ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্ন ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে যুগোপযোগী আইন নেই

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

প্রত্ন ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে যুগোপযোগী আইন নেই

সমুদ্র হক ॥ প্রত্ন ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে যুগপোযোগী আইন না থাকায় ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণে বিঘ্ন ঘটছে। অনেক প্রত্ন সম্পদ লুটেরাদের কবলে পড়ছে। প্রত্নভূমির কোন স্থাপনা কেটে সমতল ভূমি বানিয়ে দখল করা হচ্ছে। ঐতিহ্যের অনেক অবকাঠামো ভেঙ্গে রূপান্তর করা হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে সম্পদ নয়ছয় হয়ে যাচ্ছে। এদিকে প্রত্ন সম্পদ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় বিদ্যমান আইনকে যুগপোযোগী করে তুলতে তিন বছর আগে ২০১৫ সালে খসড়া আইন প্রণয়ন করা হয়। কথা ছিল, প্রত্নবিষয়ক অভিজ্ঞ ব্যক্তি, বিশ^বিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক, সুধীজনের মতামতের ভিত্তিতে আইনের সংযোজন বিয়োজন করে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠবে। তারপর আইনটি সংসদে পাস করা হবে। খসড়া আইনটি কাগজে কলমে তৈরির পর পরবর্তী পদক্ষেপে আর যায়নি। তবে ১৯৭৬ সালে সংশোধিত একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। তাও যথেষ্ট নয়। সূত্র জানায় পুরাকীর্তি রক্ষা ও সংরক্ষণের তিনটি আইন আছে। ট্রেজারার্স ট্রুভ এ্যাক্ট ১৮৭৮, এ্যানসিয়েন্ট মনুমেন্ট প্রিজারভেশন এ্যাক্ট ১৯০৪, এ্যান্টিকুইটিজ এ্যাক্ট ১৯৪৭। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত এই তিনটি আইন দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর একই রাখা হয়। দিনে দিনে অপরাধের ধরণ পাল্টে গিয়েছে। প্রত্ন ও সাংস্কৃতিক সম্পদ নানাভাবে ও নানা কৌশলে লুট করা হচ্ছে। কালে ভদ্রে এই চোরেরা ধরা পড়ে। কঠিন আইন না থাকায় তারা পার পেয়ে যায়। ঐতিহ্যের সম্পদ রক্ষার প্রথম আইন ট্রেজারারাস ট্র্রুুভ এ্যাক্টের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রত্ন সম্পদ প্রাপ্তির সময় থেকে মাটির ওপরে ও নিচে থাকা যে কোন বস্তু এক শ’ বছরের পুরানো হলেই তার মালিক সরকার। এই বস্তু নিকটের ট্রেজারিতে জমা করা বাধ্যতামূলক। আইনটিতে ১৮৯১ এবং ১৯০৭ সালে কিছু সংশোধনী আনা হয়। এই আইন দিয়ে বর্তমানে দ্রুত কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এ্যানসিয়েন্ট মনুমমেন্টস প্রিজারভেশন এ্যাক্ট ১৯০৪ সালে প্রণয়ন করা হয়। পুরাকীর্তি পাচার রোধ, ঐতিহ্যের অবকাঠামো রক্ষা, প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও শিল্পকলার নিদর্শন সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের লক্ষ্যে এই আইনটি প্রনয়ন করা হয়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এই আইন প্রয়োগে অনেক সময় একাধিক সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে। যেমন কোন প্রাচীন ইমরাত নড়বড়ে হয়ে পড়লে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়। জানমাল রক্ষায় কর্তৃপক্ষ এই ইমারত ভেঙ্গে ফেললে আইনে আটকানো যায় না। এদিকে পুরাকীর্তি পাচারকে সাধারণ ঘটনা হিসেবে ধরা হয়। খোঁজখবর করে জানা যায়, পুরাকীর্তি পাচারের সঙ্গে অনেক রাঘব বোয়াল, রথি, মহারথিরা যুক্ত। কৌশলী অপরাধ এই আইন দিয়ে মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। এ্যান্টিকুইটিজ এ্যাক্টটি অনেকটাই এক্সপোর্ট কন্ট্রোল। এই আইনে ফাঁক ফোকর রয়ে গেছে। মুখোশের আড়ালে বড় অপরাধীরা কৌশলে দেশের মহামূল্যবান প্রত্ন সম্পদ বিদেশে পাঠাচ্ছে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বলছেন একবিংশ শতকের উপযোগী করে আইনগুলোর সংশোধনী আনা দরকার। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন নগরী পুন্ড্রবর্ধনভুক্তির রাজধানী পুন্ড্রনগর বগুড়ার মহাস্থানগড়ের আশপাশে অন্তত দশ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যে মাউন্টগুলো আছে তার বেশিরভাগই সমতল করা হয়েছে। বগুড়ার গোকুল এলাকায় অন্তত পাঁচটি মাউন্ট কেটে সমতল করে দখল করা হয়েছে। সেখানে কোথাও অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। বগুড়া শহরতলি এলাকায় ভিমের জাঙ্গাল নামের সবুজ উঁচু ভূমির অস্তিত্ব দিনে দিনে থাকছে না। ভূমিগ্রাসীদের চোখ পড়ছে এই প্রত্ন মাউন্ট। রাজধানী ঢাকার অনেক ঐতিহাসিক ইমারত ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব না বুঝেই সম্প্রসারণ ও সংস্কারের নামে ভেঙ্গে আধুনিক স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। একজন ইতিহাসবিদ বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশে তাদের ইতিহাসের স্থাপনা নষ্ট করা হয় না। প্রাচীন নক্সায় অবকাঠামোটি পুনর্নির্মিত হয়। ভারতের অনেক রাজ্যে প্রাচীন ইতিহাসের সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো এভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এমন দৃষ্টান্ত আমাদের দেশেই আছে। যশোরের জেলা প্রশাসন অফিস (যা এক সময় ছিল কালেক্টরেট ভবন) ছিল প্রাচীন আমলে নির্মিত একতলা। এই অবকাঠামোকে ভেঙ্গে অবিকল প্রাচীন নক্সায় তিনতলা করা হয়েছে। যশোর প্রশাসন প্রাচীন কীর্তির ব্যত্যয় ঘটায়নি। ঢাকার নারিন্দায় সুলতানী আমলে নির্মিত বিনদ বিবির মসজিদটি ভেঙ্গে সেখানে ওই মসজিদের চেয়ে অনেক বড় করে আধুনিক মসজিদ নির্মিত হয়েছে। এই মসজিদটি ছিল প্রাচীন ইতিহাসের মুসলিম স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত। মসজিদটি যেন ভেঙ্গে ফেলা না হয় এবং এই মসজিদকে ঠিক রেখে সম্প্রসারনের দাবি উঠেছিল। তা টেকেনি। এ ধরনের ঘটনা অনেক আছে। রাজশাহী মহানগরীতে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে কান্ত কবি নামে খ্যাত রজনীকান্ত সেন, ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও স্যার যদুনাথ সরকারের বাসভবন। ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে গত শতকের গোড়ার দিকে নির্মিত ঢোপকল। পুঠিয়ার মহারানী হৈমন্ত কুমারীর আর্থিক সহায়তায় ১৯৩৭ সালে স্থাপিত হয়েছিল এক শ’টিরও বেশি ঢোপকল। নগরীর পানির চাহিদা মেটাতে ওয়াটার ওয়ার্কস প্লান্ট নামে পানি সরবরাহের প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন মহারানী। ভূগর্ভের পানি শোধন করে নগরীর মোড়ে মোড়ে স্থাপিত ঢোপকলে পানি পৌঁছে যেত। সুপেয় এই পানি সংগ্রহ করত নগরীর মানুষ। রাজশাহী মহানগরীকে সাজাতে রাস্তা সম্প্রসারণে এই ঢোপকল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। যা টিকে আছে তা জাদুঘরে পাঠনো হবে। বিশিষ্টজনের কথা ঐতিহ্য কখনও জাদুঘরে রেখে সংরক্ষণ করা যায় না। ঐতিহ্য নিজস্ব জায়গায় সংরক্ষিত থাকে।
×