ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২০২০ ও ২১ সালের মহোৎসবের আয়োজন

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

২০২০ ও ২১ সালের মহোৎসবের আয়োজন

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত রায়ে নতুন নির্বাচিত সরকারের যে যাত্রা শুরু, তাকে আরও অনেক কঠিন পথ অতিক্রম করতে হবে। বিজয়ের উৎসবে সারাদেশ উজ্জীবিত হলেও অনেক শঙ্কা, আতঙ্ক দেশ থেকে সম্পূর্ণ বিলোপ হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার বিজয় পতাকায় মুক্তির আনন্দ যখন কানায় কানায় পূর্ণ, সেই মহিমান্বিত দিনটির মাত্র ২ দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর যে অনাকাক্সিক্ষত রক্তবন্যা বুদ্ধিবৃত্তির জগতকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল, সেই মহাদুর্যোগকে ভুলে গেলে চলবে না। প্রশিক্ষিত, হিংস্র, হানাদার পাকবাহিনী যখন আত্মসমর্পণের দুঃসময়কে মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেখানে শেষ মুহূর্তকেও তারা কাজে লাগিয়েছিল। মেধা ও মননশূন্য করতে বাঙালীদের ওপর যে মরণাঘাত হানে, সেই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটিও আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না। মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ এবং বিরোধী অপশক্তি সব সময় সক্রিয় থাকে সর্বশেষ ছোবল দিয়ে বিজয়কেতনকে ছারখার করে দিতে। বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হেনরি নেভিলসন অত্যন্ত সুললিত ভাষায় যে অভিমত ব্যক্ত করেন, তাকেও আমাদের স্মরণে রাখা অত্যন্ত যৌক্তিক। বিংশ শতাব্দীর এই রাজনীতি বিশ্লেষক বলেন- প্রেমের মতো স্বাধীনতাকেও আমাদের প্রতি মুহূর্তে জয় করতে হয়। প্রতিবার জয়ের পর আমরা যখন নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকি তখন যেমন প্রেমকে হারাতে বসি, সেভাবে স্বাধীনতাকেও আমাদের হারাতে হয়। স্বাধীনতার যুদ্ধ কোনদিন শেষ হয় না। এটা নিরন্তর চলতে থাকে। সুতরাং অনেক সহজে বিজয় অর্জিত হলেও একে রক্ষা করা ততোধিক কঠিন। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর সময় কাটতে না কাটতেই সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার নির্মম রক্তপ্লাবন আমাদের বাকরুদ্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, সেই ক্ষতবিক্ষত স্বাধীন ভূমিতে পরাজিত অপশক্তিরা যেভাবে তাদের আসন পাকাপোক্ত করে, তাও ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। সেই কলঙ্ক ২১ বছর ধরে আমাদের বহন করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দুঃসহ হত্যাযজ্ঞের দুর্ভেদ্য প্রাচীরকে ভেদ করাও সম্ভব হয়নি। বাঙালী জাতি বছরের পর বছর এই অনধিগম্য বিচারহীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করারও সুযোগ পায়নি। মেনে নিতে হয়েছে এই পর্বতসমান কাঠিন্যকে। ১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে ফিরে আসা জাতির জন শুভযোগ হলে সেই কণ্টকিত পথও কখনও নির্বিঘœ আর নিরাপদ ছিল না। কত বিপদসঙ্কুল অরণ্য পাড়ি দিতে দিতে নিজের মূল্যবান জীবনকে বাজি রেখে যে সংগ্রামী অভিযাত্রায় দুর্গম, সঙ্কটাপন্ন পথ অতিক্রম করেছিলেন, সে সব অসহনীয় স্মৃতিও ভুলে গেলে চলবে না। ১৯৮১ থেকে ৯৬ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে কত ভাঙ্গা-গড়ার বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়, সেও এক ঐতিহাসিক স্মরণযোগ্য মহাযাত্রা। অসংহত দুর্বিপাকে পড়া আওয়ামী লীগকে যে উৎসাহ আর উদ্দীপনায় এক সূত্রে বেঁধে ছিলেন, সেই দুঃসময়ও কখনও সহজ-স্বাভাবিক ছিল না। প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে প্রতিপক্ষ অপশক্তির বিরুদ্ধে শক্ত আর মজবুত করতে হয়েছে নিজেকেসহ দলকে। অপশক্তি শুধু প্রতিপক্ষ নয়, স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এক ভয়ঙ্কর উন্মত্ত গোষ্ঠী। যারা প্রতিনিয়তই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে ‘স্বাধীনতা’ নামক এই মহান শব্দটিকে দলিত-মথিত করার এক দূরভিসন্ধিতে। সুতরাং নির্বাচনের রায়ের মাধ্যমে তাদের পরাজয় সংঘটিত হলেও অপশক্তি