ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দল পুনর্গঠনের দাবি

ফখরুলকে সরাতে সিনিয়র নেতারা একাট্টা ॥ বিএনপির কোন্দল তুঙ্গে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২০ জানুয়ারি ২০১৯

ফখরুলকে সরাতে সিনিয়র নেতারা একাট্টা ॥ বিএনপির কোন্দল তুঙ্গে

শরীফুল ইসলাম ॥ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপির অন্তর্কোন্দল তুঙ্গে। নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য এখন দলীয় নেতারা পরস্পরকে দোষারোপ করছেন। যে কোন সময় এ কোন্দলের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। কোন্দলের অংশ হিসেবে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে একটি বড় অংশ একাট্টা হয়েছে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে এ পদ থেকে সরিয়ে দিতে। তবে মির্জা ফখরুলও তার পক্ষের নেতাদের নিয়ে কৌশলে অন্যপক্ষের নেতাদের মোকাবেলা করে দলে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে চাচ্ছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সম্প্রতি অন্তত তিনটি বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে ক’জন নেতা শোচনীয় পরাজয়ের বিষয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কৌশলে ভুল ছিল বলে অভিযোগ করেন। অপরদিকে মির্জা ফখরুলের পক্ষের নেতারাও এ জন্য অন্যপক্ষের নেতাদের পাল্টা দায়ী করে বলেন, কোথায় ভুল হচ্ছে সে কথা নির্বাচনের আগে না বলে এখন কেন বলা হচ্ছে। এ নিয়ে দুই পক্ষের নেতাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়। সূত্র মতে, ২০১৬ সালের জাতীয় কাউন্সিলের পর মির্জা ফখরুল ইসলামকে মহাসচিব করার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি দলের অনেক সিনিয়র নেতা। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময়ই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে পছন্দ করেন না দলের এমন নেতারা বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেননি। মির্জা ফখরুল কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত তারেক রহমানকে কৌশলে ম্যানেজ করে ২০ দলীয় জোট রেখেই নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করায় অন্যপক্ষের নেতারা প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেননি। তবে তাদের মধ্যে তখন থেকেই চাপা ক্ষোভ বিরাজ করে। নির্বাচনের পর আস্তে আস্তে এ ক্ষোভ বাড়তে থাকে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনগুলোতে দলীয় মনোনয়নের সময় সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কারণে দলের সিনিয়র নেতারা প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। হাইকমান্ডের নাম ভাঙ্গিয়ে দলে যে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে তার সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তার ক’জন অনুসারী জড়িত বলেও তারা মনে করেছেন। বিশেষ করে নির্বাচনের দু’একদিন আগেই যখন বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী সার্বিক পরিস্থিতি চরম বৈরী বলে মনে হয়েছে তখনই মির্জা ফখরুলকে বলা হয়েছিল নির্বাচনের দিন হলেও যেন বর্জনের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু মির্জা ফখরুল নিজে বিজয়ী হবেন এমন সম্ভাবনা থাকায় হাইকমান্ডকে বুঝিয়ে নির্বাচন বর্জনের বিপক্ষে অবস্থান করেন। এ ক্ষেত্রে ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনকেও কাজে লাগান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। কিন্তু নির্বাচনে মির্জা ফখরুল ছাড়া সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আর কেউ বিজয়ী না হওয়ায় তারা চরম ক্ষুব্ধ হন। এছাড়া বিএনপি থেকে যে ছয়জন নির্বাচিত হয়েছেন তারা যেন সংসদে না যান সে জন্য চাপ দিতে থাকেন। এ কারণেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত ছয়জন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেননি। এদিকে মির্জা ফখরুলসহ দলের কিছু নেতার ওপর ক্ষোভ থাকায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা নির্বাচনের পর থেকে দলীয় কর্মকা-ে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকেন। আর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শুক্রবার বিএনপি আয়োজিত জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীর আলোচনা সভায় গিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলের বর্তমান কমিটির প্রতি ক্ষোভ ঝেড়ে দলে অন্তর্কোন্দলের বিষয়টি প্রকাশ করেন। তারা জাতীয় কাউন্সিল ডেকে দলের নতুন কমিটি গঠন ও নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেন। তারা