ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রফতানির তালিকায় বরিশালের বোম্বাই মরিচ

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২০ জানুয়ারি ২০১৯

রফতানির তালিকায় বরিশালের বোম্বাই মরিচ

বোম্বাই মরিচ একেবারেই গ্রামীণ কৃষিপণ্য। যারা খাবারে বিশেষ করে ভাতের তরকারির সঙ্গে একটু বেশি ঝাল পছন্দ করে, তাদের জন্য বোম্বাই মরিচ লাগসই খাদ্য উপাদান। আবহমান কাল থেকে বরিশাল অঞ্চলে এটি উৎপন্ন হয়ে আসছে। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ তাদের বাড়ির উঠোনে কিংবা মাটির ভিটির উঁচু জায়গায় বোম্বাই মরিচের গাছ লাগিয়ে থাকে। প্রায় সারা বছর এতে ফলন আসে। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে কিছু অংশ হাটবাজারেও চলে যায়। অনেকটা অনাদর-অবহেলায় বেড়ে ওঠা বোম্বাই মরিচের সেদিন আর নেই। বরিশাল অঞ্চলের বোম্বাই মরিচ এখন রফতানির তালিকায় চলে এসেছে। প্রতিবছর কেবলমাত্র বরিশাল অঞ্চলেই এ পণ্যটি রফতানি করে আসছে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। এটি রূপ নিয়েছে বাণিজ্যিক চাষে। স্থানীয়ভাবে যেমন একের পর এক তৈরি হচ্ছে বোম্বাই মরিচের খামার, বাড়ছে চাষ। তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছে। এর ফলে হাজারও চাষী বোম্বাই মরিচ চাষে অর্থনৈতিকভাবে হচ্ছে লাভবান। যা আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা মজবুত হতে সহায়তা করছে। দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো জেলাতেই বোম্বাই মরিচের কমবেশি চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলায়। এগুলোতে রীতিমতো বাণিজ্যিকভিত্তিতে বোম্বাই মরিচের চাষ হচ্ছে। এসব অঞ্চল থেকে ২০১১ সালে প্রথম জাপানে মরিচ রফতানি শুরু হয়। জাপানের পরে আরও একাধিক দেশ এতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এরপর থেকে ক্রমে রফতানির পরিমাণ যেমন বাড়ছে, তেমনি চাষও সম্প্রসারিত হচ্ছে। গত বছর পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার কুড়িয়ানায় ৩২৫ একর, ঝালকাঠির কয়েকটি গ্রামে ৩৭৫ একর এবং বরিশালের বানারীপাড়ায় ১০০ একর জমিতে বাণিজ্যিকভিত্তিতে বোম্বাই মরিচের চাষ হয়েছে। এবছর চাষের জমির পরিমাণ নিঃসন্দেহে আরও বেড়েছে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী প্রতি একর জমিতে চার থেকে সাড়ে চার হাজার মরিচের চারা লাগানো হয়। প্রতিটি গাছে মৌসুমে দেড় থেকে আড়াই শ’ মরিচ পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে প্রতিটি মরিচ ৩০ থেকে ৫০ পয়সায় বিক্রি হয়। প্রতি একর জমিতে গড়ে দুই লাখ টাকার মরিচ উৎপন্ন হয়। যার প্রায় চার ভাগের তিন ভাগই মুনাফা। ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস বোম্বাই মরিচের প্রধান মৌসুম হলেও সারা বছর কমবেশি এতে ফলন আসে। আর মৌসুমের বাইরে মরিচের দাম অনেক বেড়ে যায়। তখন প্রতিটি মরিচ এক-দেড় টাকাও বিক্রি হয়। বোম্বাই মরিচের মধ্যে লতা, সাদা, কালো, ঢোলশাই, ঘৃতকুমারী জাতের চাহিদা অন্যগুলোর তুলনায় একটু বেশি। বর্তমানে এসব অঞ্চলে পাঁচ হাজারেরও বেশি পরিবার বোম্বাই মরিচ চাষের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এর সংখ্যাও ক্রমে বাড়ছে। বোম্বাই মরিচের চাষ বাণিজ্যিক রূপ নেয়ায় স্থানীয়ভাবে যেমন নতুন নতুন বাজার গড়ে উঠেছে। তেমনি আড়তদার, মহাজনসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সম্পৃক্ততাও বেড়েছে। স্বরূপকাঠি উপজেলার কুড়িয়ানার জিন্দাকাঠি কালীমন্দির বাজার বোম্বাই মরিচ কেনাবেচার সবচেয়ে বড় মোকাম। অন্যান্য অঞ্চল থেকেও চাষীরা এখানে মরিচ নিয়ে আসে। সপ্তাহের সোম ও শুক্রবার এখানে সাপ্তাহিক হাট বসে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাট জমজমাট থাকে। প্রতি হাটে অন্তত ১৫-২০ লাখ টাকার মরিচ বেচাকেনা হয়। আড়তদারদের মাধ্যমে ভাল মরিচ রফতানির জন্য কেনা হয়। অন্য মরিচ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। বাংলা এ্যাগ্রো নামের একটি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান জাপানের ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী চাষীদের কাছ থেকে বোম্বাই মরিচ সংগ্রহ করে এবং তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে তা শুকিয়ে গুঁড়া করে প্যাকেটজাত করা হয়। যা পরে রফতানি হয়। অন্যান্য দেশের মরিচের তুলনায় বরিশাল অঞ্চলের বোম্বাই মরিচে ঝাল ও সুগন্ধ থাকায় জাপানে এর চাহিদা ক্রমে বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে রফতানি। মালয়েশিয়াসহ আরও একাধিক দেশ বোম্বাই মরিচে এরইমধ্যে আগ্রহ দেখিয়েছে। যে কারণে এর বাজার আরও সম্প্রসারণের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারাও বলছেন, বোম্বাই মরিচ রফতানি ইতোমধ্যে শতকোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বরিশাল অঞ্চলের মাটি বোম্বাই মরিচ চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আন্তর্জাতিক বাজার আরও সম্প্রসারণ করা গেলে ভবিষ্যতে এটি হবে এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য রফতানি যোগ্য কৃষিপণ্য। তবে এজন্য কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আন্তরিক হতে হবে। বরিশাল অঞ্চলের সর্বত্র এর চাষ ছড়িয়ে দিতে হবে। চাষীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ব্যবসায়ীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। যা আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে আরও বেগবান করবে।
×