ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অমুসলিমদের স্বার্থ রক্ষায় কমিশন

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

অমুসলিমদের স্বার্থ রক্ষায় কমিশন

যে চারটি মৌলিক নীতির ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা হয়েছিল, তার অন্যতমটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, যার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, বরং সকল ধর্মের মানুষের ধর্মচর্চায় সমান অধিকার। ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর সংবিধান প্রণয়নকালে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক এবং অসাধারণ বক্তব্যে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। জিয়া সব উল্টে দিলেন ১৯৭২-এর সংবিধানের ১২ এবং ৩৮ অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর সেই কঠোর সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটলেও জিয়াউর রহমান বন্দুকের বলে ক্ষমতা জবরদখলের পর তার পাকিস্তানীকরণের পরিকল্পনামাফিক শুরুতেই আঘাত হেনেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর। তিনি কেবল ১২ অনুচ্ছেদ মুছেই খান্ত হননি, দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর গোলাম আজমসহ সকল তথাকথিত রাজনীতিককে দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের আর্থিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন, যাদের তথাকথিত রাজনীতির একমাত্র পুঁজি ছিল ধর্ম ব্যবসা। যারা এই পুঁজি নিয়ে ’৭১ এ পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়ক হয়ে গণহত্যা এবং গণধর্ষণ করেছে। জিয়ার সময় থেকেই শুরু হয়েছিল এদেশে ধর্মীয় সহিংসতা, জিয়া এবং তার সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতাকে সমূলে উৎপাটন করে জিয়া প্রতিষ্ঠিত করলেন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তার প্রতিষ্ঠিত দলের সদস্যদের লেলিয়ে দিয়ে। জিয়া পরবর্তী অবস্থা জিয়ার অপমৃত্যুর পরেও ২১ বছর তারাই দেশ শাসন করেছে, যারা জিয়া তথা পাকিস্তান আদর্শের প্রত্যক্ষ অনুসারী। জিয়া এবং পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তারা সাম্প্রদায়িকতা আরও এগিয়ে নিয়ে গেল। তাদের মূল উদ্দেশ্য হয়ে গেল অমুসলিম ধর্মাবলম্বীদের দেশ থেকে উৎখাত করা এবং এতে তারা বহুলাংশে সফলও হলো। জিয়া এবং তার উত্তরসূরিদের অত্যাচারে হাজার হাজার হিন্দু ধর্মের লোক দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হলেন। যেখানে স্বাধীনতার সময় হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা ছিল ২৪%, খালেদা জিয়ার শাসন আমলে তা নেমে গিয়ে দাঁড়াল ৮%। জিয়া এবং খালেদা সরকারের উস্কানিতে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হলেও সবচেয়ে নারকীয় ঘটনাটি বিএনপি-জামায়াত সরকার ঘটিয়েছিল ২০০১ সালের নির্বাচনের পর। খুন, ধর্ষণ, মন্দির ধ্বংস এবং হিন্দু বাড়িতে আগুন দেয়ার বহু ঘটনা বিশ্ব বিবেককেও স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। পূর্ণিমা শিলের মতো বহু হিন্দু ধর্মীয় নারী হয়েছিল বিএনপি-জামায়াতের লোকদের হাতে গণধর্ষণের শিকার। সাহাবুদ্দিন চুপ্পু কমিশন ২৬ হাজার বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীকে চিহ্নিত করেছিলেন এসব হত্যা-ধর্ষণ এবং ধ্বংসযজ্ঞে। অমুসলিমদের রক্ষায় প্রতিষ্ঠান খালেদা জিয়ার শাসনামলে ধর্মীয় সহিংসতা অসহনীয় গতিতে বৃদ্ধি পেলে অমুসলিম ধর্মাবলম্বীদের