ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ধুঁকছে দেশের সিনেমা, চৌদ্দ শ’ হলের মধ্যে টিকে আছে ২৫০

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

ধুঁকছে দেশের সিনেমা, চৌদ্দ শ’ হলের মধ্যে টিকে আছে ২৫০

গৌতম পাণ্ডে ॥ ‘আশির দশকে দেখেছিলাম ‘দূরদেশ’ সিনেমা। শশী কাপুর ও শর্মিলা ঠাকুরের সংলাপ এখনও অজান্তেই মনের মধ্যে প্রায়ই মাঝেমধ্যে বাজে। যখন শুনলাম মধুমিতায় ছবিটি দেখানো হবে, আর লোভ সামলাতে পারলাম না। সস্ত্রীক ঢুকে পড়লাম মধুমিতা সিনেমা হলে। সোমবার পুরনো এ ছবি দেখতে এসে এমন কথাই বললেন আরমানিটোলা থেকে মধুমিতায় আসা দর্শক মধ্যবয়সী সরদার রহমত আলী। নতুন বছরে মানসম্মত কোন চলচ্চিত্র এখনও মুক্তি পায়নি, তাই নিজেদের সাতটি পুরনো ছবি প্রদর্শনের উদ্যোগ নিয়েছে ঐতিহ্যবাহী মধুমিতা কর্তৃপক্ষ। রবিবার দেখানো হলো আশির দশকের যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘দূর দেশ’। ভাল ছবির সংকটে ভুগছে রাজধানীর আরও দুটি ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল ‘বলাকা’ ও ‘শ্যামলী’। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বলাকায় চলছে পুরনো ছবি ‘তুই শুধু আমার’ এবং শ্যামলীতে ‘আমি শুধু তোর হলাম’। দেশের সিনেমার কেন এমন দৈন্যদশা? বিশ্বে চলচ্চিত্র প্রতিনিয়ত এগোচ্ছে অথচ আমাদের কেন ভগ্নদশা? প্রশ্ন ঘুরে ফিরে সবার মুখে। একে একে বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হল। ১৪শ’ হলের এখন বাকি আছে আড়াই শ’। বাকি হল মালিকদের মুখেও বিদায়ের সুর। কোন কোন জেলা শহরে সিনেমা হল পুরোই বিলুপ্ত। লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে প্রযোজকরাও সিনেমায় টাকা লগ্নি করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। চলচ্চিত্রের এই করুণ পরিণতির জন্য প্রযোজক-পরিচালক দায়ী করছেন হল মালিকদের। অন্যদিকে হল মালিকরা অভিযোগ তুলছে মানহীন ছবি থেকে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আবার চলচ্চিত্র শিল্পীরা ছবি প্রদর্শনের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছে। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছে, এর দায় সরকারের। সব মিলিয়ে দেশের চলচ্চিত্র ধুঁকছে। এটা তো মিথ্যে নয়, দেশের সিনেমা দিন দিন শেষ হচ্ছে। দর্শক বড় পর্দা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঘরে বসেই বিশ্বের ভাল মানের সিনেমা দেখতে পারছে, টাকা খরচ করে দুর্গন্ধযুক্ত স্থানে গিয়ে নি¤œমানের ছবি কেন দেখবে? সময়ের প্রয়োজনে আধুনিক ফিল্ম নির্মাণের পৃষ্ঠপোষকতা ও যথাযথভাবে প্রদর্শনের অভাবেই বাংলা সিনেমা আজ ধুঁকছে। তারপরও যে বাংলা সিনেমা টিকে আছে, সেটা চলচ্চিত্রে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের কারণেই। প্রদর্শকরা বলছে, ভাল ছবি হলে হল আরও ভাল হবে, পরিচালক বলছে ছবি ভাল হচ্ছে, হল ভাল নয়। একে অপরে এরকম কাদা ছোড়াছুড়ি হচ্ছে দীর্ঘ দশ বছরেরও অধিককাল ধরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশের সিনেমা কি এভাবেই শেষ হয়ে যাবে, নাকি সিনেমাকে ধ্বংসের জন্য তৃতীয় কোন অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে? এমনও মন্তব্য করছেন অনেকেই। প্রদর্শক সমিতির সভাপতি, সেন্সর বোর্ডের সদস্য ও মধুমিতা সিনেমা হলের মালিক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ জনকণ্ঠকে বলেন, ভাল কোন ছবি নেই বলেই নিজেদের পুরনো ছবি চালাতে বাধ্য হয়েছি। হলের পর্দা তো আর ফাঁকা রাখা যায় না। আমরা প্রচণ্ডভাবে সিনেমা সংকটে ভুগছি। যেগুলো পাই সেগুলো হলে তোলার মতো নয়। যারা ছবি বানায় তাদের অনেকের অভিযোগ দেশের হল ভাল নয়, হলের পরিবেশ ভাল নয়। তাহলে ‘আয়নাবাজি’, ‘ঢাকা এ্যাটাক’ এমনকি সাম্প্রতিক ছবি ‘দহন’ কী করে চলে? আমাদের দেশে এখন ভাল ছবি নেই বললেই চলে। চৌদ্দশ হল কমতে কমতে এখন আড়াইশয়ে এসেছে। এগুলো যদি দিনের পর দিন লস টানতে থাকে, তাহলে এগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। কাজেই আমাদের বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে হলে বিদেশী জনপ্রিয় সিনেমা দেখানোর কোন বিকল্প নেই। যারা বিদেশী সিনেমা আনার বিরোধিতা করছেন, তারা পরিচালক, তারা ইনভেস্টর নন। একটি সিনেমা ব্যবসা সফল না হলে পরিচালকের কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু লাভ না হলে ইনভেস্টর ডোবে। আমরা হল মালিকরা যখন কর্মচারীদের বেতন দিতে পারি না, সেই পরিচালক তখন টিভি চ্যানেলে গিয়ে নাটক বানায়। আমরা সিনেমা হলমালিকরাও ইনভেস্ট করে বসে আছি। এখন লোকসানে হল চালানোর চেয়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছি। তাছাড়া স্টার সিনেপ্লেক্স বা ব্লকবাস্টার সিনেমা তো দিনের পর দিন বিদেশী ছবি চালাচ্ছে, আমরা কেন পারব না? খুব শীঘ্রই আমরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বসব। সেখানে আমাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরব। দর্শক চাহিদা পুরোপুরি মেটাতে ব্যর্থ ২০১৮ সালের সিনেমা। ফ্লপ ছবির হিড়িক পড়ে যায় বছর জুড়ে। দেশী ও যৌথ প্রযোজনা এবং আমদানি করা নিয়ে গত বছর দেশে মুক্তি পাওয়া ছবির সংখ্যা ছিল ৫৬। হাতেগোনা কয়েকটি আলোচনায় এলেও ব্যবসা সফল হয়েছে বলা যাবে না। বছরজুড়ে আমদানিতে ভারতীয় বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছে দশটি। যৌথ প্রযোজনায় তিনটি ছবি মুক্তি পায়। আলোচিত দর্শকপ্রিয় দেশী ছবির তালিকায় ছিল ‘পোড়ামন টু’, ‘দেবী’ ও ‘দহন’। দেশের সিনেমা কেন এমন দৈন্য, এর থেকে উত্তরণের উপায় কি? পরিচালক সমিতির সভাপতি সেন্সর বোর্ডের সদস্য মুশফিকুর রহমান গুলজার এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের সিনেমার দৈন্যদশার জন্য হল মালিকরাই বেশি দায়ী। তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে প্রযোজকরা সিনেমা বানাতে আগ্রহী হচ্ছে না। হল মালিকরা শুধুমাত্র শাকিব খানের ছবি ছাড়া অন্য ছবি চালাতে চায় না। সিনেমা অনেক আছে, কিন্তু হল সব সময় বুকিং থাকছে। এর কারণে সম্প্রতি তৌকিরের ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবি রিলিজ দিতে দেরি হচ্ছে। সিনেমাকে ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে হল মালিকরা। তারা ভারতীয় ছবি আমদানির জন্য পরিচালক-প্রযোজকদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। হলের সংস্কার, গাড়ি রাখার জায়গাসহ দর্শক আকৃষ্ট করার কোন কিছুই করতে চায় না তারা। কোন এক সময়ে নতুন ছবি রিলিজ হলে হল মালিকরাই নিজ উদ্যোগে প্রচার বা পোস্টার লাগাত। এখন তারা প্রযোজকদের ওপর সঁপে দেয়। