ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইভান্সের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে উড়ে গেল কুমিল্লা

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

ইভান্সের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে উড়ে গেল কুমিল্লা

মিথুন আশরাফ ॥ স্কুল জীবনে ছিলেন রাগবি খেলোয়াড়। কাঁধের ইনজুরিতে রাগবি খেলা বাদ দিতে হয়। এরপর ক্রিকেটে মনোযোগী হন। বিশেষ করে নির্ধারিত ওভারের ক্রিকেটে মারমুখী ব্যাটসম্যান ইংল্যান্ডের লরি ইভান্স। ইংল্যান্ডের হয়ে এখনও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানো হয়নি। তবে কাউন্টি ক্রিকেট খেলেন নিয়মিতই। ব্যাট হাতে ঝলকও দেখান। এবার বিপিএলে রাজশাহী কিংসের হয়ে নিজেকে আলাদারূপেই উপস্থাপন করলেন ইভান্স। ষষ্ঠ আসরের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হয়ে গেলেন। টি২০ ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেলেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে অপরাজিত ১০৪ রানের ইনিংস খেলেন। ৬২ বলে তার এই বিধ্বংসী ইনিংসে রাজশাহীও ৩৮ রানে কুমিল্লাকে হারায়। লীগপর্বে দুই দলের মধ্যকার প্রথম ম্যাচে যে কুমিল্লা জিতেছিল, দ্বিতীয় ম্যাচে তার প্রতিশোধও নেয়া হয়ে যায় রাজশাহীর। ইভান্সের ব্যাটিং ধামাকাতে এবার উড়ে গেল কুমিল্লা। টস জিতে কুমিল্লা আগে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। রাজশাহী ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়ে ৩ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে ১৭৬ রান করে রাজশাহী। তা সম্ভব হয় ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যান লরি ইভান্সের ৯ চার ও ৬ ছক্কার ঝড়ো ইনিংসে। ইভান্সের সঙ্গে হল্যান্ডের রায়ান টেন ডয়েশ্চেটও (৪১ বলে অপরাজিত ৫৯ রান) দুর্দান্ত ব্যাটিং করেন। এ দুইজনের চতুর্থ উইকেটে করা অবিচ্ছিন্ন ১৪৮ রানের রেকর্ড জুটিতে এত বড় স্কোর গড়া সম্ভব হয়। জবাব দিতে গিয়ে ১৮.২ ওভারে ১৩৮ রান করতেই গুটিয়ে যায় কুমিল্লা। রাজশাহী যে স্কোর গড়েছে তা টপকে যেতে হলে কুমিল্লার ব্যাটসম্যানদের বড় ইনিংস এবং বড় জুটি গড়া ছাড়া কোন গতি ছিল না। সেই ইনিংস ও জুটি গড়ার মতো ওপেনার তামিম ইকবাল, এনামুল হক বিজয়, জিয়াউর রহমান, ইমরুল কায়েস, লিয়াম ডসন, থিসারা পেরেরা, শহীদ আফ্রিদি ছিলেন। কিন্তু কেউই ব্যাট হাতে জৌলুস ছড়াতে পারেননি। ব্যাটিংয়ে শুরুটা ভাল হয় কুমিল্লার। তামিম ও এনামুল হক বিজয় মিলে সুন্দরভাবে এগিয়েও যেতে থাকেন। কিন্তু দলের ৩৭ রান হতেই তামিম (২৫) আউট হয়ে যান। এরপর শামসুর রহমান শুভকে নিয়ে বিজয় হাল ধরার চেষ্টা করেও পারেননি। দলের ৬৭ রানের সময় বিজয় (২৬) নিজেই সাজঘরে ফেরেন। ৪ রান স্কোরবোর্ডে যোগ হতেই শুভও আউট হয়ে যান। ধীরে ধীরে কুমিল্লার জয়ের আশা ফিকে হয়ে যেতে থাকে। দলের ৯৩ রানে গিয়ে হার্টহিটার জিয়াউর রহমানও যখন ড্রেসিংরুমের পথ ধরেন তখন ইমরুল, ডওসন, পেরেরা ও আফ্রিদিই ভরসা হয়ে ওঠার মতো ব্যাটসম্যান থাকেন। ইমরুলতো ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করছেন এবার। একের পর এক ম্যাচে ব্যর্থ হচ্ছেন। পেরেরা ধুন্ধুমার ব্যাটিং করে ম্যাচের মোড় যে কোন মুহূর্তে ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু