ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হলি আর্টিজানের পলাতক আসামি রিপনের র‌্যাবকে দেয়া চাঞ্চল্যকর তথ্য

ঢাকা কারাগার থেকে সতীর্থ জঙ্গীদের ছিনিয়ে নেয়াই ছিল রিপনের পরের টার্গেট

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২১ জানুয়ারি ২০১৯

 ঢাকা কারাগার থেকে সতীর্থ জঙ্গীদের ছিনিয়ে নেয়াই ছিল রিপনের পরের টার্গেট

আজাদ সুলায়মান ॥ দুনিয়া কাঁপানো হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম অর্থদাতা রিপনের পরবর্তী মিশন ছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হামলা চালিয়ে জঙ্গীদের ছিনিয়ে নেয়া। হলি আর্টিজান ঘটনার পরপরই সে আত্মগোপনে চলে যায়, তবে দমে যাননি এক মুহূর্তের জন্যও। প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্র করেছে কিভাবে কারাগারে আটক অন্য জঙ্গীদের ছিনিয়ে নেয়া যায়। এমনকি সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগেও দেশের বিভিন্ন স্থান ও স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানে হামলার চক্রান্ত ছিল তার। চাঞ্চল্যকর এ মামলার চার্জশীটভুক্ত পলাতক আসামি রিপন ধরা পড়ায় বেরিয়ে আসছে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। শনিবার রাতে গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে র‌্যাব। আটকের পর জানা যায়, তার একাধিক নামের ভান্ডার-মামুনুর রশিদ ওরফে রিপন ওরফে রেজাউল ওরফে রেজাউল করিম ওরফে আবু মুজাহির। র‌্যাবের হেফাজতে সে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাব পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। তিনি বলেন, তার দেয়া তথ্যমতে আরও কজন জঙ্গীকে আটকের জন্য অভিযান চলছে। জানা গেছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাইবান্ধায় এক বৈঠকে হলি আর্টিজানে হামলার সিদ্ধান্ত হয়। সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হামলার আগে এপ্রিল মাসে রিপন ভারতে চলে যান। সেখান থেকে হামলার আগে রিপন আনুমানিক ৩৯ লাখ টাকা সারোয়ার জাহানকে পাঠান। হলি আর্টিজানে ব্যবহৃত তিনটি একে ২২ রাইফেল, পিস্তলসহ বিস্ফোরকগুলো কল্যাণপুরে পাঠায়। মারজানের মাধ্যমে এরপর সেগুলো সারোয়ার জাহানের কাছে পৌঁছান। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জঙ্গী হামলার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রিপন ছিলেন এবং সেসব ঘটনা রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল। এ সম্পর্কে মুফতি মাহমুদ বলেন, বিভিন্ন জঙ্গী হামলাগুলো পরিচালনার আগে মহড়া করা হতো। ২০১৬ সালে এপ্রিলে একটি মহড়া চলাকালীন বগুড়ায় বিস্ফোরণে সুরা সদস্য ফারদিন ও অপর এক সক্রিয় জঙ্গী সদস্য তারিকুল ইসলাম নিহত হয়। হলি আর্টিজান পরবর্তী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গীরা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েন। তখন আত্মগোপনে থেকে রিপন পুনরায় জঙ্গীদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। এ উদ্দেশে সে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে জঙ্গীদের সংগঠিত করতে থাকে। নির্বাচনের আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ম্পর্শকাতর স্থানে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা ছিল। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এটা সম্ভব হয়নি। ২০১৪ সালে ত্রিশালে জঙ্গী ছিনতাইয়ের ঘটনা সংগঠনের সদস্যদের উজ্জীবিত করতে সহায়তা করেছিল। যেহেতু এখন হলি আর্টিজান মামলা চলমান রয়েছে- সেহেতু এরই মধ্যে আবারও একটি ঘটনা ঘটিয়ে জঙ্গী ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা ছিল রিপনের। এক প্রশ্নের জবাবে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, আমরা রিপনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। সে জানিয়েছে, ২০১৪ সালে ত্রিশালের মতো জঙ্গী ছিনতাই পরিকল্পনা করেছিল তারা। ত্রিশালের মতো আরেকটি ঘটনা ঘটিয়ে জঙ্গীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিল তারা। মূলত হলি আর্টিজান হামলা মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামিদের ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা ছিল তাদের। জেএমবির আমির আবদুর রহমানের মেয়ের জামাই আওয়ালের ভাগ্নে হওয়ায় রিপনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সংগঠনে। কে এই রিপন ॥ দুর্ধর্ষ এই জঙ্গীর সম্পর্কে আগে থেকেই অনেক তথ্য ছিল র‌্যাবের গোচরে। বগুড়ার নন্দীগ্রামের শেখের মাড়িয়ার মৃত নাছির উদ্দিনের ছেলে রিপন পড়াশোনা করেছেন রাজধানীর মিরপুরে, বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও নওগাঁর বিভিন্ন মাদ্রাসায়। ২০০৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাদ্রাসাতুল দারুল হাদিস থেকে দাওরা-ই হাদিস শেষ করে বগুড়ার সাইবার টেক নামক একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কোর্স সম্পন্ন করে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ২০১৩ সালে পূর্ব পরিচিত ডাঃ নজরুলের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হন। প্রাথমিকভাবে রিপনের দায়িত্ব ছিল ইয়ানত (চাঁদা) সংগ্রহ। সেই টাকা তৎকালীন