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সিনেমা হলের টিকেটের মূল্য ২১৫ টাকা হলে, অন্যান্য সব বাদ দিয়ে প্রযোজক পায় ১০৪ টাকা। আর আমাদের দেশে ব্লকবাস্টার সিনেপ্লেক্সে টিকেটের মূল্য ৪৫০ টাকা হলে প্রযোজককে দেয় ৫৩ টাকা। বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে ২০০ টাকার টিকেটে প্রযোজক পায় ১৭ টাকা। শুধুমাত্র সিনেমা হচ্ছে না বললেই তো আর হবে না। দশ বছরের ব্যবসাসফল ছবি ‘আয়নাবাজি’। অভিযোগ আছে এখনও হল মালিকদের কাছে টাকা পাওনা রয়েছে। এমন বৈষম্য থাকলে নতুন সিনেমা বানাতে প্রযোজকরা কি আগ্রহ দেখাবে? এমন বৈষম্য দূর হওয়া আবশ্যক। আমরা সে জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসব। আমাদের প্রস্তাব থাকবে সিনেমা হলে ই টিকেটের ব্যবস্থা করতে হবে, প্রযোজকদের ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার করতে হবে, এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে হবে। চলচ্চিত্র পরিচালক মোর্শেদুল ইসলাম একই সুরে সুর মিলিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, এক কথায় বলতে গেলে আমাদের চলচ্চিত্র ভালর দিকে যাচ্ছে। ভাল কিছু ছবি যে হচ্ছে না এটা বলা যাবে না। সিনেমা প্রদর্শনের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে হল সংকট। সিনেমা হল নাই, ছোট পরিসরের মানসম্মত ভাল হল তৈরি করতে হবে। দর্শক ভাল পরিবেশে সিনেমা দেখতে চায়। এরজন্য সরকারী উদ্যোগতো বটেই, পাশাপাশি ব্যাক্তি উদ্যোগে হল তৈরি করতে হবে। আর ই টিকেটিং চালু করতে হবে। প্রযোজকরা সিনেমা বানিয়ে লগ্নি করা টাকা ফেরত পান না প্রদর্শকদের কারণে। রাজধানীর অন্যতম হল বলাকা সিনেমায় চলছে পুরনো ছবি ‘তুই শুধু আমার’। কেন পুরনো ছবি চালাচ্ছেন জানতে চাইলে হল ম্যানেজার সামসুল আরিফ রণি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা আছি ছবি সংকটে। একেবারে কোন ভাল ছবি নেই। লাইট, কর্মচারীর বেতনের কথা চিন্তা করে আমরা পুরনো ছবি চালাচ্ছি। ভাল গল্প ও মেকিংয়ের কোন ছবি বাংলাদেশে এখন হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি শেষ হয়ে যাবে। হলের পরিবেশ ভাল না এমন প্রশ্ন যারা করছেন তারা তো হল মালিক নয়, হলে বুঝতে পারত দিনের পর দিন আমরা কেমন করে লোকসানের বোঝা টেনে যাচ্ছি। এ দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে হলে ভাল ছবির বিকল্প নেই। ভাল ছবি হলে আমরাও লাভবান হব, প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পীসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাই লাভবান হবে, দেশের চলচ্চিত্র শিল্পও সমৃদ্ধ হবে। রাজধানীর আরেক সিনেমা হল শ্যামলী’র হাউস ম্যানেজার আহসানউল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, কোন