসেন তখনও হাজার হাজার মানুষ উদ্যানের বাইরেই ছিলেন। জায়গার স্বল্পতার প্রবেশ না করে উদ্যানের বাইরে বক্তব্য শোনার অপেক্ষা করছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে আসন গ্রহণ করার পর গান গাইছিলেন শিল্পী ও এমপি মমতাজ বেগম। মাইকে সেই গান ভেসে আসছিল। সবাই কান পেতে শুনছিলেন ‘বাড়ি বাড়ি মিষ্টি বিলায় মিয়া ভাইয়ের শালা, সব নেতার চাইতে আমার শেখ হাসিনা ভালা। সব মার্কার চেয়ে আমার নৌকা মার্কা ভালা।’ এ সময় মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম হোসেন বলেন, আমি সকালে এসেছি ভিতরে অনেক মানুষ। তাই একটু বিশ্রাম নিতে বাইরে এসে পরেছি। তবে নেত্রীর বক্তব্য শুনব বলে অপেক্ষা করছি। পাশে দাঁড়ানো কতিপয় যুবক এসেছেন গাজীপুর থেকে। তারা জানান, আমাদের অনেকেই ভেতরে প্রবেশ করেছে আমরা যেতে পারি নাই। এখানেই দাঁড়িয়ে শুনছি। হাজার হাজার মানুষকে দেখা যায় বাইরে দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুনতে। এদিকে এমন অনুষ্ঠানের কারণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাজ সাজ রব থাকলেও নিরাপত্তারও কমতি ছিল না। লাখো মানুষকে সামলাতে নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা বলয়। ঐতিহাসিক এই উদযাপনকে নির্বিঘœ করতে এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা বলয় তেরি করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বাড়তি পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য মোতায়েনের পাশাপাশি সাদা পোশাকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। সরেজমিন দেখা গেছে, শাহবাগ, মৎস্যভবন, হাইকোর্টের সামনের এলাকা, দোয়েল চত্বর, টিএসসি এলাকাসহ উদ্যানের চারপাশে বাড়তি পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা নিয়োজিত রয়েছেন। প্রস্তুত রাখা হয়েছে পুলিশের সাঁজোয়া যান, জলকামান ও প্রিজন ভ্যান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিটি প্রবেশ পথে সতর্ক অবস্থায় দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের। এছাড়া প্রতিটি প্রবেশপথে বসানো হয়েছে আর্চওয়ে, যার মধ্য দিয়ে সবাইকে উদ্যানের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বিপুল সংখ্যক র‌্যাব-পুলিশ মোতায়েনসহ প্রস্তুত রয়েছে পুলিশের বিশেষায়িত সব টিম। পুরো এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে। নেতাকর্মীদের প্রবেশের সময় আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেক্টর ও এনালগ তল্লাশির মধ্য দিয়ে সভাস্থলে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। আর সবাবেশ শেষ হওয়ার পর দলে দলে মিছিল নিয়ে কেউবা হেঁটে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে পা বাড়ান। যারা দূর দূরান্তÍ থেকে এসেছেন তাদের জন্য নির্ধারিত গাড়ির জায়গায় সমবেত হন। জনসভার কারণে বেলা ১১টা থেকে শাহবাগের রূপসী বাংলা সিগন্যাল, কাঁটাবন মার্কেট মোড়, নীলক্ষেত মোড়, চানখাঁরপুল, জিপিও ও মৎস্য ভবন মোড় থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানমুখী সব রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৫৭টি আসনে জয় নিয়ে টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা চতুর্থ বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। ভোটের ১৯ দিন পর এই বিজয় উৎসব পালন করলো আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের এই বিজয় সমাবেশে আগত মানুষের ¯্রােত জানিয়ে দিলো দল হিসেবে তো বটেই দেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তার বিকল্প নেই। একাদশ নির্বাচনে গণমানুষের রায় আর সমাবেশে আসা লাখো মানুষের চিত্র সেকথাই বলে দিচ্ছে বার বার। শেখ হাসিনা এমন একটি নাম যিনি দক্ষতা আর যোগ্যতা দিয়ে বাংলার মানুষের মন জয় করে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সমৃদ্ধ দেশ গড়ার।
×