ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সমাজের কালো ব্যাধি ॥ জঙ্গীবাদ মাদক ও দুর্নীতি

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২১ জানুয়ারি ২০১৯

সমাজের কালো ব্যাধি ॥ জঙ্গীবাদ মাদক ও দুর্নীতি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জঙ্গীবাদ ও মাদককে সমাজের ‘কালো ব্যাধি’ আখ্যায়িত করে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি যারা সুস্থ জীবনে ফিরতে চায়, তাদের জন্য সেই সুযোগও সৃষ্টি করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কক্সবাজারে পুলিশের তালিকাভুক্ত একদল মাদক চোরাকারবারির আত্মসমর্পণে সম্মত হওয়ার খবরের মধ্যেই সরকারপ্রধানের এমন বক্তব্য এলো। এছাড়া সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাড়ানো, আবাসনসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, দুর্নীতিও একটি কালো ব্যাধি। এটা সমাজের উন্নয়ন যথেষ্ট ব্যাহত করে। সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সড়কে যানজট কমাতে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের অর্থনীতি যত ভাল হচ্ছে, মানুষের সুযোগ-সুবিধাও বাড়ছে। গাড়ি কেনা ও মানুষের চলাচলও বাড়ছে। ট্রাফিক জ্যাম একটা বিরাট সমস্যা। এটাও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতর পরিদর্শনের অংশ হিসেবে রবিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশ দিয়েছেন। মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়ারও আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যেখানে একটা মাদকাসক্ত আছে, সে পরিবারের যে কী কষ্ট, সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। সে কারণে অভিযানটাকে আমাদের আরও ব্যাপকভাবে পরিচালনা করে যেতে হবে। এক্ষেত্রে মাদকাসক্তির খারাপ দিকটি মানুষের সামনে তুলে ধরে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং সমাজের সব স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে প্রচার চালানোর ওপর জোর দেন শেখ হাসিনা। অপরাধীরা কেন অপরাধে সম্পৃক্ত হয় সেটা খুঁজে বের করার নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, শুধু তাদের (অপরাধী) বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিলেই যে তারা ভাল হয়ে যাবে তা না। বরং তাদেরকে সমাজের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারাটাও কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনের জল ও বনদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা এবং সরকারের তরফ থেকে তাদের পুনর্বাসনে সহায়তা করার কথাও প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে তুলে ধরেন। গতবছর মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজন মাদক কারবারিদের হতাহতের খবর এসেছে। তবে মাদক কারবারিদের তৎপরতা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। এই অবস্থায় নতুন বছরের শুরুতে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়। পরে কক্সবাজারের চিহ্নিত মাদক পাচারকারীর একটি অংশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের আগ্রহ জানায়। আত্মসমর্পণে সম্মত শতাধিক তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে কক্সবাজার শহরের কোন এক স্থানে জড়ো হয়ে নিরাপত্তা হেফাজতে এসেছেন বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আগামী ৩০ জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সারা হতে পারে। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করলে অপরাধী আবার অপরাধের জীবনে ফিরে যায় মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের যে অভিযান, সেটা অব্যাহত থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে মাদকমুক্ত করা, মাদক কারা আনে, পাচারকারী, কারা সেবন করে তাদের বিরুদ্ধে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা সুস্থভাবে সমাজে ফিরে আসতে চাইবে, সংসারে ফিরে আসতে চাইবে, তাদেরও সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। মাদকাসক্তদের নিরাময়ের ব্যবস্থা করতে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সেবা বিস্তৃত করার নির্দেশ দেন সরকারপ্রধান। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতা সৃষ্টির নির্দেশ দেন। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও মাদককে সমাজের ‘কালো ব্যাধি’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সব সময় এটাই চাই, এই সমস্ত কালো ব্যাধি থেকে সমাজকে মুক্ত করা। তার জন্য যা যা করণীয় সেটা আমাদেরকে করতে হবে। কারণ একটা দেশকে যদি আমরা উন্নত করতে চাই, তাহলে এই সমস্ত মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও দুর্নীতির হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমি মনে করি এই মন্ত্রণালয়ে যারা কাজ করে সবাইকে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গীবিরোধী অভিযানের মধ্যেই স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিভাবক, ইমাম, ধর্মগুরুসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী- পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হয়। সেই প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাইকে এক করে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই কিন্তু এই জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হয়ে গেছে। এই বিষয়গুলো আমার মনে হয় অব্যাহত রাখতে হবে। জঙ্গীবাদকে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে বর্ণনা করে এত ঘন বসতির দেশেও দক্ষতার সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে তিনি ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এটা খুব একটা কঠিন কাজ এবং সেটা আমরা করতে পেরেছি। এটা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। মাদক, জঙ্গীবাদের মতো দুর্নীতির বিরদ্ধেও সরকারের শক্ত অবস্থানের কথা বৈঠকে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাড়ানো, আবাসনসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এই দুর্নীতিও একটা কালো ব্যাধি। এটা সমাজের উন্নয়ন যথেষ্ট ব্যাহত করে। সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তারের জন্য অতীতের সরকারগুলোকে দায়ী করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, যে দেশেই মিলিটারি ডিক্টেটররা ক্ষমতায় আসে, তারা প্রথমেই সমাজটাকে ধ্বংস করে দেয়। দুর্নীতিটাকে তারা নীতি হিসেবে নেয় এবং সুযোগও সৃষ্টি করে দেয়। ঋণখেলাপী থেকে শুরু করে যা কিছু বাংলাদেশে আমরা দেখি, তার গোড়াপত্তন কিন্তু ’৭৫-এর পরে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারাই সৃষ্টি করে গেছেন। সেই জায়গা থেকে সমাজকে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষকে একটা নিরাপদ জীবন দেয়া বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সব থেকে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সড়কে যানজট কমাতে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের অর্থনীতি যত ভাল হচ্ছে, মানুষের সুযোগ-সুবিধাও বাড়ছে। গাড়ি কেনা ও মানুষের চলাচলও বাড়ছে। ট্রাফিক জ্যাম একটা বিরাট সমস্যা, এতে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। এ সমস্যা সমাধানে আরও আন্ডারপাস ও ফুটওভারব্রিজ করে দেয়ার কথা বললেও সাধারণ মানুষ ও চালকদের সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। সরকারপ্রধান বলেন, গাড়ি যাচ্ছে, মানুষও যাচ্ছে- এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা। বিষয়গুলো ভালভাবে দেখা উচিত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। সেটা ধরে রেখে আরও সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দেশকে উন্নয়নশীল থেকে ধীরে ধীরে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা এবং আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যাতে যথাযথভাবে কার্যকর হয় সে ব্যবস্থা করা। সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়ে সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের যোগাযোগ দ্রুততর করার জন্য গাড়ি, স্পীডবোটসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী। এ বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। জননিরাপত্তা বিভাগ ও সুরক্ষা বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তা এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দফতরের প্রধানরাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর জন্য প্রতিনিয়ত গাড়ির চাহিদা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, না চাইলে কেউ দেয় না, আমি তো সেধে সেধে বলি। তিনি বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া এই মন্ত্রণালয়ে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের দায়িত্ব। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার যোগাযোগ করার জন্য গাড়ি বা নৌযানের খুব সমস্যা থাকে। আমরা প্রতিনিয়ত গাড়ি কিনে দিচ্ছি। গাড়ি এত বেশি ব্যবহার হয় যে এগুলো বেশিদিন টিকবে এমন নয়। একবার গাড়ি কিনে দিলে আজীবন চলবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। অন্যের কাছ থেকে গাড়ি নেয়া এটাও আমরা চাই না। কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এবার প্রচুর গাড়ি দিয়ে দিয়েছি, সেগুলো আপনারা নিতে পারেননি। এটা যেহেতু একটা চলমান প্রক্রিয়া তাই হিসাব রেখে অনবরত আপনাদের ডিমান্ডটা দিতে থাকেন। কারণ না চাইলে কেউ দেয় না, আমি তো সেধে সেধে বলি। সবাই তো বলবে না, এটা হলো বাস্তবতা। লোকজন অনুযায়ী কী সংখ্যক গাড়ি বছরে লাগতে পারে চার্ট করে রাখেন। লোকালি যেখানে গাড়ি এ্যাসেম্বল হয় সেখানে অর্ডার প্লেস করে রাখেন, যত গাড়ি হয় তারা সাপ্লাই দেবে। সেভাবে একটা ব্যবস্থা আপনাদের নেয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলযান কোথায়-কী পরিমাণ লাগবে সেটার যদি হিসাব থাকে, হিসাব মতো যদি শুরু থেকে ব্যবস্থা করা যায়, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরও বেশি নিরাপত্তা দিতে পারবে। যে কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে তা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বলেও জানান শেখ হাসিনা। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো প্রয়োজন সেগুলোর ক্ষেত্রে দেখেছি যে অবহেলার শিকার আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে আমি বলতে পারি। পুলিশ বাহিনী কাজ করত, না ছিল তাদের লোকবল, না ছিল তাদের কোন অবকাঠামো সুবিধা, ট্রেনিংয়ের সুবিধা। সব দিক থেকে অবহেলার শিকার ছিল। আমরা প্রথম বাজেটেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ দ্বিগুণ করে দিয়েছিলাম। ট্রেনিংয়ের সুযোগ সৃষ্টি, অবকাঠামো উন্নয়নের চেষ্টা তখন আমরা করি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের চেষ্টা ছিল যারা জনগণের নিরাপত্তা দেবে তাদের জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। যখন তারা সঠিক সেবা দেবে তখনই মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে। এই মন্ত্রণালয়টা একটা বিশাল মন্ত্রণালয়।
×