নতুন ছবি নেই, যা দুএকটা মুক্তি পাচ্ছে সেগুলো মানসম্মত নয়। হলে দর্শক আসছে না। দিনের পর দিন লোকসানের বোঝা বইতে হচ্ছে। তবুও দেশের সিনেমার স্বার্থে আমরা পুরনো ছবি দিয়ে হল চালাচ্ছি। বর্তমানে আমাদের হলে চলছে আমদানিকৃত ছবি ‘আমি শুধু তোর হলাম’। এতেও দর্শক নেই। আমাদের মালিকের নাম এম এ গাফফার। তিনি বলেছেন, আর কয়েক মাস এমন চলতে থাকলে হল বন্ধ করে দিতে হবে। হলের পরিবেশ ভাল না, এমন অভিযোগ একেবারে মিথ্যা। ‘আয়নাবাজি’, ‘ঢাকা এ্যাটাকের’ মত ছবিতে আমরা দর্শকের জায়গা দিতে পারিনি। দুই দিন বছরে যদি দুই একটা ছবি ভাল হয়, তা দিয়ে হল চালানো সম্ভব নয়। এতে দেশের চলচ্চিত্র শিল্প উন্নত হচ্ছে বলা যায় না। হল যদি না থাকে তো চলচ্চিত্র কোথায় দেখবে দর্শক। এখন ঘরে বসে দেশ বিদেশের ভাল ছবি দেখার সুযোগ রয়েছে। শুধু শুধু টাকা খরচ, সময় অপচয় করে বাজে ছবি কেন দেখবে দর্শক? দেশে ভাল ছবি হচ্ছে না, এমন কথা উড়িয়ে দিলেন আরেক নির্মাতা ও অভিনেতা গাজী রাকায়েত। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমি মনেকরি আমাদের সিনেমা ভালর দিকে যাচ্ছে। গত বছর আমরা ‘দেবী’ ও ‘পোড়ামন টু’ সিনেমার ভাল রেসপন্স পেয়েছি। সিনেমাকে ভালর দিকে নেয়ার চেষ্টাও হচ্ছে। সিনেমাকে সত্যিকার অর্থে ভালর দিকে নেয়ার জন্য প্রথমে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। এরপর ব্যক্তি উদ্যোগসহ সিনেমা সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ভাল গল্পের ছবি নির্মাণ করতে হবে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গে সব ধরনের ছবি বানাচ্ছে, যার ফলে সব ধরনের দর্শককে তারা হলমুখী করতে পারছে। শিল্পের নির্দিষ্ট কোন ফ্রেম নেই। তবে সিনেমার ক্ষেত্রে যে চেঞ্জ আসছে এটা খুবই ভাল লাগছে। আমাদের দেশে ভাল স্ক্রিপটের খুব অভাব। সিনেমাকে জনপ্রিয় করতে হলে পরিকল্পনা দরকার। সরকারী উদ্যোগে সিনেপ্লেক্স তৈরি করতে হবে। এফডিসির মাধ্যমে প্রতিমাসে অন্তত একটি করে ছবি প্রডিউস করতে হবে। প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সাবেক আহ্বায়ক সেন্সর বোর্ডের সদস্য নাসির উদ্দিন দিলু জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের সিনেমায় যাচ্ছে তাই অবস্থা বিরাজ করছে। একে অপরকে দোষারোপ ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। আমি তো সেন্সর বোর্ডের একজন সদস্য। যে সব ছবি আসছে তার বেশিরভাগ মানহীন ছবি। নেই ভাল গল্প, সংলাপ, অভিনয় ও মেকিং। আকাশ সংস্কৃতির যুগে ঘরে বসে বিশ্বের ভাল ভাল ছবি দেখা যায়, সেখানে কষ্ঠ করে হলে গিয়ে বাজে ছবি দর্শক কেন দেখবে? তার ওপর হল মালিকদের ঔদাসীন্য। যাচ্ছে তাই করে হলের ব্যবস্থাপনা। বসার ভাল সিট নেই। বিনোদন উপভোগের সব কিছুই অব্যবস্থাপনায় ভর্তি। নতুন ছবি হলে আসলে কোন প্রচার-প্রচারণা নেই। ‘দেবী’ ছবি মুক্তি পেল কোন প্রচার আছে? কিছুদিন আগে যৌথ প্রযোজনায় কিছু ছবি হচ্ছিল, তাও এতো এতো নিয়ম-নীতির কারণে বন্ধ হয়ে গেল। দুই-তিন বছর পরে একটি ভাল ছবি হলে কি আর বাংলাদেশের সিনেমা বাঁচবে? সবার মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা মুস্কিল। বাংলাদেশের সিনেমা দিনকে দিন কেন দর্শক হারাচ্ছে এ সম্পর্কে জানাতে চাইলে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আমি এ সম্পর্কে কোন কথা বলতে চাই না। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রায় ১ হাজার ৪শ’ হলের মধ্যে এখন আছে আড়াই শ’। গত দুই বছর ধরে সরকারের কাছে আমাদের দাবি ছিল, হলগুলোকে ডিজিটালাইজ করা। যে হল বন্ধ করে মালিক মার্কেট করছে, সেখানে মিনি সিনেমা হল তৈরি করা। এগুলো সম্পর্কে আইন প্রণয়ন করা। সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু কথা দিয়েছিলেন এগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। এখন পর্যন্ত তার কিছুই হয় নাই। এখন নতুন সরকার গঠন হয়েছে। তারা কি করবে কিছুই জানা যায় নাই। বিবর্তনের ধারায় মানুষের রুচীর পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিক টেকনোলজির যুগে দুর্গন্ধযুক্ত হলে কোয়ালিটি শূন্য ছবি দেখার জন্য মানুষ যেতে রাজি হবে? প্রতিবছর ১০০টি ছবি নির্মাণ হলে তার ১০টি হয়তো ভাল হবে, ব্যবসাসফল হবে। সব ছবি কিন্তু ব্লকবাস্টার হয় না। বর্তমানে ইনভেস্টের ওপর নির্ভর করে ছবির মান। এখন কোন দেশে যদি ৪শ’ কোটি টাকায় ছবি বানায়, আর আমরা যদি ১ কোটি টাকায় ছবি বানাই, তাহলে কি প্রতিযোগিতা চলে? এখন কিছু লোক তেলবাজির কারণে সরকারী অনুদানের ছবি বানানোর সুযোগ পান। একটি ছবিও দর্শকপ্রিয়তা পায় না। এইরকম দিনের পর দিন চলতে থাকলে আমাদের চলচ্চিত্র কোথায় গিয়ে পৌঁছবে বলা কঠিন। চলচ্চিত্র হয়ত থাকবে, কেউ কেউ শখেরবশে ছবি বানাবে, কিন্তু সত্যিকারের চলচ্চিত্রের জৌলুস আর থাকবে না। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক জায়েদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের চলচ্চিত্র উন্নয়নে আমাদের চেষ্টার কোন ঘাটতি নেই। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি কিভাবে এই শিল্পকে আরও উন্নত করা যায়। দেশের চলচ্চিত্র এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন সরকার এসেছে। আমাদের শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর এখন দেশের বাইরে। উনি এলে আমরা নতুন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বসব। নতুন নতুন দিক নির্দেশনায় এগিয়ে যাব। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরে আসবে ইন্শাল্লাহ্। এফডিসি কর্তৃপক্ষ বলছেন, নতুন যুগের চলচ্চিত্রের যে অগ্রগতি তা থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কমপক্ষে দুই দশক পিছিয়ে। চলচ্চিত্র শিল্প উন্নয়নে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। খুব দ্রুতই এসব উদ্যোগের সুফল পাবে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সাবেক সভাপতি মাসুদ পারভেজ, যিনি নায়ক সোহেল রানা হিসাবেই বেশি পরিচিত, তিনি বললেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বস্তুত কোমাতে আছে। কিন্তু সবাই আশা করছেন এই ইন্ডাস্ট্রি ভাল হবে। কিন্তু কিভাবে এর চিকিৎসা হবে তা নিয়ে কেউ কিছু করছে না। কোন ফিল্ম ইনস্টিটিউট আছে যেখান থেকে শিল্পী, কলাকুশলীরা