ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপাদন ও রফতানিতে এক অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ২০ জানুয়ারি ২০১৯

উৎপাদন ও রফতানিতে এক অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ

ডব্লিউটিওর হিসাব মতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে গত ছয় মাসে ২০ দশমিক ৫০ বিলিয়িন ডলারের পণ্য রফতানি করা হয়েছে। রফতানি প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ৪৪ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে সরকার। সব মিলিয়ে রফতানিতে বাংলাদেশ দিন দিন দারুণ উন্নতি করে চলেছে। অন্যদিকে আমাদের পূর্বসূরি দুটো দেশ ভারত ও পাকিস্তানের দিকে যদি দেখি তাহলে তাদের তুলনায় বাংলাদেশ রফতানি আয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। পাকিস্তান গত অর্থবছরে মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলার রফতানি করেছে। শুধু আয়তনের দিক থেকে যদি দেখি পাকিস্তান বাংলাদেশের থেকে প্রায় ছয়গুণ বড় একটি রাষ্ট্র। বাংলাদেশের যে রফতানি আয় সেটির সমান হতে হলে পাকিস্তানের রফতানি আয় হতে হতো ২১৬ বিলিয়ন ডলার। সহজেই অনুমান করা যায় পাকিস্তানের অবস্থান কোথায়? অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনে প্রায় বাইশগুণ বড় একটি রাষ্ট্র। গত অর্থবছরে ভারতের রফতানি আয় ২৯৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের এই রফতানি অনেক কম। আয়তনের দিক থেকে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের সমান রফতানি আয় করতে হলে ভারতের রফতানি আয় হওয়ার কথা ছিল ৮০৫ বিলিয়ন ডলার। শুধুমাত্র রফতানির পরিসংখ্যান দিয়েই যদি বিচার করি তাহলে এক সময়ের ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অংশ পূর্ব বাংলা যেটি আজকের বাংলাদেশ সেটি পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেকদূর এগিয়ে গেছে এ কথা গর্বের সঙ্গেই উচ্চারণ করা যায়। সস্তা শ্রম, উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা এবং সরকারী সহায়তায় প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রফতানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। চীনের পরেই বিশ্বের দ্বিতীয় তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মোট পণ্য রফতানিতে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ৮৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অবশিষ্ট সকল খাত মিলিয়ে রফতানি হয়েছে ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। নানামুখী তৎপরতায় তৈরি পোশাক খাতকে আমরা রফতানির অন্যতম শীর্ষ দেশের তালিকায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের রফতানিযোগ্য আরও অনেক পণ্য রয়েছে। যেমন পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষিজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, হিমায়িত চিংড়ি, প্রকৌশল পণ্য এবং ওষুধ রফতানিতেও আমরা একটি শীর্ষ স্থান দখল করতে পারি। যদিও এ পণ্যগুলোও রফতানি হচ্ছে এবং প্রতিবছরই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। কিন্তু এ প্রবৃদ্ধির হার তৈরি পোশাক খাতের মতো নয়। এ খাত যেভাবে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে তেমনি উন্নত বাংলাদেশের স্বার্থে অন্যান্য খাতকেও এগিয়ে নিতে হবে আমাদেরই প্রয়োজনে। উল্লেখিত খাতগুলো ছাড়াও আরও অনেক খাত আছে যেগুলো বিশ্ব মার্কেটে অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে। সে সমস্ত খাতগুলো নিয়ে বিশ্ব মার্কেট এবং বিশ্বমানের পণ্যের গুণগত মান নিয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। কারণ আমরা আজকে এমন একটি জায়গায় পৌঁছে গেছি যে বিশেষ করে মৎস্য, প্রাণিসম্পদ এবং কৃষি পণ্যে আমরা নিজেদের চাহিদা নিজেরাই মিটাতে সক্ষম হয়ে উঠেছি এবং অনেক ক্ষেত্রে উৎবৃত্ত হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের যে পরিমাণ উৎপাদন বিপ্লব ঘটছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ব মার্কেটিংএ বিপ্লবও ঘটাতে হবে। জাতিসংঘের সংস্থা এফএও-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালে অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। চীন ও ভারতের পরেই এখন বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশ বিশ্বের ৪র্থ চাল উৎপাদনকারী দেশ। স্বাধীনতার পর দেশে যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হতো, এখন তার চেয়ে তিনগুণ বেশি হয়। দেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে গত একযুগে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্যমতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। বাংলাদেশের ব্লাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জীবনরহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে। পোল্ট্রি মুরগির মাংস এবং ডিম উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছি। বিগত কয়েক বছর যাবত গরুর মাংস উৎপাদনেও আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। ইতোমধ্যে প্রাণীর নতুন নতুন জাত সৃষ্টি হওয়ার কারণে গত কয়েক বছরে দেশের মাংস, দুধ, ডিমের মতো প্রাণিজ আমিষের উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ থেকে মাংস জাতীয় খাদ্য ব্যাপকভাবে রফতানি করা সম্ভব হবে। বিশ্বে মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। ফলটির উৎপাদনে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এক দশক আগেও আলুর উৎপাদন ছিল অর্ধ-লাখ টনের নিচে। এখন তা এগোচ্ছে কোটি টনের দিকে। এ সাফল্য বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে আলু উৎপাদনকারী শীর্ষ দশ দেশের কাতারে। ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) বেশ কয়েকটি জাত ছাড়াও এরই মধ্যে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে। এক কথায় আমরা বলতে পারি যে বাংলাদেশ একটি উৎপাদন বিস্ময় রাষ্ট্র। যে হারে উৎপাদন বাড়ছে সে হারে এই পণ্যগুলো বিশ্ব মার্কেটে পৌঁছানো অত্যন্ত জরুরী। বিশ্ব মার্কেটে পণ্যগুলো পৌঁছাতে পারলে উৎপাদকরা পণ্যের সঠিক দাম পাবে এবং আরও বেশি উৎপাদনে আকৃষ্ট হবে। এর ফলে আমরা কাক্সিক্ষত সময়ের আগেই স্বপ্নের উন্নত বাংলাদেশে পৌঁছে যেতে সক্ষম হব। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর সবচেয়ে বেশি তাচ্ছিল্য করা এক ব্যক্তির নাম বার বার চলে আসে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে তুচ্ছ করে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ উপমায় ভূষিত করেছিলেন। কারণ হেনরি কিসিঞ্জারের দিক নির্দেশনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেননি। আজ ৯৫ বছর বয়সেও তিনি বেঁচে আছেন। জানি না তিনি বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের খোঁজখবর রাখেন কি-না। তাকে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, কিসিঞ্জার দেখে যাও তোমার তাচ্ছিল্যের বাংলাদেশ তলাবিহীন নয় বরং তলা তো আছেই এবং সেইসঙ্গে উন্নয়নে উপচেপড়া ঝুড়ির একটি দেশে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে এসে আমরা বলতেই পারি বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে এক উন্নয়ন বিস্ময়ের নাম। সীমাহীন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিশেষ করে গত দশ বছরে নানামুখী ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বিস্ময়কর এবং বিরল নেতৃত্বে দেশের স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। আর এ কারণে সকল ক্ষেত্রে অগ্রগতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
×