নেতৃত্ব পরিবর্তন বলে মূলত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে নিজেদের মধ্য থেকে কাউকে এ পদে বসানোর ইঙ্গিত করেছেন বলেই বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। তুলনামূলকভাবে ত্যাগী, যারা পরীক্ষিত নেতাকর্মী, তাদেরকে নেতৃত্বে আনতে হবে। আমরা যারা ব্যর্থ বলে পরিচিত হয়েছি, আমাদের পদ ছেড়ে দিতে হবে। তাহলেই বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি আরও বলেন, যারা সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন তাদের নিজ নিজ এলাকার নেতাকর্মীদের মামলা থেকে পরিত্রাণ করা ও জেল থেকে মুক্ত করাতে হবে। যেসব এলাকায় আমাদের প্রার্থী ছিল না সেখানে দলের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন করতে হবে। কাউন্সিলের মাধ্যমে পরীক্ষিতদের দলের সামনে আনতে হবে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, যারা এই দুঃসময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যারা দলের জন্য কাজ করেছেন, তাদের সামনের দিকে এনে দল পুনর্গঠন করতে হবে। দরকার হলে আমরা যারা, আমাদের বয়স হয়ে গেছে, আমরা সরে যাব। তারপরেও এই দলটাকে তো রাখতে হবে। এর একমাত্র উপায় হলো দল পুনর্গঠন করা। এই কাজ আমাদের কয়েক মাসের মধ্যেই করতে হবে। তাহলেই আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব। এদিকে মির্জা ফখরুল বিরোধী বিএনপির দুই সিনিয়র নেতার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মহাসচিব পন্থী নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগে গাছাড়া ভাব দেখিয়ে এখন পরাজিত হয়ে তারা সব দোষ মির্জা ফখরুলের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। মির্জা ফখরুল তো কোন কাজ তাদের আড়াল করে করেননি। সবকিছু দলীয় ফোরামে এবং খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশেই করেছেন। এখন তারা মির্জা ফখরুলকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে নিজেরা এ পদে আসতে উদ্দেশ্যমূলক কথাবার্তা বলছেন। আর এর মাধ্যমে তারা দলে অনৈক্য সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। তবে দলীয় হাইকমান্ড সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা নিশ্চয়ই সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। জানা যায়, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের একটি অংশ চায় দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে আগের জাতীয় কাউন্সিলের ৩ বছর পর এ বছর মার্চ মাসের মধ্যে পরবর্তী কাউন্সিল করে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন করতে। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল হয়েছিল। সে হিসেবে মার্চের ১৮ তারিখই ৩ বছর সময় পার হয়ে যাবে। এবার জাতীয় কাউন্সিল হলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করবেন কয়েকজন নেতা। এদের মধ্যে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ ক’জন সিনিয়র নেতা। সূত্র মতে, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় দলের গঠনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমান লন্ডনে বসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের বিষয়টিকেও দলের কিছু সিনিয়র নেতা ভাল চোখে দেখছেন না। কারণ, খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার আগে সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরাই দলীয় সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। কিন্তু খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার একদিনের মাথায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা করে দিলেন তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং তার নির্দেশেই দলে সবকিছু হবে। এর পর থেকে মির্জা ফখরুল ও তারেক রহমানই সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারী নেতাদের সাক্ষাতকারও নেন তারেক রহমান নিজে, লন্ডনে বসে স্কাইপিতে। এমনকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেন। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, একটি বড় রাজনৈতিক দলে কখনও কখনও দলীয় কোন কর্মকা- নিয়ে ভিন্নমত দেখা দিতেই পারে। তবে নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে বর্তমান নেতৃত্বের ব্যর্থতা ছিল কি না তা সময়ই বলে দেবে। আর দল পরিচালনায় কারও কোন ভুলত্রুটি থাকলে বিএনপি হাইকমান্ডের চোখে তা ধরা পড়বে। তবে দল পুনর্গঠনের যে কথা সিনিয়র নেতারা বলেছেন তা তো চলমান প্রক্রিয়া। দল পুনর্গঠন ও নেতৃত্ব পরিবর্তন রাজনীতিতে স্বাভাবিক নিয়ম।
×