ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মেরিন ড্রাইভ দিয়ে যুক্ত হবে মিয়ানমার ও চীনে

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ অসম্ভবকে সম্ভবের দেশ এখন সবুজে-শ্যামলে ভরা আমাদের বাংলাদেশ। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় চট্টগ্রাম পিছিয়ে নেই। এই অগ্রযাত্রায় আগামী তিন বছরের মধ্যে যুক্ত হচ্ছে কর্ণফুলী টানেল। যা চট্টগ্রামের আনোয়ারা হয়ে মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে যুক্ত হবে কক্সবাজার তথা টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত। সর্বশেষ এই টানেলের কারণেই সড়ক পথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে চীন পর্যন্ত। প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। গত বছর থেকে শুরু হওয়া এই টানেলের উভয় দিকে টানেলের প্রবেশমুখ তৈরি করা হচ্ছে। যা মোট কাজের শতকরা ৩৯ ভাগ বলে প্রত্যয়ন করেছেন স্থপতিরা। আগামী মাসে মাঝামাঝিতে টানেলের পতেঙ্গা অংশে বোরিং শুরু করা যাবে বলে এমন সম্ভাব্যতার কথা বললেন প্রকল্প পরিচালক। বাংলাদেশ সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে জানা গেছে, কর্ণফুলী টানেল দেশের প্রথম টানেল। সেতু বিভাগের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে এটি একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। চায়না কমিউনিকেশন কন্সট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) নামের একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এই টানেলের কাজ করছে। চীনা ও বাংলাদেশী মিলে প্রায় এক হাজার ২৫০ জন শ্রমিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে যাচ্ছে। আবার সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে কনসালটেন্ট অফিস কক্ষে কাজ করছেন ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার শ্রমিক করছে টানেল নির্মাণের কাজ। কনস্যালটেন্ট হিসেবে করছে এসএমইসি- সিওডব্লিওআই। এই টানেলের মোট ব্যায় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ ৭৮ হাজার বা ১০৫৫ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন। এর মধ্যে সরকারী অর্থায়ন থেকে আসছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ২৩ লাখ ৭৮ হাজার বা ৩৫০ দশমিক শূন্য তিন মিলিয়ন। প্রজেক্ট এসিসট্যান্স থেকে বিনিয়োগ করা হচ্ছে ৫ হাজার ৬৪৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা বা ৭৫০ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন। সেতু বিভাগের হিসাব অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বহুলেন বিশিষ্ট সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। ‘মাল্টি-ল্যান্ড রোড টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলী’ এই টানেলে থাকছে দুটি টিউবের ন্যায় চারলেনের সড়ক নির্মাণ পরিকল্পনা। উভয়দিকে টানেলের মুখ থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ হবে। কর্ণফুলী টানেলর প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের প্রথম টানেলটি উচ্চ ক্ষমতা শক্তিসম্পন্ন কারিগরি কাজ। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি নদীগর্ভে স্থাপন করা হবে টানেল বোরিং মেশিন। ৭০/৮০ ফুট নিচে দিয়ে খননের কাজ শুরু হবে। এ পর্যন্ত টানেল নির্মাণের ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম-১১ আনের এমপি এম এ লতিফ জনকণ্ঠকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পিত উন্নয়নে কোন ধরনের বাধা নেই। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সময়ের ব্যাপার। ২০৪১ সালের আগেই উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, এই উন্নয়ন আমাদের অর্থনীতির চাকাকে ঘুরিয়ে দিবে। চট্টগ্রাম থেকেই মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে কক্সবাজার, টেকনাফ, মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত এই টানেল যোগসূত্র তৈরি করবে। উন্নয়নের যুদ্ধে নেমেছি আমরা। প্রকল্পের নক্সা অনুযায়ী দেখা গেছে, প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ৯ হাজার ২৬৫ দশমিক ৯৭ মিটার। টানেলের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের বাহিরে পতেঙ্গা এলাকায় কাটা হবে ২০০ মিটার আর আনোয়ারায় কাটা হবে ১৯০ মিটার। কার্যপরিধি ২৫ মিটার। আনোয়ারা অংশে ফ্লাই-ওভারের দৈর্ঘ্য ৬৩৭ মিটার। মোট ৫ বছর সময়ের মধ্যে মাত্র এক বছর অতিক্রান্ত হলো। তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এই টানেলের কাজ শেষ হবে বলে সেতু বিভাগের কয়েক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ১২ মিটার বৃত্তাকার এই টানেল আচ্ছাদিত অংশ পতেঙ্গা অংশে ১৯৫ মিটার আর আনোয়ারা অংশে ২৩০ মিটার। ৪ লেন বিশিষ্ট এপ্রোচ সড়কের মধ্যে রয়েছে পতেঙ্গা অংশে ৫৫০ মিটার আর আনোয়ারা অংশে ৪ হাজার ৮০০ মিটার। এই দুটি টিউব চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করবে। টানেলের এ্যালাইনমেন্ট হবে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে কর্ণফুলী নদীর দুই কিলোমিটার ভাটির দিকে। টানেলের প্রবেশপথ হবে নেভি কলেজের কাছে, বহির্গমন পথ হবে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের সিইউএফএল সার কারখানা সংলগ্ন ঘাট। প্রকল্প সাইটের উভয়দিকে বগুড়ার আরডিএ কর্তক চারটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে প্রকল্পের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য। এছাড়াও পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উভয়দিকে ২ মেগাওয়াট বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়েছে। আবার পতেঙ্গা প্রান্তে ১৫ মেগাওয়াট স্থায়ী বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়েছে। আবার আনোয়ারা প্রান্তে বিদ্যুত সাবস্টেশন নির্মাণ করছে। টানেল প্রকল্প পরিচালনায় থাকা চীন ও বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের এপ্রিল মাসে টানেল বোরিংয়ের জন্য বোরিং মেশিন আনা হয়েছে। এখন বোরিং মেশিন সংস্থাপনের কাজ চলছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে পুরো বোরিং মেশিনটি সংস্থাপন করা শেষ হলে আগামী মাসের মাঝামাঝিতে প্রায় ৭০/৮০ ফুট নিচে দিয়ে টানেল বোরিংয়ের কাজ শুরু হবে। এই টানেল নির্মাণে মোট ভূমি ৩৮৩ একর। এর মধ্যে প্রায় আড়াইশ একর ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। টানেলের বোরিং কাজ শুরু করতে টানেলের উভয়দিকে জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্রিজ অথরিটির পক্ষ থেকে আরও জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে চট্টগ্রামের চিত্র। গড়ে উঠবে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগ, আধুনিয়কায়ন হবে বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, সংযোগ স্থাপন হবে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে, যুক্ত করা হবে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরের সঙ্গে ডাউন টাউনকে, ত্বরান্বিত হবে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, বৃদ্ধি পাবে চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধা, গতি পাবে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণ কাজ, নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে।
×