জেএমবির একাংশের আমির ডাঃ নজরুলের কাছে টাকা পৌঁছে দিতেন। জেএমবির সারোয়ার জাহান গ্রুপের পুরো জেএমবির অর্থ ও সদস্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব পান রিপন। এরই অংশ হিসেবে রিপন বিকাশের দোকান লুট করে ৬ লাখ টাকা, সিগারেট বিক্রেতা হতে ছিনতাই করে ১ লাখ টাকা এবং গাইবান্ধায় অপর এক ঘটনায় ১ লাখ টাকাসহ মোট ৮ লাখ টাকা ছিনতাই করে জেএমবি আমির সারোয়ার জাহানের কাছে পৌঁছে দেন। ওই সময়ই জেএমবির আমির সারোয়ার জাহানের মাধ্যমে জঙ্গীদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতা জঙ্গী আবদুল্লাহর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। জেএমবিতে তামিম চৌধুরীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে রিপন র‌্যাবকে জানায়, ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে তামিম চৌধুরী ও সারোয়ার জাহানের গোপন বৈঠকের মাধ্যমে সমঝোতার ভিত্তিতে স্মারকপত্র প্রস্তুত করা হয়। সমঝোতার ভিত্তিতে সারোয়ার জাহানকে আমির নির্বাচিত করা হয় এবং সাংগঠনিক নাম দেয়া হয় ‘শায়েখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ’। ওই বৈঠকে সাদ্দাম ওরফে কামাল, শরিফুল ওরফে রাহাতের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন রিপনসহ আরও কয়েকজন। ওই বৈঠকে রিপন জেএমবির শূরা সদস্য হিসেবে নিয়োজিত হন। তার দায়িত্ব ছিল অর্থ সংগ্রহ, সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরণ সরবরাহ করা। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে রিপন জানায়, রিপনের গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়। সে ঢাকার মিরপুর, বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও নওগাঁর বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে। ২০০৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাদ্রাসাতুল দারুল হাদিস থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করে সে। এরপর বগুড়ার একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চাকরি নেয়। ২০১৩ সালে ডাঃ নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে জেএমবির শীর্ষ ও নেতৃত্ব প্রদানকারীদের অন্যতম এবং একাংশের আমির। জেএমবির এই অংশের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে রিপন। বিকাশের দোকান লুট করে ৬ লাখ টাকা, সিগারেটের দোকানে লুট করে ১ লাখ এবং গাইবান্ধা থেকে এক লাখ টাকাসহ মোট আট লাখ টাকা জেএমবির আমির সারোয়ার জাহানের কাছে পৌঁছে দেয় সে। সারোয়ার জাহানের মাধ্যমে জঙ্গী আবদুল্লাহর সঙ্গেও পরিচয় হয় তার। রিপনের বরাত দিয়ে মুফতি মাহমুদ বলেন, পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গী নেতা তামীম চৌধুরীর সঙ্গে সারোয়ার জাহানের একটি বৈঠকের সমঝোতা স্মারক প্রস্তুত করা হয় ২০১৫ সালে। ওই সমঝোতার ভিত্তিতে সারোয়ার জাহানকে আমির নির্বাচিত করা হয়। তার সাংগঠনিক নাম দেয়া হয় শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। ওই বৈঠকে জেএমবি সদস্য সাদ্দাম ওরফে কামাল, শরিফুল ওরফে রাহাত ও রিপনসহ আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিল। তার মধ্যে মামুনুর রশীদ রিপন শূরা সদস্য নির্বাচিত হয়। এই সময়টাতে জেএমবির মধ্যে বিভক্তি বা গ্রুপিং ছিল। জেএমবিতে রিপনের দায়িত্ব ছিল অর্থ সংগ্রহ, সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও অস্ত্র সরবরাহ করা এবং জঙ্গীদের সঙ্গে তার ভাল যোগাযোগ ছিল। ২০১৬ সালের এপ্রিলে রিপনের নেতৃত্বে একটি জঙ্গী দল ভারত যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার। হলি আর্টিজান হামলার আগে আনুমানিক ৩৯ লাখ টাকা সারোয়ার জাহানকে পাঠায় রিপন। সে হলি আর্টিজান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহের সঙ্গেও জড়িত ছিল। এছাড়াও উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল রিপন। র‌্যাব জানিয়েছে- উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ হামলা রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে হয়েছে। হামলা চালানোর আগে তারা মহড়া দিত। ২০১৬ সালের এপ্রিলে এমন একটি মহড়ায় র‌্যাবের অভিযানে জেএমবির শুরা সদস্য ফারদিন ও তারিকুল ইসলাম জুয়েল নিহত হয়। তবে ওই মহড়ায় ছিল না রিপন। হলি আর্টিজান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের জন্য রিপন ভারতে আত্মগোপনে চলে যায়। সে জেএমবিকে সুসংগঠিত করার চেষ্টা করে। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ফের বাংলাদেশে আসে। সম্প্রতি তারা ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা নিয়েছিল। হলি আর্টিজান হামলার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি জানান, তারা ২০১৫ সালে গাইবান্ধায় মিটিং করে। ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে হলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনা করে। রিপন হামলার জন্য তিনটি একে টু, একটি পিস্তল সরবরাহ করেছিল। জঙ্গী মারজানের মাধ্যমে সরোয়ার জাহানকে এসব পাঠায় রিপন। হলি আর্টিজান হামলার আগের দিন বারিধারায় মিটিং করেছিল জঙ্গীরা। এছাড়া নির্বাচনের আগেও নাশকতার চেষ্টা করেছিল বলে জানিয়েছে র‌্যাব।
×