তিনি এদিন রানের খাতা খোলার আগেই আউট হয়ে যান। পেরেরাকে হারিয়ে কুমিল্লার হার যেন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। শেষ মুহূর্তে ঝিমিয়ে পড়া ম্যাচটিতে আফ্রিদি একটু আমেজ এনে দেন। কাইস আহমেদের করা ১৬তম ওভারে টানা তিন বলে দুটি ছক্কা ও একটি চার হাঁকান। কিন্তু অসাধারণ বোলিং নৈপুণ্য দেখানো মুস্তাফিজুর রহমানের করা পরের ওভারের টানা চার বলে ব্যাটেই বল লাগাতে পারেননি আফ্রিদি। ১৮তম ওভারের প্রথম বলে আউটই হয়ে যান তিনি। একই ওভারের প্রথম বলে আফ্রিদিকে আউট করার পর তৃতীয় ও চতুর্থ বলে ডসন ও সাইফউদ্দিনকে সাজঘরে ফেরান পেসার কামরুল ইসলাম রাব্বি। ৪ উইকেট শিকার করার সঙ্গে হ্যাটট্রিকের আশাও জাগান রাব্বি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তবে ১৩৬ রানেই ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলে কুমিল্লা। মুস্তাফিজ এত দুর্দান্ত বোলিং করছিলেন, কিন্তু উইকেটই মিলছিল না। অবশেষে মেহেদী হাসানকে আউট করে উইকেটের দেখা পান। এই উইকেটটি পেতেই কুমিল্লাও অলআউট হয়ে যায়। হার হয় কুমিল্লার। হেরেও অবশ্য কুমিল্লা তৃতীয় স্থানেই থাকে। জিতে রাজশাহী পঞ্চম স্থান থেকে চতুর্থ স্থানে উঠে আসে। ঢাকায় যখন লীগের প্রথমপর্ব হয় তখন ঢাকা ডায়নামাইটসের ম্যাচ ছাড়া অন্য কোন ম্যাচে দর্শক দেখা যায়নি। দর্শক সঙ্কটে ভুগেছে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম। সিলেটে সেই চিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে। সিলেটে লীগের দ্বিতীয়পর্ব শেষে যখন আবার ঢাকায় তৃতীয়পর্ব সোমবার থেকে শুরু হয়েছে তখন আবারও একই অবস্থা দেখা গেছে। রাজশাহী-কুমিল্লা ম্যাচেতো পঁচিশ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামে চারহাজার দর্শকও দেখা যায়নি। ঢাকায় দর্শক টানতেই পারছে না এবার বিপিএল। ঢাকায় প্রথমপর্বে আরেকটি অসুবিধা দেখা গেছে। স্কোরবোর্ডে রান আশানুরূপ হয়নি। সিলেটেও প্রথমদিন দুই ম্যাচে রান খরা দেখা গেছে। কিন্তু দ্বিতীয়দিন থেকেই সেই চিত্র পাল্টেছে। সিলেটে এমন রানই হয়েছে, একটি ইনিংস হয়েছে ২০০ রানের (২১৪ রান) ওপরে। আর ৪ রান হলে বিপিএলেরই সবচেয়ে বড় স্কোর হয়ে যেত। ছয়টি ইনিংস দুই শ’ রানের কাছে হয়েছে। সেই ধারা অবশ্য ঢাকাতেও বজায় থাকে। সোমবার প্রথম ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই রাজশাহী বড় স্কোর গড়ে। ১৮০ রানের কাছে করে। ঢাকায় প্রথমপর্বে ১৪ ম্যাচের মধ্যে ছয়টি ইনিংস এরচেয়ে বড় হয়েছিল। বাকি সব ইনিংসই এর নিচে হয়। এই স্কোর গড়তে অবশ্য ইভান্স ও ডয়েশ্চেটকেই আসল ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। ২৮ রানেই রাজশাহীর ৩ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল, ১২০ রান করাই কঠিন হয়ে যাবে। পাওয়ার প্লেতে ২৮ রানের বেশি করতে পারেনি রাজশাহী। টি২০’র কোন আমেজ মিলছিল না। ১০ ওভারে গিয়ে স্কোরবোর্ডে ৫০ রান হয়। স্বাভাবিকভাবেই এত বড় স্কোর হবে তা ভাবাই যায়নি। কিন্তু ইভান্স ও ডয়েশ্চেট মিলে যেন অসম্ভবকেই সম্ভব করলেন। দুইজন মিলে ১০ ওভারের পর থেকে এমনই ব্যাটিং তা-ব দেখালেন, ১৫ ওভারেই ১০২ রান হয়ে যায়। ৫ ওভারে স্কোরবোর্ডে ৫২ রান যোগ করে ফেলেন দুইজন। ১৩তম ওভার পর্যন্ত দুইজনই উইকেটে