আধুনিক জ্ঞান অর্জন করে দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবে? নেই। আধুনিক মানের ফিল্ম সিটি নির্মাণের কোন উদ্যোগ আছে? নেই। সুতরাং, সরকার যতদিন এই ফিল্মস ইন্ডাস্ট্রির আধুনিক করার জন্য কাজ না করবে, শিল্পীদের সম্মান না দেবে ততদিন পর্যন্ত এই ইন্ডাস্ট্রি উঠে দাঁড়াতে পারবে না। তিনি বলেন, সারা পৃথিবীর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কোথায় এগিয়ে গেছে। ভারতে এমনকি পশ্চিমবঙ্গে আধুনিক ফিল্ম তৈরি হচ্ছে। তাদের দেশে সরকার ফিল্ম ইনস্টিটিউট করেছে। দেশসেরা শিল্পীরা সেখানে নতুন প্রজন্মকে তৈরি করছে। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে এই এফডিসি তৈরির পরে এর আধুনিক করার বিষয়ে কার্যকরী, সময়োপযোগী কোন পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। ক্রিকেট, ফুটবল, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির জন্য সরকার হাজারো উদ্যোগ নেয়। সিনেমার উন্নতির জন্য কি উদ্যোগ নিয়েছে সরকার? প্রশ্ন করেন নায়ক সোহেল রানা। ক্রিকেট বিশ্বের যে সম্মান কুড়িয়েছে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এর চেয়ে অনেক বেশি সম্মান কুড়িয়েছে। কিন্তু সরকার সেই চলচ্চিত্রের উন্নতির জন্য কিছুই করেনি। তিনি বলেন, এত বাধার মুখেও যে কিছু সাহসী, চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষ এই শিল্পকে আঁকড়ে পড়ে আছেন-এটা তাদের একান্ত ভালবাসার কারণেই। সিনেমাকে মুক্ত করে দিতে হবে। স্বাধীনভাবে কথা বলতে দিতে হবে। নাটকে সেন্সর নেই, টিভির অনুষ্ঠান সম্প্রচারে সেন্সর নেই। শুধু সিনেমাকে সেন্সরশিপ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এভাবে হয় না। সরকার গ্রেডেশন করতে পারে। কিন্তু সেন্সরশিপ দিয়ে পরিচালকের মুখ প্রথমেই বন্ধ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশে মাত্র দুটি সিনেপ্লেক্স। প্রথাগত সিনেমা হলের বিপরীতে এ ধরনের সিনেপ্লেক্সে পরিবেশ ভাল। তবে টিকেটের দামটাও বেশি। এখানে মূলধারার চলচ্চিত্রের বাইরে কিছুটা অফবিট ধারার সিনেমা চলে বেশি। এ প্রসঙ্গে বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্সের সিনিয়র ম্যানেজার মেজবাহউদ্দিন আহমেদ জানান, এখানে বেশিরভাগ মূলধারার সিনেমার দর্শক আসে না। এছাড়া আমাদের পরিবেশ ও হলের স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশের কারণে টিকেটের দাম অন্য সিনেমা হলের তুলনায় বেশি। সবকিছু বিবেচনা করেই আমাদের ছবি নির্বাচন করতে হয়। চলচ্চিত্র শুধু আর্ট নয় ইন্ডাস্ট্রিও। আধুনিক বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে ক্রিকেট, ফুটবল ও গার্মেন্টস খাতের মতোই প্রণোদনা প্রয়োজন। তা না হলে আকাশ সংস্কৃতি ও বিদেশী সিনেমার দাপটে হারিয়ে যাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। সিনেমার সোনালি দিন আবার ফিরে আসুক। নতুন নতুন সিনেমায় বছরজুড়ে সাফল্য বয়ে আনুক। দেশের সমস্ত সিনেমা হল আবার দর্শকের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠুক। দৈন্যদশা থেকে মুক্তি পাক বাংলাদেশের সিনেমা।
×