হিসেবে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের ব্যাপারে সাবধান আর সতর্ক থাকা সব মানুষের নৈতিক দায়বদ্ধতা। নির্বাচনের ভরাডুবিতে ষড়যন্ত্রকারী জামায়াত কিছুটা নিশ্চুপ হয়ে গেলেও তাদের মদদদাতা বিএনপি ঐক্যজোট এখনও শোচনীয় পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি। সদম্ভ আর দাপটের সঙ্গে নিজেদের পক্ষ হয়ে জনসমক্ষে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ন্যক্কারজনক বক্তব্য দিতে কার্পণ্য করছে না। সেক্ষেত্রে বিজয়ী দলকেও তাদের শক্ত অবস্থান আরও জোরালো করে তোলা ছাড়া অন্য কোন পথ সামনে খোলা নেই। গত দশ বছরে বাংলাদেশের অপরাজেয় নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশ-বিদেশে যেভাবে তাঁর ক্ষমতা, কর্তৃত্ব আর জনগণের প্রতি পর্বতপ্রমাণ দায়বদ্ধতা নিয়ে নিজেকে যোগ্যতম হিসেবে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন, এই মুহূর্তে সেটাই আমাদের বড় শক্তি। মাদক, জঙ্গীবাদ নিধনসহ জনগোষ্ঠীর ৫ মৌলিক অধিকারকে তাদের নিকট যেভাবে হাজির করেছেন, পরবর্তীতে অসমাপ্ত কর্মপরিকল্পনাও সেই গতিময়তায় সমৃদ্ধির জোয়ারকে অবারিত করবে। আরও অনেক নতুন সম্ভাবনায় আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে সময়োপযোগী প্রকল্পে মাতৃভূমিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আর এখানেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হলো, দুর্নীতির মতো মহাদুর্যোগকে চিরতরে বিদায় দেয়া। নির্বাচনী অঙ্গীকারের এই অনমনীয় প্রত্যয়কে মোকাবেলা করতে জনগণকে তাদের প্রত্যাশা পূরণে অনেক সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেন। সরকারী বেতন স্কেলকে দ্বিগুণেরও বেশি করা হয়েছে, যাতে মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা স্বচ্ছন্দ্য গতিতে তাদের চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়। ১৯ জানুয়ারি শনিবার সোহ্রাওয়ার্দীর মহাসমাবেশে এসব প্রতিশ্রুত বিষয়গুলোকেই নতুন করে জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ তৈরিতে সবাইকেই দায়বদ্ধ থাকতে হবে নিজের অবস্থানে থেকে। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যত বাংলাদেশের কা-ারি হিসেবে সময়ের প্রজন্মকে সর্বাধিক বিবেচনায় এনে তাদেরও দেশ এগিয়ে নেয়ার হাল ধরার উদাত্ত আহ্বান জানান। দুর্নীতির ব্যাপারে কোন আপোস কিংবা ধৈর্যের বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকবে না বলে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় অঙ্গীকার সবাইকে আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এক সময়ে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের অনেক অনিয়ম, অস্বচ্ছতা কমে আসলেও একেবারে দূরীভূত করা এখনও সম্ভব হয়নি। সেই অবধারিত লক্ষ্যে নতুন সরকার থেকে শুরু করে আধুনিক প্রজন্ম এমনকি দলমত নির্বিশেষে সবার সহযোগিতা কামনা করেন চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়া এই দূরদর্শী রাজনীতিজ্ঞ। এ ছাড়াও সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে পর পর দুই বছরে দুটো বিরাট উৎসব। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর জন্য পুরো জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। বঙ্গবন্ধুর বেঁচে থাকার জীবনটা ছিল শুধু লড়াই আর সংগ্রামের এক দুর্গম পথযাত্রা। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন স্বস্তিতে, নিশ্চিন্তে জীবনযাপন এক কল্পনাপ্রসূত আখ্যান। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর সামনে সদম্ভে দাঁড়ানোর যে অনমনীয় দৃঢ়বল সেখান থেকেই বলে ফেলেনÑ শুধু উর্দুর নয়, বাংলাও হবে পাকিস্তানের আরও একটি রাষ্ট্রভাষা। সেই অবিচলিত বোধ আর আদর্শিক চেতনায় যে মহাসমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেখান থেকে কখনও নিষ্কৃতি তাঁর মেলেনি। দীপ্ত চেতনায় এগিয়ে যাওয়া আবহমান বাঙালীর মহানায়ক বীরদর্পে যে সম্মুখ অভিযাত্রাকে অবারিত করেছিলেন, সে বলয় থেকে সামান্যতম চ্যুত হতেও কেউ দেখেনি। চারপাশে শত্রু পরিবেষ্টিত যে চক্রব্যুহে তিনি আটকে পড়েছিলেন, সেখান থেকে সরে আসার জন্য অনেক সুহৃদের পরামর্শও তিনি শোনেননি। তিনি ভাবতেও পারেননি, যে জাতির জন্য নিজেকে তিনি উৎসর্গ করেছেন, নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার সময়ও তার ছিল না, তারাই তার জীবন প্রদীপ অকারণে, অপ্রয়োজনে নিভিয়ে দেবে! সেটাও ছিল এক ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা পরম্পরা। কারণ চারপাশের বন্ধুবেশে শত্রুরা ভেতর থেকে সংহত হচ্ছিল এক অনাকাক্সিক্ষত মহাদুর্যোগে জাতিকে বিপন্ন অবস্থায় ঠেলে দিতে, যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নেরও অতীত ছিল। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল, যা তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। পেলেও তাঁর নিকটজনদের প্রতি বিশ্বাস হারাতে তিনি রাজি ছিলেন না। সেই বিশ্বাসের বাঁধন যারা ছিন্নভিন্ন করে দেয়, তারা কি ক্ষমা পেয়েছিল? ইতিহাসের যথার্থ বিচারে আজ তাদের স্থান কোথায়, সময়ই তার অবধারিত পরিণতিকে সবার সামনে হাজির করে। আর এটার জন্য জাতিকেও অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুও উঠে এসেছেন আবহমান বাঙালীর নেতা হিসেবেই শুধু নন, বিশ্ব সভায়ও নিজের অবস্থানকে করেছেন অনেক শক্ত আর মজবুত। আর উৎসবে, আয়োজনে, মহাসমারোহে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীকে যথাযথভাবে উদযাপনের প্রস্তুতি নেয়া দেশের মানুষের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে করণীয় ব্যাপার। ২০২১ সালের মার্চ মাসে দেশ পাবে আরও একটি উপহার। স্বাধীনতা দিবসের ৫০তম পূর্তি। এই অবিস্মরণীয় অর্জনকে সাড়ম্বরতায় সর্বমানুষের দ্বারে পৌঁছে দেয়া শুধু প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার নবগঠিত সরকারের একক কর্তব্য নয়। জাতি ধর্ম বর্ণ দল, মত নির্বিশেষে সবাইকে এখানে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে। শেখ হাসিনা নির্বাচনোত্তর এই জনসমাবেশে দ্ব্যর্থ কণ্ঠে ঘোষণা দেনÑ তার সরকার দল মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের পাশে থেকে অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করাই নয়, আরও নতুন কর্মপরিকল্পনায় সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রাকে নিরন্তর এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ জন্য প্রত্যেক মানুষকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সব ধরনের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। সততা এবং আদর্শিক চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের বোধ লালন করে অশুভ আর অপশক্তিকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দেয়া যাবে না। সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপানের প্রাক্কালে এই অঙ্গীকারে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।, স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী শক্তি সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের রায়ে প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে মাথা তোলা আসলেই এক অসম্ভব ব্যাপার। তবুও সাবধানতার কোন জুড়ি নেই। এই নিরবচ্ছিন্ন বিজয়কে তার গতিময়তায় সামনের দিকে নিতে গেলে সতর্কতামূলক পর্যবেক্ষণকেও প্রতিনিয়ত আমলে নিতে হবে। বহু কষ্টে অর্জিত এই স্বাধীনতা অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে বর্তমান নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন প্রবাহে এক গৌরবোজ্জ্বল প্রাপ্তিকে তার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। তাই ৫০তম বার্ষিকীও হবে সে ধারারই আরও এক নতুন সম্ভাবনা। সে অপার নব দিগন্ত উন্মোচন সাধারণ মানুষের জন্য হবে অন্যরকম এক অবিস্মরণীয় মঙ্গল যাত্রা। যে শুভযাত্রায় আর পেছনে তাকানোর সুযেগা থাকবে না। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আমাদের এই মুক্ত দেশকে ধরাছোঁয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলবে নিশ্চয়ই। সেই প্রত্যাশায় পুরো জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের শতবর্ষ উদ্যাপন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী পালনের ক্রান্তিলগ্নে। লেখক : সাংবাদিক
×