রক্ষা করার বিষয়টি সকলের দৃষ্টি কাড়ে। প্রতিটি নির্বাচনকালীন সময়ে বিএনপি-জামায়াত এতোই উগ্ররূপ ধারণ করে যে, অমুসলিম ধর্মাবলম্বী নাগরিকগণ নির্বাচনকে ভয় করতে শুরু করেন। বিজ্ঞ এবং গবেষণা সমৃদ্ধজনেরা মনে করেন অমুসলিম ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য একটি সংস্থা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যে দুটি সংস্থা এ দাবিতে সোচ্চার তাদের মধ্যে ৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নামই আসে সর্বাগ্রে। সাম্প্রদায়িতকতার শেষ চিহ্ন উৎখাতের দ্রোহে সংকল্পবদ্ধ এই সংস্থা তাদের যুক্তির সমর্থনে ভারত এবং আরও কয়েকটি দেশের উদাহরণ তুলে ধরেছে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্যজোটও এ দাবির অন্যতম পুরাধা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সার্বিকভাবে মানবাধিকার রক্ষার প্রত্যয় নিয়ে এ সংস্থার জন্ম হয় ২০০৯ সালে। যে আইন দ্বারা এ সংস্থার সৃষ্টি তার ব্যাপকতা দেশের গোটা জনসমষ্টির অধিকার নিয়ে। তা ছাড়া এই আইন মানবাধিকার কমিশনকে যে সকল বিষয় বিবেচনা এবং যে বিষয়সমূহের ব্যাপারে কর্মপন্থা গ্রহণ করার দায়িত্ব দিয়েছে, তার মধ্যে ধর্মভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা থাকলেও সেটি অপ্রতুল। তা ছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের হাতে কোন প্রয়োগ ক্ষমতা না থাকায় ধর্মভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘন, সহিংসতা এবং বৈষম্য রোধ করা এই সংস্থার পক্ষের সম্ভব নয়। একই কারণে ভারতে একদিকে যেমন রয়েছে উচ্চ অবস্থানরত মানবাধিকার কমিশন, অন্যদিকে তেমনি রয়েছে National Commission for Minorities. ভারতীয় অবস্থান-সাংবিধানিক মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতীয় সংবিধান যেসব বিধান এবং মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি এবং প্রয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো আমাদের সাংবিধানিক বিধান থেকে খুব আলাদা নয়, বরং অনেকটা অভিন্ন। আমাদের সাংবিধানিক নির্দেশনার মতো ভারতীয় সংবিধানেও বলা হয়েছে এটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, বলা হয়েছে ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ, উত্তরাধিকারের বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোন বৈষম্য চলবে না। বলা হয়েছে পাবলিক চাকরিতে বৈষম্য চলবে না। একইভাবে সকল ধর্মের মানুষের নিজ নিজ ধর্মচর্চার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। যদিও ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ধর্মীয় সংখ্যালঘিষ্টদের অধিকার রয়েছে নিজস্ব ধরনের শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠার, তবে ওই ধরনের শিক্ষালয়সমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের রয়েছে। ভারতের জাতীয় কমিশন ১৯৯২ সালে ভারতীয় সংসদে ন্যাশনাল কমিশন ফর মাইনরিটিস আইন প্রণীত হয় সংবিধানের ধারাবাহিকতায় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার নিমিত্তে। এই আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল কমিশন ফর মাইনরিটিস। একজন চেয়ারম্যানসহ মোট ৭ ব্যক্তির সমন্বয়ে এই কমিশনে রয়েছেন মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, জৈন এবং পারসি ধর্মের ছয়জন সদস্য। তবে মাইনরিটি শব্দটির ব্যাখ্যা সংবিধানেও নেই, এই আইনেও নেই। এই তত্ত্বের ব্যাখ্যা বিভিন্ন আদালত বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। এই