ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে চাই ॥ এটা সময়ের দাবি

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২১ জানুয়ারি ২০১৯

যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে চাই ॥ এটা সময়ের দাবি

হিন্দী ভাষায় একটি চলতি প্রবাদ আছে- ‘বাপ কা বেটা, সিপাই কা ঘোড়া।’ গত ১৭ জানুয়ারি এই প্রবাদ বাক্যটি বেশি করে মনে পড়ল যখন শুনলাম আমাদের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এমপি ঘোষণা দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের সব সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াফত করা হবে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এখন প্রক্রিয়াধীন। মন্ত্রী মহোদয়ের এই বহুল প্রত্যাশিত ঘোষণা নিশ্চিতভাবে সাধুবাদ এবং অকুণ্ঠ প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। আনিসুল হক বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রয়াত সিনিয়র এ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের পুত্র। এ্যাডভোকেট সিরাজুল হক শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিই অবিচল ছিলেন না, বঙ্গবন্ধুর প্রতিও তাঁর ছিল অবিমিশ্র আনুগত্য এবং শ্রদ্ধাবোধ। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জিয়া-মোশতাকের চক্রান্তের দ্বারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে প্রথম ওই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন তার নাম এ্যাডভোকেট সিরাজুল হক। পরবর্তী সময় তিনি বিচারিক আদালত থেকে হাইকোর্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় প্রধান প্রসিকিউটরের দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে সমাপ্ত করেন। মামলাটি যখন হাইকোর্টে আসে তখন এই মামলার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি এ্যাটার্নি জেনারেল হিসেবে এ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের সান্নিধ্য পাওয়ার এবং তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রসিকিউশন টিমে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়ে বুঝতে পারলাম তিনি কত বড় মাপের একজন ফৌজদারি আইন বিশারদ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি তাঁর আনুগত্য কঠোর এবং অবারিত ছিল। মিন্টু রোডের একটি বাড়িতে উক্ত মামলা তৈরি করার জন্য দিনের পর দিন তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুবাদে জেনেছি বঙ্গবন্ধুর খুনীদের কত ঘৃণাভরে তিনি দেখতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা বলার সময় তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারতেন না। তাই তাঁর সুযোগ্য পুত্র এ্যাডভোকেট আনিসুল হকের উপরোক্ত ঘোষণা ছিল প্রত্যাশিত এবং সময়ের ব্যাপার মাত্র। ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বহুদিন থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের সব স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফতের দাবি জানিয়ে আসছে। এই সংস্থার একজন উপদেষ্টা হিসেবে আমি, সংস্থার সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সহ-সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন প্রমুখ বহুবার এ্যাডভোকেট আনিসুল হকের সঙ্গে সাক্ষাত করে সম্পদ বাজেয়াফত করার দাবি জানালে তিনি বরাবরই আমাদের এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, যথাসময়েই তিনি এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন। তিনি তার প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন যেনে আমরা যার পর নেই আনন্দিত। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সঙ্গেও বহুবার দেখা করলে তিনিও একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে আইনটি প্রণীত হয় সেটি ছিল বিশ্বে এ ধরনের প্রথম আইন, যা প্রায় হুবহু অনুসরণ করা হয়েছে রোম স্টেচুট প্রণয়নে, যার দ্বারা জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা পায় ২০০২ সালে। জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রুয়ান্ডা, যুগোস্লাভিয়া, কম্বোডিয়া প্রমুখ অস্থায়ী যুদ্ধাপরাধী আদালতেও আমাদের ’৭৩-এর বিধানসমূহ অনুসরণ করা হয়। ’৭৩-এর আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এবং সর্বোচ্চ সাজাসহ অন্যান্য শাস্তির বিধান থাকলেও অপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াফতের বিধান ছিল না। সম্ভবত এই কারণে সেই সময় যুদ্ধাপরাধীরা সম্পদশালী হতে পারেনি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পরেই সাকা চৌধুরী, মীর কাসেম আলী, সাঈদী, কাদের মোল্লা, কামরুজ্জামান, গোলাম আযম, নিজামীসহ সব যুদ্ধাপরাধীকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন সম্পদের পাহাড় গড়ার। মীর কাসেম আলী এবং সাকা প্রমুখ যুদ্ধাপরাধী জিয়াউর রহমানের বদৌলতে দেশের অন্যতম সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। তাদের সম্পদ দিয়েই যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধের জন্য আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে নাশকতা এবং জঙ্গী কার্যক্রম চালাতেও তাদের অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের অর্থ ব্যয় করা হয়েছে ২০১৪ সালে পেট্রোলবোমা দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও ধ্বংসযজ্ঞে। যার ফলে নিঃশেষিত হয়েছে বহু নিরাপরাধ প্রাণ, চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়েছে শত শত মানব সন্তান। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। এখনও তাদের অর্থে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র চলছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার জন্য। যার নেতৃত্বে রয়েছে তারেক জিয়া, ব্যারিস্টার রাজ্জাক, বিচারপতি সিনহা প্রমুখ। আমাদের গণপ্রতিনিধিরা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ১৯৭৩ সালেই প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ৪৭-ক অনুচ্ছেদ সন্নিবিষ্ট করেন। এই পরিবর্তনের ফলে যুদ্ধাপরাধীরা অনেক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। সংবিধানের ৪৭-ক অনুচ্ছেদে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসমূহ যুদ্ধাপরাধীরা প্রয়োগ করতে পারবে না। এর ফলে যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াফত করলেও তারা বা তাদের উত্তরসূরিরা হাইকোর্টে রিট করতে পারবে না। তবে আমাদের উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে সঙ্গে সঙ্গেই তার ওয়ারিশরা মৃত ব্যক্তির সম্পদের মালিক হয়ে যায়। সে অর্থে যেসব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে তাদের ওয়ারিশরা অপরাধীদের সম্পদের মালিক হয়ে গেছে। তাই নতুন আইনটি করতে হবে ভূতাপেক্ষিক প্রয়োগ দিয়ে, যাকে আইনের ভাষায় বলে Retrospective effect, যাতে এমনটি হয় যে, ফাঁসিতে ঝোলার আগেই তাদের সকল সম্পদ বাজেয়াফত হয়ে গেছে, যাতে উত্তরাধিকারের সুযোগ না থাকে। এ ছাড়াও যদি কোন ওয়ারিশ তাদের ফাঁসিতে ঝোলা পিতা/স্বামীর সম্পদ বিক্রি বা অন্য কোন পন্থায় এরই মধ্যে অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করে থাকে তাহলে সেই সকল হস্তান্তরকে বৈধতাহীন করার মতো বিধানও নতুন আইনে রাখতে হবে, যাতে করে সম্ভাব্য হস্তান্তরিত সম্পদও বাজেয়াফতে তালিকায় আনা যায়। আইন মন্ত্রণালয়ের অভিজ্ঞ এবং বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ নিশ্চয়ই এ বিষয়সমূহ অবগত রয়েছেন যথোপযুক্ত বিধান সন্নিবিষ্ট করার জন্য। আজও বহু মুক্তিযোদ্ধা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। নির্মূল কমিটির দাবি যুদ্ধাপরাধীদের বাজেয়াফত সম্পদ যেন তাদের এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। আমাদের সেই দাবি আজও আছে। আশা করি, মুুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বর্তমান সরকার সে দাবিটিও বিবেচনায় নেবে। যারা এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে এদেশের সম্পদ ভোগ করার কোন অধিকার তাদের নেই। একই কারণে নিষিদ্ধ এবং স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতের সব সম্পদও বাজেয়াফতের দাবি সকলের। মনে রাখতে হবে যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালই জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী দল বলে ঘোষণা করেছে। জামায়াতের অর্থবিত্ত যাতে সাম্প্রদায়িক হানাহানি, জঙ্গীবাদ এবং সন্ত্রাসমূলক কাজে এবং নির্বাচিত সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাতের পরিকল্পনায় ব্যয় করা না যায়, সে জন্য জামায়াতের সম্পদ বাজেয়াফত করাও অপরিহার্র্য। লেখক : আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি
×