আঁকড়ে থেকে বুঝে খেলেন। কিন্তু থিসারা পেরেরার করা ১৪তম ওভারে ইভান্স দুটি ছক্কা ও ডয়েশ্চেট একটি ছক্কা হাঁকান। এই ওভারেই ২১ রান আসে। ওভারের শেষ বলে লং অন দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়ে ইভান্স ৪০ বলে হাফ সেঞ্চুরিও করেন। রাজশাহীর হয়ে এক ম্যাচ ছাড়া সব ম্যাচেই খেলেন ইভান্স। কিন্তু এর আগে ১০ রানের বেশিই কোন ইনিংস নেই। কিন্তু এদিন অন্যরূপ দেখালেন এ ওপেনার। এই ১৪তম ওভার থেকেই ইভান্স ও ডয়েশ্চেটের ব্যাটিং ধামাকা শুরু হয়ে যায়। তা আর শেষ হয়নি। মাঝখান দিয়ে নির্ধারিত ২০ ওভারই শেষ হয়েছে। শেষের ৫ ওভারেতো দুইজন মিলে ৭৪ রান স্কোরবোর্ডে জমা হয়। ইভান্স একটি ছক্কা হাঁকানতো ডয়েশ্চেটও পরক্ষণে মাঠের বাইরে বল পাঠান। ওয়াহাব রিয়াজের করা ১৯তম ওভারেতো দুটি ছক্কা ও একটি চার হাঁকান ইভান্স। তার স্কোরবোর্ডে দ্রুতই রান জমা হতে থাকে। এই ওভারের শেষ বলে কাভার দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ৬০ বলে ৯৯ রান করে ফেলেন ইভান্স। বিপিএলের এবারের আসরে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হতে আর ১ রান লাগে ইভান্সের। একই সময়ে ডয়েশ্চেটেরও হাফ সেঞ্চুরি হতে লাগে ১ রান। দলের রানও ততক্ষণে ১৬১ হয়ে যায়। ২০তম ওভারের প্রথম বলে ১ রান নিয়ে ৩৮ বলে ৫০ রান করেন ডয়েশ্চেট। ২০তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ইভান্সও ১ রান নিয়ে সেঞ্চুরি করে ফেলেন। বিপিএলের ১৩তম সেঞ্চুরি করেন ইভান্স। এবার কী কোন সেঞ্চুরির দেখা মিলবে না? বিপিএলের অর্ধেকটা শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। কোন সেঞ্চুরির দেখা মিলছিল না। অবশেষে ১৭তম দিনে এসে সেঞ্চুরি এবং সেঞ্চুরিয়ানের দেখা মিলল। এমন একজন সেঞ্চুরি করলেন, যাকে নিয়ে এমন ইনিংস হবে; কোন আশাই ছিল না। সেই ইভান্সই দেখিয়ে দিলেন। শেষ পর্যন্ত শেষ ওভারে ডয়েশ্চেট একটি ছক্কা ও ইভান্স একটি বাউন্ডারি হাঁকান। তাতে করে দলের রানও ১৭৬ হয়। ইভান্স ৪০ বলে ৫০ রান করেন। সেখান থেকে পরের ২২ বলে ৫৪ রান করে বসেন। ডয়েশ্চেটও শেষ পর্যন্ত ২ চার ও ৩ ছক্কায় বড় ইনিংস খেলেই মাঠ ছাড়েন। দুইজন মিলে যে ১৪৮ রানের জুটি গড়েন তা বিপিএলে চতুর্থ উইকেটে রেকর্ড জুটি হয়ে যায়। এর আগে ২০১৫ সালের বিপিএলে কুমিল্লার মারলন স্যামুয়েলস ও মাশরাফি বিন মর্তুজা মিলে অবিচ্ছিন্ন ১২৩ রানের জুটি গড়েছিলেন। যা রবিবার পর্যন্ত এই উইকেটে রেকর্ড জুটি ছিল। সোমবার ইভান্স ও ডয়েশ্চেট মিলে তা ভেঙ্গে নতুন জুটি গড়েন। এই জুটির চেয়েও আসলে বেশি আকর্ষণ, আলোচনা থাকে ইভান্সকে নিয়ে। তিনি যে এবার বিপিএলের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হয়ে গেছেন। তার এই সেঞ্চুরিতেইতো কুমিল্লাকে উড়িয়ে দিয়েছে রাজশাহী। স্কোর ॥ রাজশাহী কিংস ইনিংস- ১৭৬/৩; ২০ ওভার (শাহরিয়ার ৫, ইভান্স ১০৪*, মিরাজ ০, মার্শাল ২, ডয়েশ্চেট ৫৯*; ডসন ২/২০)। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ইনিংস- ১৩৮/১০; ১৮.২ ওভার (তামিম ২৫, বিজয় ২৬, শুভ ১৫, জিয়াউর ১২, ইমরুল ১৫, ডসন ১৭, পেরেরা ০, আফ্রিদি ১৯, সাইফউদ্দিন ০, ওয়াহাব ১*, মেহেদী ১; রাব্বি ৪/১০, ডয়েশ্চেট ২/১৫, কাইস ২/৪৬, মুস্তাফিজ ১/৮)। ফল ॥ রাজশাহী কিংস ৩৮ রানে জয়ী। ম্যাচসেরা ॥ লরি ইভান্স (রাজশাহী কিংস)।
×