কমিশনের ব্যাপক কর্ম ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে সংবিধান এবং অন্যান্য আইনের আওতায় সংখ্যালঘিষ্টদের অধিকারের নিশ্চায়ন, সংখ্যালঘুদের স্বার্থ নিয়ে গবেষণা করে সরকারের নিকট প্রস্তাবনা পাঠানো। তা ছাড়া কমিশন অভিযোগ বিবেচনার ফোরাম হিসেবেও কাজ করে। একটি দেওয়ানি আদালতের মতো কমিশনকে সাক্ষী তলব করতে, দলিল তলব করতে, সাক্ষ্য নেয়ার, পাবলিক রেকর্ড তলব করা, সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য কমিশনকে সমন ইস্যু করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের রেইসিয়তাল ইক্যুয়েলিটি কমিশন বিলেতের উপরোক্ত নামের সংস্থাটি বিভিন্ন বর্ণ এবং গোত্রের জনসংখ্যার মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণের জন্য বর্ণ সম্পর্কীয় আইন বলে প্রতিষ্ঠিত একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। এই সংস্থার কর্ম ক্ষেত্র এবং ক্ষমতা এক অর্থে ভারতীয় সংস্থা থেকেও অধিক ক্ষমতার অধিকারী এই অর্থে যে, বিলেতি সংস্থা দেশের বিভিন্ন ফৌজদারি, দেওয়ানি, শ্রম এবং চাকরি সংক্রান্ত মামলা আদালতে নিজ উদ্যোগেই করার ক্ষমতার অধিকারী। আমাদের কী হওয়া উচিত আমাদের পরিস্থিতি ভারত এবং যুক্তরাজ্যে থেকে এই অর্থে ভিন্ন যে, বাংলাদেশ এমনি একটি রাষ্ট্র যার জনসংখ্যার প্রায় সকলেই বাঙালী বর্ণ বিশিষ্ট এবং সে অর্থে এখানে সংখ্যালঘিষ্ট বলে কিছু নেই। বাঙালী জনসংখ্যার মধ্যেই রয়েছে হিন্দু-খ্রীস্টান-বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ। অমুসলিম ধর্মে বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য, হানাহানি লাঘবের জন্য ভারতের এবং যুক্তরাজ্যের আদেলে কমিশন গঠন আমাদের দেশেও প্রয়োজন। ভারতীয় সংবিধানে যে সকল মৌলিক অধিকার রয়েছে, আমাদের সংবিধানেও সেগুলো বিদ্যমান। যেটুকু ব্যবধান রয়েছে তা এ কারণে যে ভারত বহু জাতি, ভাষা, বর্ণ, গোত্রের মানুষের আবাসন স্থল। জিয়াউর রহমান ৫ম সংশোধনীর দ্বারা ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য দূর করলেও বর্তমান সরকার ৫ম সংশোধনী মামলার রায়ের নিরীখে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেছে। সাংবিধানিকভাবে ভারতের মতোই বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র। আমাদের সম্ভাব্য কমিশনকে ভারতীয় কমিশনে প্রদেয় কর্মক্ষেত্র এবং এখতিয়ার প্রদান করা হলে সংবিধানের ৪৪ এবং ১০২ অনুচ্ছেদ প্রদত্ত বিধান বলে কমিশন অমুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং নির্যাতন লাঘব চেয়ে হাইকোর্টের দারস্থ হতে পারবে। তা ছাড়া ফৌজদারি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য বাদীর সহায়ক হিসেবেও ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। অভিযোগ বিবেচনার কর্মশালা (ফোরাম) হিসেবে ভারতীয় কমিশনের এখতিয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে ভারতীয় কমিশনের রয়েছে সাক্ষ্য তলব সংক্রান্ত দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা। এমনি ক্ষমতা বাংলাদেশের সম্ভাব্য কমিশনকে প্রদান করা হলে সংস্থা বহুলাংশ সাম্প্রদায়িক অপকর্ম রোধে কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবে। বিলেতের কমিশন ফর রেইসিয়াল ইক্যুয়েলিটির মতো সরাসরি ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলা দায়েরের ক্ষমতা হবে নিঃসন্দেহে এক ফলপ্রসূ সংযোজন। লেখক : আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি
×